রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০১:০৪ পূর্বাহ্ন

গণবাহিনী

মো. আনোয়ার হোসেন / ১৫৮ বার
আপডেট : শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০২২

অনেক দিন লিখি না। লেখার জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ সময় পেরিয়ে গেলো, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একশত বছর। সমসাময়িক নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। এমনটা নয় যে লিখতে বসিনি। লেখা হয়ে ওঠেনি। আগে আমি যে খুব বেশি কিছু লিখেছি তাও নয়, কিন্তু মনে করে দেখলাম ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অমর ভাষণের ওপর স্মারক বক্তৃতা ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণ’ লিখেছি। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ যখনই সংকটে পড়েছে, আমি লিখেছি নানা বিষয়ে, বিরাগভাজন হয়েছি নানা মহলের, কারাগারেও যেতে হয়েছে। আমি লেখা বন্ধ করিনি। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বড় ভালোবাসি। ১৯৬৭ সালে ভর্তি হওয়ার পর ২০১৭ সালে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছি জীবনের পঞ্চাশ বছর। ১৯৭৬ সালে শিক্ষকতা জীবনের এক বছরের মাথায় রিমান্ড ও কারাগারে যেতে হয়েছে। কারা অভ্যন্তরে গোপন যে সামরিক আইন মামলায় কর্নেল আবু তাহের বীর-উত্তমের ফাঁসি হয়, সেই একই মামলায় আমার ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ২০০৭ সালে সেনাচালিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অন্যায়ভাবে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার গ্রেফতারের প্রতিবাদ ও জরুরি আইন তুলে নিয়ে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানানো ও পরে সেনাবাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত বিপন্ন ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর কারণে দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে রিমান্ড ও কারাগারে যেতে হয়। আমি লিখেছি। কারাগারে আমার লেখা ‘কাঠগড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়–রিমান্ড ও কারাগারের দিনলিপি’ ও ‘সিএমএম কোর্টে জবানবন্দি’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালের বইমেলায়। ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল বই দুটি। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আন্দোলনে তা সাহস জুগিয়েছিল।

পুত্র-কন্যার তাগিদে গত ৮ জুলাই ইউরোপে এসেছি স্ত্রীর সঙ্গে। তারাই টিকিট পাঠিয়েছে তাদের সাথে কিছুদিন কাটাতে। তাদের ধারণা, প্রবাসে নিভৃতে এই বিশ্রাম উপকারী হবে আমার লেখা আবার শুরু করতে। কী দিয়ে লেখা শুরু করবো? সামনে ২১ জুলাই। ১৯৭৬ সালের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার যুদ্ধাহত কর্নেল আবু তাহের বীর-উত্তমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। অনেক বছর পরে ২০১১ সালে একটি রিট আবেদনে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ তাদের ঐতিহাসিক রায়ে তাহেরের ফাঁসিকে একটি ঠান্ডামাথার খুন হিসেবে উল্লেখ করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাহেরের রণকৌশল, নানা যুদ্ধে তার বীরত্বগাথা, সদ্য শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অনুরূপ বাহিনীর স্থলে স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রতিরক্ষা বাহিনী ও রাষ্ট্র প্রশাসন গড়ে তোলার পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী কুমিল্লা সেনানিবাসে তার বাস্তব অনুশীলন, এসব বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মতানৈক্য, ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবাদী ও বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে তাঁর যোগদান, সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগকালে বঙ্গবন্ধুকে লেখা তাঁর পত্রে পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামো, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে দানাবাঁধা প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আগাম সতর্কবাণী, যা অমোঘ সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডে; পরিবার পরিজনসহ জাতির জনকের এই হত্যা বস্তুতপক্ষে ছিল মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জনকে হত্যা করা। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল স্তরে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি চরদের দখলে চলে যাওয়া কাণ্ডারিহীন বাংলাদেশটিকে উদ্ধারের এক মরিয়া প্রচেষ্টায় সিপাহী অভ্যুত্থানে তাহেরের নেতৃত্বদান; তার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির দখলে বাংলাদেশের চলে যাওয়া – ইত্যাদি বিষয়ে আমি লিখেছি।

ভেবে দেখলাম বাংলাদেশ প্রশ্নে রাষ্ট্র-বিপ্লব বিষয়ে তাহেরের রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম দিক ছিল পরাজিত পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী স্তম্ভ অনুৎপাদনশীল ব্যারাক আর্মির স্থলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক গণবাহিনী গড়ে তোলা এবং অপর স্তম্ভ গণবিচ্ছিন্ন আমলাতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক প্রশাসনের স্থলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে এমন শক্তির দ্বারা স্বাধীন দেশের উপযোগী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন– আমাদের সংবিধানের মূল চার নীতি ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ বাস্তবায়ন করা। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে তাহেরের এমন স্বপ্ন কি নতুন করে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব? অথবা আদৌ কি তার কোনও প্রয়োজন আছে? এসব বিবেচনার আগে পাঠকদের জানিয়ে রাখি, আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘অপ্রকাশিত তাহের: কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)-এর অপ্রকাশিত রচনা ও পত্রাবলী’– এই নামের গ্রন্থে তাহের রচিত ‘গণবাহিনী (পিপলস আর্মি) প্রবন্ধটি সম্পর্কে। প্রবন্ধটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি নিচে উল্লেখ করবো। ড. সানজীব হোসেনের সম্পাদনায় এই পুস্তকে তাহেরের ওইসব প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা আগে প্রকাশিত হয়নি।

শুরুতেই তাহের বলেন: “একটি সুশৃঙ্খল, সুশিক্ষিত সামরিক বাহিনী, স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীন জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা, জাতীয় শৃঙ্খলা ও মর্যাদা বোধের পরিচায়ক। ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে, একটি স্বাধীন দেশে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর অনুপস্থিতি অকল্পনীয়। নীতিবিদরা সামরিক বাহিনীর জন্য ব্যয়কে নিছক অযথা ব্যয় বলে মনে করেন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মাধ্যমে পৃথিবীর সার্বিক শান্তি ও প্রগতি কামনা করেন। নিঃসন্দেহে তাদের এই কামনা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এই মানবিক অগ্রগতি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ এবং বর্তমানে একটি ছোট দেশের পক্ষে অস্ত্রনীতি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা নিতান্তই অবাস্তব এবং সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দেওয়ার শামিল। 

সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ যদিও আয়তনে ক্ষুদ্র তথাপি ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ প্রায় চারদিক দিয়েই ভারত দ্বারা বেষ্টিত। উত্তর-পূর্বদিকে রয়েছে ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য। উত্তর-পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। পূর্বদিকে বার্মা ও দক্ষিণে বিশাল বঙ্গোপসাগর। প্রত্যেকটি সীমান্তবর্তী এলাকাকে এককভাবে বিচার করলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়।

এরপর তিনি বিশদে ব্যাখ্যা করেছেন একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা। তাহের সেনাবাহিনীর আকার কেমন হবে তা নিয়ে লেখেন: “ভৌগোলিক দিক দিয়ে বিচার করলে বাংলাদেশকে প্রধানত চার ভাগে ভাগ করা যায়। 

ক) ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল; ঢাকা ময়মনসিংহ ও সিলেট জেলা। 

খ) পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। 

গ) পদ্মা নদীর দক্ষিণাঞ্চল, বরিশাল, খুলনা জেলাগুলো। 

ঙ) দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম। 

এই চারটি অঞ্চল ভৌগোলিক দিক থেকে এক একটি বিশেষ অংশ এবং এই চারদিক দিয়ে বাংলাদেশ, বৈদেশিক আক্রমণ আশঙ্কা করতে পারে। কেবল প্রতিরক্ষার কথা  চিন্তা করলে এই প্রত্যেকটি অঞ্চলে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি করে শক্তিশালী ডিভিশনের প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজন একটি রিজার্ভ ডিভিশন যা কোনও একটি ডিভিশনের সাহায্যের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, প্রতিরক্ষার জন্য বাংলাদেশে পাঁচটি শক্তিশালী ডিভিশনের প্রয়োজন। এই পাঁচ ডিভিশন সৈন্যকে সাহায্যের জন্য কমপক্ষে দশ স্কোয়াড্রন বিমান বহর লাগবে। বহিঃশত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য, চট্টগ্রাম ও খুলনায়, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সজ্জিত দুটি নৌ বহর প্রয়োজন।

যদি বাংলাদেশ কোনও আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করতে চায় তবে উদ্দেশ্য অনুযায়ী প্রতিরক্ষা বাহিনী ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। ন্যূনতম ১৫ ডিভিশন সৈন্যবাহিনী গঠন করা এবং সেই অনুপাতে নৌ ও বিমান বাহিনী বৃদ্ধি করতে হবে। সাথে সাথে এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যাপক বিস্তৃতি সম্ভব। ব্যাপকভাবে সামরিক শিক্ষাপ্রাপ্ত রিজার্ভ বাহিনী সংগঠনের মাধ্যমেই তা সম্ভবপর। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সঙ্গ সঙ্গতি রেখে চিরাচরিত পদ্ধতিতে প্রয়োজন অনুযায়ী সামরিক বাহিনী সংগঠন সম্ভবপর নয়। কাজেই চিরাচরিত পদ্ধতি বাদ দিয়ে একটি নতুন পদ্ধতিতে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত না হয়ে, সত্যিকারের অগ্রগতি সাধিত হবে। প্রতিরক্ষা বাহিনী আমাদের গড়ে তুলতে হবেই। কারণ, তাতেই আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন নিহিত।

এরপর ব্যারাক আর্মি ও গণবাহিনীর তুলনামূলক পর্যালোচনা করে বাংলাদেশে গণবাহিনীর অবশ্যম্ভাবিতা নিয়ে তাহেরের ভাবনায় আমরা দেখি: “দু ধরনের সামরিক বাহিনী আমরা দেখতে পাই। ব্যারাক আর্মি ও গণবাহিনী। ব্যারাক আর্মি হচ্ছে একটি স্থায়ী সামরিক বাহিনী যা দেশের সর্বক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকাপাকিভাবে নির্দিষ্ট সেনানিবাসে অবস্থান করে। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের  সঙ্গে এই সেনাবাহিনীর বিশেষ কোন যোগাযোগ নেই। সারা বছর এরা বিভিন্ন প্রকার সামরিক শিক্ষা গ্রহণে সময় কাটায়। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বহিঃআক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হয়। দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং উন্নয়নমূলক কাজে এই সেনাবাহিনীর কোনও অবদান তো নেই-ই; বরং এই বাহিনী জনগণের ওপর একটি বিরাট বোঝা। শুধুমাত্র সামরিক শিক্ষা দ্বারাই একটি সামরিক বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারে না। যুদ্ধের চরম বিপদের মধ্যে কেবল আদর্শে অনুপ্রাণিত সেনাবাহিনী সফলতা লাভ করতে পারে। যে সেনাবাহিনী যতবেশি আদর্শে উদ্বুদ্ধ, সেই সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে ততবেশি কৃতিত্ব প্রদর্শন করে। যেমন উত্তর ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী এবং ইসরাইলের সেনাবাহিনী। আদর্শগত ভিত্তি ছাড়া সফল সেনাবাহিনী গঠন সম্ভব নয়, তা ব্যারাক আর্মি হোক বা গণবাহিনী হোক। 

একটি ব্যারাক আর্মি গঠন এবং প্রতিপালন দেশের জন্য নিঃসন্দেহে ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। ব্যারাক আর্মির আর একটি লক্ষণীয় ত্রুটি হচ্ছে, এতে শ্রেণি বিভাগ অত্যন্ত প্রকট। অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে বিশেষ কোনও সামাজিক সংশ্রব নেই। অফিসাররা এখানে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি। অনুন্নত দেশে এই ধরনের সামরিক বাহিনীর অফিসাররা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে ধনিক শ্রেণির সুবিধা চরিতার্থ করতে প্রবৃত্ত হয়, যেমন ঘটেছে, পাকিস্তানে, ইন্দোনেশিয়ায়, এবং ঘানায়। জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত দেশগুলো যখনই সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে চেয়েছে, তখনই এ ধরনের সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ লক্ষ করা গেছে। ব্যারাক আর্মি তাই বলা চলে, সুবিধাবাদী শ্রেণি ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে। জনগণের সাথে সম্পর্কহীন এই সামরিক বাহিনী, জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। 

গণবাহিনী:

গণবাহিনীর বিকাশ নতুন নয়। অনেকে মনে করেন রুশ বিপ্লবের পর সর্বপ্রথম গণবাহিনীর জন্ম হয়েছে, কিন্তু এ কথা মোটেও সত্যি নয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই গণবাহিনীর ধারণা অনেক রাষ্ট্রনায়কদের ছিল এবং সেই ভিত্তিতেই তারা সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে স্পার্টার সেনাবাহিনী, যা খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ সালে সৃষ্ট হয়েছিল। গণবাহিনীর ধারণা আসে প্রধানত একটি স্থায়ী অনুৎপাদনশীল বাহিনীর বিরাট খরচকে এড়াবার জন্য। বর্তমান যুগে বিভিন্ন দেশ গণবাহিনী গড়ে তুলে বিরাট খরচ এড়িয়েছে এবং সাথে সাথে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রগতি ও জাতীয়-শৃঙ্খলা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। এসব দেশ গণবাহিনী গড়ে তুলেছে, যখনই তারা একটি জাতীয় যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছে, এবং স্বাধীনতা অর্জন ও তা রক্ষার জন্য সমগ্র জাতিকে অংশ নিতে হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা চলে, রাশিয়ার লাল ফৌজ, চীনের গণফৌজ, ভিয়েতনামের মুক্তিফৌজ ও ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। উল্লিখিত দেশগুলোর সামরিক বাহিনী, আন্তর্জাতিক মর্যাদার অধিকারী এবং সংগে সংগে নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ অবদান রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে এই সেনাবাহিনী স্বল্প অস্ত্রের সাহায্যে বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শনে সমর্থ হয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো, এই জাতীয় সেনাবাহিনী গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। একটি গণবাহিনী গঠন করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রয়োজন হয়। 

১) নির্দিষ্টকালের জন্য গণবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগ। 

২) সঠিক রাজনীতি সম্বন্ধে সচেতনতা ও গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। 

৩) উৎপাদনশীল

৪) দেশের জনগণের সাথে নিবিড় সংযোগ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত। 

গণবাহিনী গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে, বাধ্যতামূলক নিয়োগ (conscription)। সমগ্র জাতিকে একটি বিশেষ শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্ভব, শুধুমাত্র গণবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগের মাধ্যমে। ১৮ বছর থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যেকোনও নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে গণবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে। এই দুই বছর তাঁকে এমন একটি শিক্ষা ও পদ্ধতির মধ্য দিয়ে চলতে হবে, যাতে করে সে গণবাহিনী থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও, প্রয়োজন মুহূর্তে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য অস্ত্র ধারণ করতে পারে এবং একই সাথে স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার শারীরিক ও মানসিক উপযুক্ততা লাভে সমর্থ হয়। দেশ রক্ষার ব্যাপারে প্রত্যেকটি নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে। দেশের উচিত, প্রত্যেকটি নাগরিককে সেই দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত করে তোলা। বিভিন্ন স্তরে নেতা নিয়োগের জন্য ব্যারাক আর্মিতে নির্বাচন পদ্ধতি রয়েছে। সেই বিশেষ নির্বাচন এমনভাবে করা হয়ে থাকে যাতে করে, সমাজের ধনীক শ্রেণির সন্তানরা সেই সুযোগ লাভে সমর্থ হয়। এতে করে জনগণের একটি বৃহত্তর অংশ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, যার ফলে দেশ বহু সংখ্যক যোগ্য নেতৃত্ব হারায় এবং সাথে সাথে জনগণের বৃহত্তর অংশের ওপর ধনীক শ্রেণির প্রভুত্ব কায়েম হয়। গণবাহিনীতে, যারা দুই বৎসরের জন্য সাধারণ সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছে, তাদের মধ্য থেকেই বিভিন্ন স্তরে নেতা নির্বাচিত করা হয়। বাধ্যতামূলক নিয়োগকালীন সময়ে উপযুক্ততা প্রমাণে সমর্থ হলেই নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাজেই গণবাহিনী নেতৃত্বের দিক দিয়ে ব্যারাক আমি থেকে অনেক বেশি সবল। 

ব্যারাক আর্মিতে সামগ্রিকভাবে রাজনীতি আলোচনা নিষিদ্ধ। এতে এমন একটি সামরিক বাহিনী গঠনের প্রচেষ্টা থাকে যাতে করে বাহিনীটিকে যেকোনও সময় যেকোনও কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। সেজন্য বারবার দেখা গেছে, ব্যারাক আর্মি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ক্রীড়নক হয়ে জনগণের স্বার্থের পরিপন্থি কাজে নিয়োজিত হয়েছে। অপর পক্ষে গণবাহিনীতে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ নয়। সঠিক রাজনীতি জাতীয় আদর্শ, দেশপ্রেম, জাতীয় একাত্মতাবোধ জাগ্রত করার বিশেষ প্রচেষ্টা গণবাহিনীতে গ্রহণ করা হয়। তাই গণবাহিনীতে শিক্ষাপ্রাপ্ত একজন সৈনিক, সাথে সাথে একজন দেশপ্রেমিক আদর্শ নাগরিক। 

ব্যারাক আর্মি উৎপাদনশীল নয়। এই বাহিনী জাতীয় অর্থনীতির ওপর একটি বিরাট বোঝা। অপর পক্ষে গণবাহিনী উৎপাদনশীল। নিজেদের প্রয়োজনের সর্বপ্রকার চাহিদা তারা উৎপাদন করে থাকে এবং সংগে সংগে জাতীয় উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। যে কোনও জরুরি পরিস্থিতিতে দেশের অত্যাবশ্যক বিভাগগুলো যেমন, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ, ডাক, তার ও বেতার ইত্যাদি চালিয়ে যেতে তারা সক্ষম। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে উদ্ধার কার্যে, গণবাহিনীকে ব্যাপকভাবে নিয়োগ করা সম্ভব। বিভিন্ন জাতীয় পরিকল্পনা, যথা- নিরক্ষরতা দূরীকরণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, জনস্বাস্থ্য গঠন, খেলাধুলার মান উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রসারিত করা, কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা এসব ক্ষেত্রে গণবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। 

বাংলাদেশে কি প্রকার সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে: 

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে একটি গণবাহিনী গঠন করা অত্যাবশ্যক। সশস্ত্র বিপ্লবের পর বাঙালি জাতীয় জীবনে একটি আমূল পরিবর্তন এসেছে। সেই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র শাসন ব্যবস্থায় একটি বৈপ্লবিক রদবদলের প্রয়োজন। এ কথা ভুললে চলবে না যে প্রধানত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য বাঙালি জাতি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় পারদর্শী আমলারা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়। পুরাতন সমাজকে ভেঙে নতুন সমাজ সৃষ্টি করা একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব যারা বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন, এবং যাদের দেশপ্রেম ও সততা সন্দেহের ঊর্ধ্বে। ব্রিটিশ প্রবর্তিত এবং পাকিস্তান কর্তৃক অনুসৃত ব্যারাক আমি স্বাধীন বাংলার জন্য সম্পূর্ণরূপে অনুপযোগী।  একে ভেঙে ফেলতে হবে এবং এর জায়গায় প্রগতিশীল গণবাহিনী গঠন করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচ ডিভিশনের ব্যারাক আর্মি প্রতিপালন সম্ভবপর নয়। কিন্তু সামরিক বাহিনী আমাদের রাখতেই হবে, তাই আমাদের এমন সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে যা দেশের অর্থনীতির ওপর বোঝা হবে না। এর একমাত্র উত্তর হলো গণবাহিনী।

গণবাহিনী নিয়ে তাহেরের ভাবনার কথা উল্লেখ করেছি। পঞ্চাশ বছর আগে পাঁচ ডিভিশন ব্যারাক আর্মি প্রতিপালন সম্ভব নয় বলে তাহের বলেছিলেন। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর আকার দশ ডিভিশন। ভারতের রয়েছে চল্লিশ ডিভিশন সৈন্যের সেনাবাহিনী। বিবিসির একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে ২০০৭ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সামরিক খাতে ১২৩ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে (বিবিসি ২০১৮)। একই প্রতিবেদনে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে যে মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশে সামরিক খাতে ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ। অথচ সর্বশেষ গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী পৃথিবীর ১৪২টি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে মিয়ানমার-এর অবস্থান ৩৯, যেখানে বাংলাদেশ-এর অবস্থান ৪৬।

আমরা ভেবে দেখতে পারি তাহেরের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশে একটি ছোট আকারের স্থায়ী সেনাবাহিনী এবং বিশাল আকারের গণবাহিনী গড়ে তুললে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে পারতো  কিনা।

বাংলাদেশে বৃহৎ আকারের ব্যারাক আর্মির বিপদ আমরা দেখেছি, যার আশঙ্কা তাহের তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন। গত পঞ্চাশ বছরে তিন তিনবার সেনাবাহিনী বেসামরিক সরকারকে উচ্ছেদ করে সেনা শাসন চালিয়েছে। কোনও বিচারেই তা সুফল বয়ে আনেনি। দেশে একটি সুশৃঙ্খল গণবাহিনীর উপস্থিতিতে সেনাবাহিনীর পক্ষে তা কখনও সম্ভব হতো না।

আরেকটি বিষয়, ২০১৬ সালে প্রকাশিত ডয়চে ভেলে-এ প্রকাশিত একটি লেখা জানিয়েছিল যে আমাদের সেনাবাহিনীর মালিকানায় রয়েছে অর্ধশত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। লেখায় আরও বলা হয়েছিল:

ব্যাংক,  হোটেল, খাবার, গার্মেন্টস, ইলেকট্রনিক, রিয়েল এস্টেট, পরিবহন  বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজকাল সব ধরনের ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত। আর এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো চলে আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’ আর সেনাকল্যাণ সংস্থা-র অধীনে।

একজন মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ নাগরিক ও করদাতা হিসেবে আমার মনে প্রশ্নে জেগেছে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উত্তরোত্তর নানা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া কতটুকু কাম্য? শুধু তো সেনাবাহিনী নয়, এই বাহিনীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে পুলিশ, বিজিবি, বেসামরিক প্রশাসন নিজেদের বৈষয়িক শ্রীবৃদ্ধিতে নেমে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে এমন চিত্র তো হবার কথা ছিল না। অন্যদিকে করোনা মহামারির অভিঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও সাথে যুক্ত হওয়া রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখা দিচ্ছে। জনগণের একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বক্ষেত্রে ব্যয় কমাবার আহ্বান জানিয়েছেন। বিদ্যুতে লোডশেডিং বিষয়ে জনগণের সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি।

একটি বড় প্রশ্ন আজ সারা পৃথিবীর মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। তা হলো সেনাবাহিনীর পেছনে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় কীভাবে পৃথিবীজুড়ে সামরিক সংঘাত বাড়িয়ে তুলছে। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানিতে লিপ্ত রাখছে মানবকুলকে। এমনটা কি চলতেই থাকবে?

২০২১ সালে জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ যখন সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন তিনি একটি বিবৃতি দেন। ইউটিউবে সেনাপ্রধানের বক্তব্য আমি দেখেছি (আহমেদ ২০২১)। সেখানে তিনি বলেন যে সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের দূরত্ব থাকবে না। মিডিয়ার সাথে সেনাবাহিনীর কোনও দূরত্ব থাকবে না। শুধু সেনাপ্রধান হিসেবে নয়, একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে ভালো লেগেছিল, আমি আশান্বিত হয়েছিলাম। সেই আশা নিয়েই কয়েকটি বিনীত প্রশ্ন করতে চাই। প্রথমেই সেনাপ্রধান ও শীর্ষ সেনা-কর্মকর্তাদের প্রতি।

দরিদ্র বাংলাদেশে কেন সেনা কর্মকর্তাদের জন্য গলফ কোর্স থাকতে হবে? কেন এই ঢাকা শহরের চারপাশে পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করে সেনাবাহিনীর আবাসন গড়ে তুলতে হবে? কীভাবে এমন এক ব্যবস্থা সৃষ্টি হলো যেখানে তরুণ সেনা অফিসারও বিলাসবহুল গাড়ি চালানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করবেন এবং সেই প্রয়োজনীয়তা পূরণের সুযোগও সহজেই পাবেন?

২০২০, নভেম্বর ৬ তারিখে বিডিনউজ২৪-এর মতামত পাতায় প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র থাকুক মানুষের চোখের সামনে’ রচনায় আমি ১৯৭৫ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমি প্রাঙ্গণে অফিসার ক্যাডেটদের কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের কথা উল্লেখ করেছিলাম। কী বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে? নবীন অফিসারদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: “তোমরা হচ্ছো আমার পিপলস আর্মি, আমার গণবাহিনীর সদস্য।

আমি লিখেছিলাম কী পরম মমতায় উপস্থিত সেনা সদস্যদের বোঝাচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশে অফিসার-সিপাহীদের মধ্যকার সম্পর্ক, সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের সম্পর্ক বিষয়ে। বলছেন: “তোমরা আমার প্রোডাক্টিভ আর্মি।

সেই লেখায় আমি বলেছিলাম: “ভিডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেখে ও শুনে মনে হচ্ছিল আহা এই কথাগুলো যদি তিনি ৭২ সালে বলতেন!” আগেই বলেছি। তাহের এমন একটি সেনাবাহিনীর কথা বঙ্গবন্ধুর সামনে তুলে ধরেছিলেন ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালে। তার পরের বছর তাহেরকে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে একটি পিপলস আর্মি, একটি গণবাহিনী ও একটি প্রোডাক্টিভ আর্মিতে রূপান্তর করা আর হয়ে ওঠেনি। সে যাই হোক। যা হয়নি তা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই। কিন্তু যা ভবিষ্যতে হতে পারে, যা আমার মতে হওয়া কাম্য তা নিয়ে দুটো কথা তো বলতেই পারি।

আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিপ্রণেতা ও সেনাবাহিনীর সকল শীর্ষ পদাধিকারীদের উদ্দেশ করে বলছি। এই দেশকে ভালোবাসলে আপনাদের তো কর্তব্য হবে ২০৩০ সালকে লক্ষ্য করে ব্যারাক আর্মির যে বিপুল বিস্তৃতির মহাপরিকল্পনা আপনারা নিয়েছেন তা পুনর্বিবেচনা করা। প্রথম যেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তা হলো আমরা কেমন সামরিক বাহিনী চাই? আমরা কি একটি ব্যারাকমুখী অনুৎপাদনশীল বাহিনী চাই? নাকি আমরা একটি গণমুখী উৎপাদনশীল গণবাহিনী চাই? পরেরটি চাইলে তো ২০৩০ সালকে মাথায় রেখে এই সময়কালে ধাপে ধাপে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর আকার কমিয়ে আনা এবং এর ফলে বছর বছর যে বিপুল অর্থের সংস্থান হবে, তার একটি অংশ দিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে এক বিশাল গণবাহিনী গড়ে তুলে দেশে একটি বর্তমানের চেয়েও কার্যকর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

সত্তরের দশকে তাহের গণবাহিনীর কথা বলতে গিয়ে বাধ্যতামূলক নিয়োগ-এর কথা বলেছিলেন। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ১৮ বছর থেকে ২০ বছর পর্যন্ত আমাদের দেশের সকল নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে গণবাহিনীতে নিয়োগ করা হয়তো সম্ভব হবে না। তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু আমাদের সামরিক বাহিনীকে গণবাহিনীর আদলে গড়ে তুললে সেই বাহিনী আমাদের দেশের ওপর আর্থিক বোঝা হয়ে থাকবে না; বরং নানাভাবে উৎপাদনে জড়িত হবে। সেনা সদস্যরা কীভাবে উৎপাদনমুখী ও জনগণমুখী হতে পারে তার নমুনা তো তাহের কুমিল্লা সেনানিবাসে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সেই ১৯৭২ সালে, এবং তা কাজও করেছিল। পৃথিবীর যেসব দেশ গণবাহিনীর আদলে তাঁদের সামরিক বাহিনীকে সাজিয়েছে তাঁদের সম্মিলিত অভিজ্ঞতার আলোকেই আমরা আমাদের গণবাহিনী গড়ে তুলতে পারি।

বিনীত প্রশ্ন আমাদের রাষ্ট্র প্রশাসনের কেবিনেট সচিব, মুখ্য সচিব থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব ও সচিব মহোদয়দের প্রতি। আপনারা ভেবে দেখুন বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছরে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলাদের স্থলে রাষ্ট্র প্রশাসন গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের নিয়ে। কিন্তু আপনাদের মনোজগতে ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণায় কি বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন এসেছে? বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সংবিধান, বিশেষ করে সংবিধানের চারটি মূল নীতির প্রতি কোনও আনুগত্য আছে আপনাদের? এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালন পরিষদে পদাধিকার বলে আমি একজন সদস্য। এই পরিষদে সভাপতিত্ব করেন কেবিনেট সচিব। ২০১২ সালের কথা। সে সময় জনাব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ছিলেন এই পদে। অত্যন্ত সজ্জন ও নিপাট ভদ্রলোক। পরিচালনা পরিষদের এক সভায় মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল ক্যাডার সার্ভিসের প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য যে ম্যানুয়াল রয়েছে তা সময়োপযোগী করা। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম ম্যানুয়ালটির কোথাও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সংবিধান বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের কোনও শর্ত নেই। যদি তা থাকতো, তাহলে সংবিধানকে পদদলিত করে এত সহজেই সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের সহযোগী আমাদের রাষ্ট্র প্রশাসন হতেন না। সে সভায় আমি তা উল্লেখ করলাম এবং পরবর্তী ম্যানুয়েলে তা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করলাম। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সভাপতি তাতে একমত হলেন না। এ বিষয়ে আরও পর্যালোচনার কথা বলে সভার কাজ শেষ হলো। কিন্ত তা আর অন্তর্ভুক্ত হলো না।  আপনাদের প্রজাতন্ত্রের  কর্মচারী হিসেবে, জনগণের সেবক হিসেবে নিজেদের গণ্য করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনাদের পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার।

এরপর বিনীত প্রশ্ন সংসদ সদস্যদের প্রতি। দরিদ্র বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আপনারা। কেন আপনাদের বিলাসবহুল করমুক্ত গাড়ির মালিক হতে হবে? নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাত্রার দুর্নীতির অভিযোগ কেন আপনাদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হবে? কেন আপনাদের দেশের ভোটারদের প্রতি আস্থা না রেখে প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হতে হবে। তার বিষময় ফলাফল সম্পর্কে কি আপনাদের কোনও ধারণা আছে?

বিনীত প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষকমণ্ডলীর প্রতি। একটা সময় ছিল যখন আপনারা জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচিত হতেন। সেই অবস্থা কি আপনারা ধরে রাখতে পেরেছেন? কেন আপনাদের অসৎ রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনের অযোগ্য আমলাদের কথা মেনে কাজ করতে হবে? মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অর্জন স্বায়ত্তশাসনের রক্ষাকবচ ’৭৩ আদেশ রয়েছে আপনাদের। আপনাদের ভয় কী?

গণবাহিনীর কথা বলতে গিয়ে এত প্রশ্ন উত্থাপন করেছি। তা এজন্য যে যাদের লক্ষ করে প্রশ্ন উত্থাপিত হলো তাদের বোধোদয় ছাড়া বাংলাদেশে বিশাল ব্যারাক আর্মির স্থলে গণবাহিনী এবং রাষ্ট্র প্রশাসনের শীর্ষ পদসমূহে বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য আছে এমন যোগ্য ব্যক্তিদের নিযুক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের কাজ দুরূহ হবে। বাংলাদেশ নানা সময়ে অসাধ্য সাধন করেছে। সামনের দিনগুলোতে তেমনটা হবে না তা কে বলতে পারে?

লেখক: অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী; সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 

তথ্যসূত্র:

এম সানজীব হোসেন (সম্পাদিত), অপ্রকাশিত তাহের : কর্নেল আবু তাহের (বীর উত্তম)-এর অপ্রকাশিত রচনা ও পত্রাবলী (আগামী প্রকাশনী ২০১৮)

মো. আনোয়ার হোসেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র থাকুক মানুষের চোখের সামনে’ (বিডিনিউজ২৪, ৬ নভেম্বর ২০২০)

‘বাংলাদেশের সামরিক বাজেট: ভারত ও মিয়ানমারের সাথে পার্থক্য কতটা?’ (বিবিসি, ৩ মে ২০১৮)

হারুন উর রশীদ স্বপন, ‘অর্ধশত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সেনাবাহিনী’ (ডয়েচে ভেলে, ৫ জানুয়ারি ২০১৬)

‘নতুন সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন বলেছেন, সেনাবাহিনী ও দেশের মানুষের মধ্যে দূরত্ব থাকবে না’ (ইউটিউব ভিডিও)

‘Comparison of Bangladesh and Myanmar Military Strengths (2022)’

‘Father of the Nation of Bangladesh Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman at BMA’s 1st Graduation Parade’ (ইউটিউব ভিডিও)


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর