মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৭:০৩ পূর্বাহ্ন

সত্য কখনও চাপা থাকে না

আবদুল মান্নান / ১৬ বার
আপডেট : সোমবার, ৫ জুন, ২০২৩

বিয়াল্লিশ-চল্লিশ বছর আগে ১৯৮১ সালের ৩০ মে বাংলাদেশের প্রথম সেনা শাসক বিএনপি নামক দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এক সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নিহত হন। যে কোনও অনভিপ্রেত মৃত্যুই দুঃখজনক, জিয়ারটাও তাই। একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার গুণমুগ্ধরা তার স্মৃতি তর্পন করে অনেক ভালো ভালো কথা বলবেন তাতেও কোনও আপত্তি নেই। এই সব মানুষদের মধ্যে নিজের অনুসারিরা থাকবেন তাও প্রত্যাশিত। তবে সেই অনুসারিরা যদি দেশের একটি বড় মাপের প্রগতিশীল ঝাণ্ডাধারি মিডিয়াকে বেশ সাচ্ছন্দের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারেন তাহলে তো কথা উঠবেই। মিডিয়াটি শুধু প্রগতিশীলের দাবিদারই নয় তারা বেশ গর্ব করে বলে তারা সব সময় নিরপেক্ষ ও সত্য প্রকাশের জন্য অঙ্গিকারবদ্ধ। যে মিডিয়ার কথা বলছি তা একটি প্রিন্ট মিডিয়া; যার পাঠক অসংখ্য। তাদের রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে শেখ হাসিনা ছাড়া যে কেউ দেশ শাসন করুক তাতে তাদের কোনও আপত্তি নেই।

এক এগারোর পর তারা তাদের এই মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেশ প্রচার চালিয়েছে। এতদিনেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কোনও হেরফের হয়নি।

‘সৈনিক জিয়া’ আর ‘রাজনীতির জিয়া’ কেমন মানুষ ছিলেন তা নিয়ে পণ্ডিতজনেরা অনেক লেখালেখি করেছেন। কারও মতে তিনি একজন ফেরেস্তা ছিলেন আর কেউ কেউ মনে করেন তিনি বাংলাদেশে সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা চর্চা করে তারাও এমন কথা বলেন বা লেখেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে জিয়া কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। বঙ্গবন্ধুর তাঁর কর্মের ফলে বিশ্বের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। যেমন আছেন থমাস জেফারসন, নেলসন ম্যান্ডেলা বা মহাত্মা গান্ধী। বাস্তব কারণেই জিয়ার পক্ষে তা সম্ভব নয়। জিয়া তো মৃত, অনেক মানুষ জীবদ্দশায় তাদের কর্মের কারণে বিশ্বের মানুষের কাছে নিন্দিত হয়ে পড়েন। গত ২৭ তারিখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সময়ের দাপুটে  জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার তার একশতম জন্ম দিবস পালন করেছেন। যে মানুষটি একশত বছর বেঁচে থাকেন তার এমন একটি জন্মদিনে দুনিয়া জুড়ে না হোক তার দেশে অন্তত অনেক ভালোভাবে চর্চিত হতো। তার বদলে কী হলো? সেদিন বা তারও কয়েকদিন আগে হতে সারা বিশ্বে চর্চা হতে শুরু করলো কিসিঞ্জার কত বড় ‘বদমানুষ’ ছিলেন, তিনি কত কত দেশে সরকার উৎখাতের সাথে জড়িত ছিলেন, কতজন সরকার প্রধান হত্যার জন্য তিনি দায়ী আর এশিয়া, আফ্রিকা আর লাটিন আছে তাজ্জবের কথা বটে। তবে জিয়া আর কিসিঞ্জারকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে না।

যে প্রিন্ট মিডিয়ার কথা দিয়ে শুরু করেছি তার অনলাইন ভার্সনে ৩০ মে প্রকাশিত হয়েছে জিয়া কেন অমর হয়ে থাকবেন সেই প্রসঙ্গে একজন জিয়া ভক্তের লেখা। লেখক লিখেছেন জিয়া তার খাল কাটা আর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির জন্য নাকি মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন। তিনি আরও লিখেছেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জিয়া চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

ওই মিডিয়ার প্রিন্ট ভার্সনে এমন একটা ‘গুরুত্বপূর্ণ’ লেখার স্থান হয়নি। স্থান হয়েছে অন্য আর একটি লেখা যার বিষয় হচ্ছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেও তা গ্রহণযোগ্য হয়নি কারণ তাতে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি।

প্রয়াত জিয়াকে খাটো না করেও কিছু সত্য কথাতো বলাই  যায়। জিয়া ১৯৭১ সালের ২৫/২৬ তারিখ রাত পর্যন্ত পাকিস্তান সেনা বাহিনীর একজন অনুগত কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বাঙালি নিধনের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজে আনা অস্ত্রশস্ত্র খালাসের জন্য বেশ তৎপর ছিলেন। এরই মধ্যে ইপিআর-এ দায়িত্ব পালনরত ক্যাপ্টেন রফিক (পরবর্তীকালে মেজর রফিক, বীর উত্তম) পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে চট্টগ্রামের রেলওয়ে পাহাড়ের ওপর অবস্থান নিয়েছেন। জিয়া রাত এগারোটার কিছু পর চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে বাঙালিদের দেওয়া ব্যারিকেড সরাতে ব্যস্ত। এমন সময় লে. অলি আহম্মদ (পরবর্তীকালে কর্নেল, বীর বিক্রম) এসে জিয়াকে খবর দেন ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে সুতরাং তিনি যেন ফিরে আসেন। জিয়া ষোলশহরে অবস্থানরত তার ইউনিট ৮ম ইস্ট বেঙ্গলে ফিরে আসেন। এসে তিনি তার কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়াকে গ্রেফতার করে নিজে বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে বের হয়ে পড়েন এবং কালুর ঘাট সেতু পার হয়ে ফটিকছড়ির করেলডেঙ্গা পাহাড় পার হয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। জানজুয়া পরবর্তীকালে পাকিস্তানের সেনা প্রধান হয়েছিলেন। এসব তথ্য ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

রফিকুল ইসলামের (বীর উত্তম) বই ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ এই সব কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত আছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দুপুর বেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ  হান্নান চট্টগ্রাম বেতারের কালুর ঘাট কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পড়ে শোনান। পরদিন, ২৭ তারিখ জিয়াকে করেলডেঙ্গা পাহাড় হতে অনেকটা জোর পূর্বক ধরে এনে বেতার হতে এই ঘোষণা পাঠ করান আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সারের নেতৃত্বে কয়েকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এই সব তথ্য আছে একাত্তরের শব্দ সৈনিক বেলাল মোহাম্মদের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গ্রন্থে।

জিয়া প্রথমে নিজের পক্ষে এই ঘোষণা দেন। এর পরপরই চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে খান চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতাদের ফোন করে জানতে চান কে এই জিয়া? তিনি এভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার কে? কে দিলো এই অধিকার? এমন একটা ঘোষণা দেওয়ার একমাত্র অধিকার আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। এর কিছু পর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পুনরায় এই ঘোষণা পাঠ করেন। জিয়ার পুরো ঘোষণাই ছিল ইংরেজিতে। জিয়া বাংলা পড়তে পারতেন না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু জিয়ার জন্য সেনা বাহিনীতে একটি উপ-সেনা প্রধানের পদ সৃষ্টি করেন। ওই পদে তিনি প্রথম ও শেষ পদায়িত ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৮২ দিনের মাথায় জিয়া খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। ‘সাক্ষী গোপাল’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিয়োগকৃত দেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের কোনও আদালতে বিচার করা যাবে না মর্মে মোশতাক কর্তৃক জারিকৃত অধ্যাদেশ আইনটি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে পরবর্তীকালে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে এক ন্যাক্কারজনক অধ্যায়ের সূচনা করেন জিয়া। এরপর বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারি সকল খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশের মিশনে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন।

জিয়া বহুদলীয় রাজনীতি প্রবর্তনের নামে দেশে স্বাধীনতা বিরোধী সকল রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। দেশের সংবিধানের চার মূলনীতির ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধান থেকে বাতিল করে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময় অর্জিত একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করেন।

‘বঙ্গবন্ধ’ বা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া নিষিদ্ধ হয় জিয়ার আমলে। ১৯৭৭ সালে জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েমকে বন্দুকের নলের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রপতির পদটি দখল করেন। সাথে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনা প্রধান। বিশ্বে একই সঙ্গে রাষ্ট্রের তিনটি পদ গ্রহণ করে তিনি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন। একই বছরের ৩০ মে তিনি আরও এক নজিরবিহীন ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা করে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে তছনছ করে দেন। ১৯৭৯ সালে আর এক তামাশার সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে একাত্তরের ঘাতকদের সংসদে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেন জিয়া। সেই সংসদে শাহ আজিজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। এই শাহ আজিজ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলতে একটি দলের নেতৃত্ব দিয়ে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে। জয়পুরহাটের কসাই আবদুল আলিম জিয়ার মন্ত্রী সভায় ঠাঁই পেয়েছিলেন। একাত্তরে ঘাতকদের শিরোমনী জামায়াতের আমিরকে জিয়া বাংলাদেশে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে জামায়াতের অঘোষিত আমিরের দায়িত্ব পালন করার সুযোগ করে দেন জিয়া।

১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা সেনানিবাস ও তেজগাঁও বিমান বন্দরে সেনা ও বিমান বাহিনীর কিছু সদস্য এক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে যা জিয়ার অনুগত সেনারা তা ব্যর্থ করে দেয়। এরপর শুরু হয় সেনা ও বিমান বাহিনীতে এক ভয়াবহ গণহত্যা। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত করে বিচারের নামে গোপন ট্রাইব্যুনাল বসিয়ে প্রাপ্ত হিসাব মতে প্রায় এগারশত সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যকে জিয়া নির্মমভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। আরও মর্মান্তিক হচ্ছে এই হতভাগ্যদের লাশগুলো পর্যন্ত তাদের পরিবারবর্গ ফেরত পায়নি। তাদের কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে তাও জানানো হয়নি। যাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ ছিল না। এসব তথ্য মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নথিতে লিপিবদ্ধ আছে। সেই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সে সময়ের বিশ্বের অনেক গণমাধ্যমে সংবাদ হিসেবে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছিল।

আজকের এই রচনা জিয়ার আমলে তার কূকীর্তির ফিরিস্তি দেওয়ার জন্য নয় বরং জিয়াকে কেন এই দেশের সচেতন মানুষ মনে রাখবে তা তুলে ধরা। জিয়াকে মানুষ তার খাল কাটার বা বৃক্ষ রোপণের জন্য মনে রাখবে না। মনে রাখবে এই দেশের রাজনীতিকে বিষাক্ত করার জন্য, তার অপকর্মের জন্য যেভাবে মানুষ এক সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের ডাকসাইটে পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে তাঁর শততম জন্মদিনে মনে রেখেছে। সত্য কখনও চাপা থাকে না।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর