বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৪:০৫ পূর্বাহ্ন

মহিমান্বিত মার্চ

নাজনীন বেগম / ২৮ বার
আপডেট : বুধবার, ১ মার্চ, ২০২৩

মার্চ মানেই বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের এক অদম্য যাত্রাপথ। ৭ মার্চের ভাষণ থেকে শুরু করে ১৭ মার্চ জাতির জনকের শুভ জন্মদিন ছাড়াও ২৫ মার্চের রক্তাক্ত কালরাত্রি পরবর্তীতে ২৬ মার্চ স্বাধীনতার অভাবনীয় মঙ্গল সূচনাÑ সব মিলিয়ে যেন এক ঐতিহ্য আর লড়াকু পরিক্রমার অনন্ত প্রেক্ষাপট। মুক্তিযুদ্ধের রক্তিম অভিযাত্রার মাহেন্দ্রক্ষণ তো বটেই। এমন মহিমান্বিত মাসটিকে স্মরণে বরণে সিক্ত করাও পরম দায়বদ্ধতা। যে সংগ্রামী অভিযাত্রায় মাসটিকে আনন্দে, আবেগে আর উৎসবের স্রোতে ভাসিয়ে নেওয়াও এক গৌরবোজ্জ্বল আখ্যান।

পাশাপাশি বেদনার চরম গ্লানিও ঐতিহাসিক মার্চ মাসকে সকরুণ বিষাদে ম্লান করে দেয়। প্রতিবারই মাসটির শুভ পদধ্বনি আপামর বাঙালিকে মাতিয়ে দেয়। আবার রক্ত নিঃসৃত কালরাত্রি ২৫ মার্চ যে অবর্ণনীয় হত্যাযজ্ঞের নির্মম ইতিবৃত্ত, তাও বিশ^ ইতিহাসের এক বিক্ষুব্ধ দলিল। তখন ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হতে সময় লাগেনি। বিমর্ষ ও লোমহর্ষক কালরাত্রি আজও সভ্যতা সূর্যকে অন্ধকারে ঢেকে দেয়। পাশাপাশি ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণায় লাখো বাঙালি যেন মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্মৃতিতে দারুণভাবে উজ্জীবিত হয়।

বিজয়গাথার অভাবনীয় স্বর্ণঅধ্যায়ও মার্চ মাসকে নানামাত্রিকে উদ্বেলিত করে। ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ও অগ্নিঝরা ভাষণ যা বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক ও উপস্থিত উপলব্ধিতে জন¯্রােতের জোয়ারে ভেসে যায়। বর্তমানে যা ইউনেস্কোর বিশ^ দলিলে মহাসাড়ম্বরে উজ্জ্বল হয়ে আছে ঐতিহ্যিক বাগ্মিতার পুরস্কার হিসেবে। ধারণারও অতীত শত্রু পরিবেষ্টিত নির্মম শৃঙ্খলের চৌহদ্দিতে যে অবিরাম সাবলীল কথামালা নিঃসৃত হয়েছিল, তা যেন এক নান্দনিক শৌর্যের মহাকাব্যিক ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।

দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচন আর প্রিয় জনগোষ্ঠীর প্রতি অকৃত্রিম দায়বদ্ধতায় যে অনলবর্ষী বক্তৃতা বঙ্গবন্ধুর সুউচ্চ, ঋজু কণ্ঠস্বর থেকে নিঃসৃত হয়, তাকে যে কতভাবে শৈল্পিক দ্যোতনায় বর্ণিত করা যায়Ñ সেও যেন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সংগ্রামী যাত্রাপথ। যা শুধু আপামর বাঙালি নয়, বরং বিশ^ব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের জয়যাত্রার অসাধারণ সোপান। শুধু শত্রুপক্ষকে নাজেহাল করা নয়, বরং আপামর বাঙালির আপন শৌর্য আর অন্তর্নিহিত বোধে জাগিয়ে তোলাও কম সাফল্যের বিষয় ছিল না। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো যে শক্তিময়তায় জনস্রোতকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন, সেটার মাহাত্ম্যে সারা বাংলাদেশ যেন মুক্তির নেশায় তাড়িত হয়।

অদম্য বাঙালির যথার্থ অবয়বে যে চিরস্থায়ী শক্তি গেঁথে যায়, সেটাই স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলমন্ত্র। পরের ইতিহাস একতাবদ্ধ বীর বাঙালির মরণপণ সশস্ত্র সংগ্রামী অভিযাত্রার রক্তাক্ত পরিক্রমা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের হরেক ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জির পালাক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটি যেন বিনি সুতোর মালার মতো অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
বিপরীতে রক্ত¯œাত ভয়াল মার্চ যে মাত্রায় স্বাধীনতার রক্তিম আভাকে ঘোর অমানিশার অন্ধকারে ঢেকে দেওয়ার অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখে, সেটাও জাতির জন্য শুভ আর মঙ্গল হয়নি। ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু আর স্বদেশের মাটিতে থাকতে পারলেন না। বন্দি হয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়াও এক অবধারিত দুর্যোগের ঘনঘটা। নয় মাসের রক্তাক্ত প্লাবনে বাংলার মাটি শুধু যে রঞ্জিত হয়ে দিশেহারা অবস্থায় পৌঁছায়, তা নয়- জাতির জনক পাকিস্তানে কিভাবে ও কেমন আছেন তা জানারও কোনো অবকাশ থাকেনি।
ফেব্রুয়ারির ভাষার মাস আর মার্চের স্বাধীনতার সময়গুলো যেন ঐতিহাসিক মেলবন্ধনের সমৃদ্ধ প্রেক্ষাপট। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী পটভূমিকায় ’৬০ এর দশকের বৈপ্লবিক আবেদন নিবেদনের যে ঐতিহ্যিক ধারা সূচিত হয়, সেখান থেকে ’৭০-এর নির্বাচন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আর ’৭১ সেই যাত্রাপথেরই অবিস্মরণীয় অভিগমন। আর এভাবেই ১৯৭১ এ অনন্য প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা সংগ্রামের যে ভিত্তি তৈরি হয়, সেখান থেকেই বিরতিহীন যাত্রাপথের ভাবসম্পদে মার্চ তার লড়াকু পরিক্রমায় মুক্তিযুদ্ধকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জীবিত করাও বীর বাঙালির সচেতন দায়বদ্ধতা।

আত্মপরিচয় আর অস্তিত্ব রক্ষার যুগান্তকারী মাইলফলক এই রক্তস্রোত মার্চ মাস। সামরিক শাসনের দুঃশাসন আর একাধিপত্যের বিরুদ্ধে বাঙালিরা এক ও অবিচ্ছিন্ন আন্দোলনে নিজেদের চেতনাকে সুসংহত করে এগিয়ে আসতে দ্বিধা করেনি। ভাষা ও ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি সুরক্ষার দাবিতে সারাবাংলা যখন উত্তাল, সেই দুঃসময়ে যে অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দেয়, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে বাঙালি রাস্তায় নেমে আসে। বঙ্গবন্ধুও উন্নত মস্তকে বীরদর্পে সসম্মানে সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে স্বাধীনতার বীজ বপন করতে ক্রমাগত সামনের দিকে ছুটে গেছেন।

জীবনের সুবর্ণ সময়গুলো কেটেছে তার সাধারণ মানুষের অন্দোলন আর লড়াইয়ে পাশে থেকে। আর কারা অন্তরীণে দুঃসহ সময় পার করার তিক্ত অভিজ্ঞতায়। কত কণ্টকাকীর্ণ যাত্রাপথ দুর্দমনীয় মনোবলে অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রাণ সংশয়ের দুর্ভোগও কখনো পিছু ছাড়েনি। কারাগারে অনশনব্রত পালন করার চিত্রও উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলনের নানামাত্রিক স্রোতে অবগাহন করতে গিয়ে। কিন্তু কখনো আপোসকামিতার ধারও ধারেননি। দেশ ও মানুষের জন্য

যা মঙ্গল মনে হতো, শত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সেটাই অপ্রতিরোধ্য শক্তিময়তায় করে যেতেন। মাথা উঁচু করে ঋজু চিত্তে স্বকীয় অসাধারণ ব্যক্তিত্বে কখনো আঁচড় বসতে দিতেন না। বহু কষ্টে ও লড়াকু পথযাত্রায় অর্জিত সম্মান আর মর্যাদাটুকু কখনো ক্ষুণ্ণ হতে দেননি।
ভাষা আন্দোলন ও মহিমান্বিত মার্চকে আলোকপাতে সাবলীল ও ন্যায্যতায় যাই উঠে আসুক না কেন, সবটাই যেন জাতির জনককে ঘিরে আবর্তিত এক সূত্রে গ্রথিত। বাংলার এই মহানায়ককে পাকিস্তানে আটক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাতের অন্ধকারে। দ্যুতির ঝলকানিতে উজ্জ্বল এমন ব্যক্তিত্বকে দিনের আলোয় লোকচক্ষুর সম্মুখে কিছু করা যাবে তা কোনো শত্রুও ভাবতে পারত না। ৩০ লাখ শহীদ বাঙালির রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে যে স্বাধীনতা সূর্যের অভ্যুদয়, তাঁকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিতে অসংখ্য মানুষের নিঃশর্ত আত্মদানে লাল সবুজের পতাকা অঙ্কিত সেটা বাঙালি জাতির গৌরব মাখানো ইতিহাস।

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বাধীন মাতৃভূমিতে ফিরে এলেও জবরদখলের চরম নজির বঙ্গবন্ধুর খুনিরা স্বাধীন দেশে তাঁকে বেশিদিন বাঁচতেও দেয়নি। কিন্তু নতুন ও আধুনিক প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে তাঁর যোগ্যতম আসনে বসিয়ে দিয়ে অন্যায় অবিচারের তীব্র প্রতিশোধ যেন নিল। পিতার মৃত্যুর পর পরবাসী শেখ হাসিনাও ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে শুধু পিতৃহত্যার বিচার নয়, লাল সবুজের লুণ্ঠিত পতাকাকেও স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিলেন পিতার মতোই। বঙ্গবন্ধু তনয়া বলেই হয়ত বা পারলেন।

এখনো জাতিকে এগিয়ে নিচ্ছেন উন্নয়নের মহাযজ্ঞে আর প্রবৃদ্ধির অনন্য শিখরে। বাংলার স্বর্ণালি ইতিহাসের অংশীদারিত্বে যাঁর যাপিত জীবন মহীয়ান ও গরিয়ান হয়েছে, তাঁকে চিরতরে মুছে ফেলার কথা আসলে ভাবাই যায় না। ইতিহাস বিকৃতির জবাব ইতিহাসই দিতে কসুর করেনি। ততদিনে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি লাল সবুজের পতাকাকে ধুলায় লুণ্ঠিত করেছে। বিরোধী প্রতিপক্ষ স্বাধীনতার সূর্যকে অস্তমিত হওয়ার পর্যায়ে দাঁড় করতে কিছুমাত্র ভাবেনি। তেমন দুঃসহ কালো মেঘের আঁধার ক্রমান্বয়ে সরে যেতে সময় লাগলেও কোনো এক পর্যায়ে লাল সূর্যের নব অভ্যুত্থান বাঙালি জাতির পুনর্জাগরণের নবতর অধ্যায়।

সেই ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর প্রথম শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজেদের আসন তৈরি করে নেয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি সরকারের ক্ষমতায় আসা অন্যরকম যাত্রাপথ। সংগত কারণে ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল শুরু হলে তা মূলত ২ বছর স্থায়ী হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার পালাবদলে নির্বাচিত হলে গত ১৪ বছর টানা শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লাগাতার কর্মপরিকল্পনায় অবকাঠামো উন্নয়নে যে অবিমিশ্র জোয়ার, তা নতুন ও আধুনিক বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সঙ্গে অবিমিশ্র করে দেয়। যার ফলে স্মার্ট বাংলাদেশ তার অভীষ্ট যাত্রাপথে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সত্যিই দৃষ্টিনন্দন।

উন্নয়ন মডেলের নানামাত্রিক কর্ম প্রকল্পে বাংলাদেশের নজরকাড়া দৃশ্যপট আজ বিশ্ব সভায়ও আলোচিত হচ্ছে। এমন সব সমৃদ্ধির জোয়ারে ভাসমান বাংলাদেশ আবারও নতুন বছরের মহিমান্বিত মার্চকে স্বাগত জানাতে সাজ সাজ রবে মেতে উঠেছে। ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নি¯œানে সূচি হোক ধরা’- রবীন্দ্রনাথের এমন সমৃদ্ধ বাণীতে আমরা ২০২৩ সালে নব সম্ভাবনার প্রত্যাশায়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর