রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৩:৫২ অপরাহ্ন

যেভাবে আটকে রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার

উদিসা ইসলাম / ৮ বার
আপডেট : রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২৩

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। দেশের সেনাবাহিনীতে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা ও জওয়ান এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়। পরবর্তীকালে নানা কৌশলে এই হত্যার বিচার আটকে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এমনকি খুনিদের পুরস্কৃত করা, দেশ থেকে পালাতে সাহায্য করার মতো ঘটনাগুলোও ঘটেছে। গবেষকরা বলছেন, যারা খুনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিল, তাদের পরিকল্পনাতেই ছিল— বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শকে সমূলে ধ্বংস করবে। যেনো আর কোনোদিন বিচারের নামে বা এই হত্যাকাণ্ডের নামে এই নাম উচ্চারিত না হয়, তার জন্য সব ধরনের কৌশল নেওয়া হয়েছিল।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলতুন নেছা মুজিব এবং তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান মুজিবের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা৷ সেদিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে তাঁর দুই পুত্রবধূ, ছোটভাই, বোনের ছেলেমেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং তাঁর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ নিহত হন ২৬ জন।

জারি হলো ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে তারই মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে একটি অন্তরবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করতে একটি অধ্যাদেশ (রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নম্বর-৫০) জারি করে। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩ এর অধীন প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মোশতাক এই অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশটিতে দুটি অংশ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে— ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনও আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনও আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে— রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবে, তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনও আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনও আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইনে পরিণত
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সময়ে অধ্যাদেশটি আইন হিসেবে পাস করা হয়। যা ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, বেনজির ভুট্টোসহ যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে— এর কোনোটার জন্যই ইনডেমনিটি আইন জারি করা হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি করা হয়েছিল। সংবিধান মানুষের অধিকারের রক্ষাকবচ। পৃথিবীর কোনও সংবিধানে লেখা নেই যে, খুনিদের বিচার করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। কেবল বঙ্গবন্ধুর বিচার না, তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজও স্থগিত করে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা হয়
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে কোথাও বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শের কথা উচ্চারিত হতে দেখা যায়নি। বরং খুনিদের চেষ্টা ছিল, বঙ্গবন্ধুর শাসনামল কতটা খারাপ ছিল তার প্রমাণাদি প্রচার করা এবং দেশে-বিদেশে নানা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো। ২০২১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পঁচাত্তরের পর তাঁর (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) স্বাধীনতার ঘোষণা, রেসকোর্সের ঐতিহাসিক বক্তব্য এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। তাঁর ভাষণ প্রচারে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এ দেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সত্যকে কখনও মুছে ফেলা যায় না, সেটা আবার প্রমাণিত হয়েছে।

আবারও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন এরশাদ
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা হত্যার কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়াতো। এরশাদ ক্ষমতায় আসীন হলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল না করে আবার নিজের সুবিধার জন্য দ্বিতীয়বার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। যা ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীতে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারি করা সব ধরনের সামরিক আইন, অধ্যাদেশ, বিধি নির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। মেজর জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর সেই আত্মস্বীকৃত খুনি দলের বেশ কজন দেশে ফিরে আসেন। তারা তৎকালীন এরশাদ সরকারের প্রশ্রয়ে ‘ফ্রিডম পার্টি’ নামে একটা রাজনৈতিক দল গঠনকরে দেশে রাজনীতি শুরু করেন।

বিএনপি জোট সরকারের জট
হাইকোর্টের রায়ের পর কারাগারে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি লেফটেন্যান্ট কর্নেল অব. সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর অব. বজলুল হুদা, লে. কর্নেল অব. মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করেন। তবে চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে নানা অজুহাতে সেই আপিল নিষ্পত্তি বিলম্বিত করা হয়। হাইকোর্টের রায়ের দীর্ঘ ৬ বছর পর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিতে আসা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরেক খুনি লে. কর্নেল অব. এ কে এম মহিউদ্দিনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনে। দেশে আসার পর এ কে এম মহিউদ্দিনও আপিল করেন। সেই সময়ে ৫ জনের আপিলই শুনানির জন্য গ্রহণ করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শুনানিতে ফের গতি পায়।

২১ বছর পর মামলা
শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকার সময় তাঁর রিসেপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ধানমন্ডি থানায় ২৪ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন৷ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। তদন্তে খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ আরও কয়েকজনের নাম এলেও মারা যাওয়ায় বিচার কার্যক্রম থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। একই বছরের ১২ মার্চ ৬ আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। বিচারক ১৮ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। বাকিদের খালাসের রায় দেন। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিলে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিভক্ত রায় দেয়। বিভক্ত রায় হওয়ায় নিয়মানুযায়ী মামলাটি তৃতীয় বেঞ্চে পাঠান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি। তৃতীয় বেঞ্চের রায়ে ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামি— সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব.) নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন খান, লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ ও লে. কর্নেল আজিজ পাশা (অব.)।

চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়
২০০১ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে সেই বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যেখানে হাইকোর্ট থেকে রায় চলে এসেছে, মামলার আনুষ্ঠানিকতাও আর খুব বেশি বাকি নেই, সেখানে দীর্ঘ ৬ বছর আপিল বিভাগের সাত জন বিচারক মামলার শুনানিতে বিব্রতবোধ করেন। সে সময় মামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বলেন, ‘একজন বিচারপতি যখন শপথ নেন তখন তিনি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হয়ে দায়িত্ব পালন করবেন বলে ঘোষণা করেন। অনেক সময় ঘনিষ্ঠ কারোর মামলার ক্ষেত্রে তারা বিব্রত হতে পারেন,কিন্তু সেটা ব্যাখ্যা করতে হয়। বঙ্গবন্ধুর মামলায় এরকম পরিস্থিতি ছিল না। একের পর এক বিব্রত হওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক কারণে তারা করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে তারা শপথ ভঙ্গ করেছেন। বিব্রত হওয়ার মতো ঘটনা যদি না হতো, তাহলে মামলাটি শেষ হতে এত সময় লাগতো না। আমি সে সময় কাছ থেকে দেখেছি। তাদের পদক্ষেপ জাতির জন্য বিব্রতকর। ১১ জন বিচারপতির বিব্রত হওয়ার বিষয়টি কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করে দেয়। এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বজলুল হুদা, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড ও মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হয়।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর