শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১১:১৮ অপরাহ্ন

মিথ্যা প্রতিযোগিতায় মির্জা ফখরুলের অবস্থান

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক / ১৫২ বার
আপডেট : সোমবার, ২০ জুন, ২০২২

অনেক পাঠক শুনে অবাক হলেও একটি সত্য কথা এই যে যুক্তরাজ্যের উত্তরাঞ্চল কেম্রিয়াতে প্রতি বছর নভেম্বর মাসে ‘মিথ্যা প্রতিযোগিতা’ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং প্রতিযোগীদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি চমকপ্রদ মিথ্যা বলতে পারে তাকে শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী বলে তকমা দেওয়া হয়। এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল উইল রিটসন নামক এক পানশালা মালিকের স্মরণে। কারণ, ব্যবসার পাশাপাশি তার কাজ ছিল জনগণকে মিথ্যা কাহিনি বলা। এটি তিনি করতেন নিজেকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। তার বহু উদ্ভট কাহিনির মধ্যে একটি ছিল এ রকম, তিনি একটি আহত ঈগল পাখিকে সারিয়ে তোলার পর একটি শৃগাল তা খেয়ে ফেলেছিল, কিন্তু পরে শৃগাল সেই ঈগলটিকে প্রসব করেছিল।

যেসব ব্যক্তি গত কয়েক বছর মিথ্যা প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে আছেন ২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার আব্রি কুংগার, ফ্রিডা কাহালো, ২০০৬ সালে স্যু পারকিনস নামক মহিলা কৌতুক অভিনেত্রী। ২০০৮ সালে জয়ী হয়েছিলেন জন গ্রাহাম নামক একজন এ কথা বলে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি জার্মান ডুবোজাহাজ যুক্তরাজ্য আক্রমণ করেছিল সেখান থেকে ডিজিটাল টেলিভিশনের ডি-কোড অপহরণের জন্য, যা কিনা ছিল সে সময়ে খুবই অবান্তর। এই প্রতিযোগিতায় একসময় কারলাইলের বিশপ এই উক্তি করে শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদীর তকমা অর্জন করেছিলেন যে তিনি জীবনে কখনও মিথ্যা বলেননি, কেননা তার সেই উক্তি এ কারণে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না যে তিনি ছোটবেলা থেকে শুরু করে কোনও না কোনও সময় অবশ্যই মিথ্যা বলেছেন।

এই প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ‘প্রখ্যাত মিথ্যাচার’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথা জানতে পারেননি, কেননা এ পর্যন্ত সেসব ব্যক্তি মিথ্যার জন্য পদক পেয়েছেন, মির্জা ফখরুলের মিথ্যা তার চেয়েও অনেক বেশি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। কেননা, তিনি পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর খালেদা জিয়া স্থাপন করেছিলেন বলে বিশ্বে মিথ্যার সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন। এটি পুরোপুরি অবান্তরের মোড়কে ঢাকা এমনই একটি মিথ্যাচার, যার পক্ষে কোনও প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না, যে কারণে মির্জা সাহেবের বক্তব্য সমর্থন করে কেউ মন্তব্য করেননি। বরং খালেদা জিয়ার আমলের যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা কথাটি সত্য নয় বলে বিবৃতি দিয়েছেন। কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তি কোনও কিছুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলে সেই প্রস্তরটি সর্বকালের জন্য রক্ষিত থাকে। খালেদা জিয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলে তাও নিশ্চয়ই রক্ষিত থাকতো। কিন্তু মির্জা ফখরুল তো তা দেখাতে পারছেন না। তাছাড়া কোনও রাষ্ট্রনায়ক কিছুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলে তা ঢালাওভাবে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, যে জন্য ভবিষ্যতে বহু বছরও জনগণ তা মনে রাখে। অথচ খালেদা জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল বলে কোনও মানুষই কখনও শুনেননি। মির্জা সাহেবের এই মিথ্যাচার সত্যি কথা বলতে কী– রাতকে দিন বানানোর মতোই, আর তাই মিথ্যা প্রতিযোগিতায় তার সমকক্ষ কেউ হতে পারবে না।

কোনও না কোনও সময় প্রায় সব মানুষই বিভিন্ন কারণে মিথ্যা বলে থাকেন। কিন্তু যারা মিথ্যার সীমা লঙ্ঘন করেন, উদ্ভট কথা বলেন তাদের নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এদের অনেকেই স্কিজোফ্রেনিয়া নামক মানসিক বিকারগ্রস্ত। কেউ আবার হেলোসিনেশনেও ভুগে থাকেন। এদের সাধারণত “প্যাথলজিক্যাল লায়ার” বলা হয়, কেননা এরা অনেক সময় মিথ্যা বলা বন্ধ করতে অক্ষম। বিশ্বে খুব কম লোকই আছেন যারা নাৎসি নেতা গোয়েবলস এবং লর্ড হো হোর নাম শুনেননি। দ্বিতীয় মহাসমরকালে তারা পেশাগতভাবে নাৎসিবাদের সপক্ষে বার্তা প্রচার করতো জার্মান বেতার থেকে।

গোয়েবলস এই মতবাদে বিশ্বাস করতেন যে একটি মিথ্যা একশতবার প্রচার করলে মানুষ একসময়ে তা বিশ্বাস করবে, আর লর্ড হো হো ভাবতেন খুব কেতাদুরস্ত ইংরেজি ভাষায় মিথ্যা বলতে পারলে মানুষ তাকে সত্য বলেই মেনে নেয়। এদের দুজনের মতবাদই যে ব্যর্থ হয়েছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ই তার প্রমাণ। তাদের কথা কেউ বিশ্বাস করতেন না।

এছাড়াও যে কয়েকজন ব্যক্তিকে বিশেষ ধরনের মিথ্যাচারী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত শিল্পী ফ্রিডা কাহলে, যিনি নিজের জীবন নিয়ে মিথ্যা বলতেন, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন, যিনি হোয়াইট হাউজের মহিলা কর্মীর সাথে যৌন সম্পর্ককে অস্বীকার করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন, রিচার্ড নিক্সন, যিনি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যাচার করেছিলেন, মার্কিন বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং রাজনীতিক বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, যিনি কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির অগ্রদূত ছিলেন, তাকেও অন্যতম মিথ্যাচারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ, জীবনে তিনি বহু সাজানো গল্প করেছেন। যুক্তরাজ্যের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এন্থনি ব্লেয়ার, যিনি ইরাকে মারণাস্ত্র রয়েছে বলে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন, যার ফলে যুক্তরাজ্যে শ্রমিক দলের ভরাডুবি হয়েছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প মিথ্যার আশ্রয় নেওয়ার কারণে গদি হারিয়েছিলেন। কিন্তু এদের সকলের মিথ্যার রেকর্ড ভঙ্গ করে মিথ্যার শ্রেষ্ঠত্ব পাবার গৌরব একান্তই মির্জা ফখরুল সাহেবের প্রাপ্য।

অতীতে মির্জা সাহেব এমনও দাবি করেছেন যে তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ তার পিতা এবং পরিবারের প্রমাণিত তথ্য বলছে পুরো পরিবারটিই ছিল পাকিস্তানপন্থী, আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। ৭১-এ তার পিতার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কথা বহুলভাবে প্রচারিত হওয়ার পর অবশ্য তিনি সে দাবি বন্ধ করে দিয়েছেন।

তার আর দুটি উদ্ভট দাবি হলো এই যে খালেদা জিয়া দেশের প্রথম মহিলা মুক্তিযোদ্ধা এবং তারেক জিয়া ছিল বালক মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস কাল খালেদা জিয়া যে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানি সেনা অধ্যক্ষদের, বিশেষ করে সে সময়ের ব্রিগেডিয়ার (পরে মেজর জেনারেল) জানজুয়ার বিশেষভাবে মর্যাদাপ্রাপ্ত অতিথি ছিলেন সে কথা জানেন না এমন লোক কমই আছেন। জেনারেল জানজুয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্য খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রোটোকলের নিয়ম ভঙ্গ করে জানজুয়ার মৃত্যুতে শোক বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং পরে তার কবর জেয়ারত করেছিলেন, সে কথা তো রাষ্ট্রীয় রেকর্ডেই রয়েছে। এসব ব্যাপারে অসত্য, বানোয়াট কথা বলে মির্জা সাহেব এমনকি তার দলের মানুষের কাছেও হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছেন। প্রাক্তন সোভিয়েত ঔপন্যাসিক মিখাইল বুলগাকভ বলেছেন, “মিথ্যাবাদীর জিব সত্যকে ঢাকতে পারলেও তার চোখ পারে না।” মির্জা সাহেব যখন এসব অবান্তর এবং উদ্ভট উক্তিগুলো প্রকাশ করতেন তখন কিন্তু তার চোখ দেখেই বোঝা যেত তিনি কি ধরনের মিথ্যা বলছেন।

মিথ্যাচারীকে যে কেউ বিশ্বাস করে না তার নজির অফুরন্ত। স্কুলে পড়াশোনাকালে একটি গল্প পড়েছিলাম, যেটি এমন ছিল যে এক লোক অকারণে বলে বেড়াতো বাঘ এসেছে। এরপর যখন সত্যিই বাঘ এসে তাকে ভক্ষণ করলো, তখন আর কেউ তার সাহায্যে আসেনি। মির্জা সাহেবেরও আজ একই অবস্থা। তার বিশ্বাসযোগ্যতা এখন শূন্যের কোঠায়। ইরাকে মারণাস্ত্রের মজুত রয়েছে, জেনে শুনে এমন মিথ্যা বলায়, প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এন্থনি ব্লেয়ার দেশবাসীর দ্বারা ঘৃণিত এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। মিথ্যা বলার কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পও গদি হারিয়েছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা থমাস জেফারসন বলেছেন– “যে ব্যক্তি একবার মিথ্যা বলে, দ্বিতীয়বার মিথ্যা বলতে তার অসুবিধা হয় না।”

বিশ্বনন্দিত দার্শনিক জন রাসকিন বলেছেন, “মিথ্যার ভিত্তি হচ্ছে প্রতারণার অভিপ্রায়।” মার্ক টুয়াইন, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহিত্য জগতের স্রষ্টা বলা হয়, যার অমর উপন্যাস “অ্যাডভেঞ্চার অব হেকেলবারিফিন” ইংরেজি সাহিত্যে বিপ্লব ঘটিয়েছিল, বলেছেন, “সত্য বললে কিছু মনে রাখতে হয় না।”

প্রথম মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন বলেছেন, মিথ্যা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেয়ে কোনও ব্যাখ্যা না দেওয়াই শ্রেয়। বিশ্ববরেণ্য রাশিয়ান ঔপন্যাসিক লিউ টলস্টয় বলেছেন, সবকিছুই মিথ্যার চেয়ে ভালো। একটি সংস্কৃত শ্লোক হলো– “সত্যম, শিবম, সুন্দরম”, অর্থাৎ যাহা সত্য তাহাই ভগবান, তাহাই সুন্দর। মহাত্মা গান্ধী তার আত্মজীবনী পুস্তকের নাম দিয়েছিলেন “মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ দ্য ট্রুথ”, আর সেই পুস্তকে তিনি মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। কলকাতার মাদার তেরেসা বহু ভাষণে মিথ্যা বর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।

আব্রাহাম লিংকন বলেছেন, “তুমি সবসময় কিছু লোককে মিথ্যা কথা বলে বোকা বানাতে পারো, কিন্তু সবসময় সকলকে বোকা বানাতে পারবে না।” লিংকন আরও বলেছেন, “একজন সফল মিথ্যাবাদী হওয়ার মতো স্মৃতিশক্তি কোনও মানুষেরই নেই।” মির্জা সাহেব আব্রাহাম লিংকনের এই উক্তি পড়েছেন কিনা জানি না, পড়ে থাকুন বা নাই থাকুন, এটি যে বিশেষ করে একজন রাজনীতিবিদের জন্য অবশ্যই অনুসরণীয়, সে কথা রাজনীতির সাথে জড়িত সকলেরই উপলব্ধি করা উচিত। যারা এই অমূল্য বাণী অনুসরণ করতে ব্যর্থ হন, জনগণের ঘৃণা দিয়েই তাদের রাজনৈতিক জীবনের যবনিকাপাত ঘটে।

লেখক: আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর