শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১১:৫৭ অপরাহ্ন

১৫ আগস্ট কী ভূমিকা রেখেছিল রক্ষীবাহিনী?

ভয়েস বাংলা প্রতিবেদক / ৭ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৩

১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর আক্রান্ত হওয়ার আগে রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় কালো পোশাক পরা ব্যক্তিরা অ্যাটাক করেছে– এমন খবর পেয়ে তিনি রক্ষীবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তাকে ফোন করে ঘটনাটি দেখতে বলেন। খবর বের হয়েছিল মনির বাসায় রক্ষীবাহিনী আক্রমণ করেছে। রক্ষীবাহিনীর ভাষ্যমতে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা বিদ্রোহ দমনে উদ্যোগী হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনী ও রাজনীতিকদের তরফ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়ে। শেষমেশ অন্য সব বাহিনী ও সংস্থার মতো তারাও নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। পরে রক্ষীবাহিনীকে বিলুপ্ত করা হয় এবং তাদের সব সদস্যকে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) আনোয়ার উল আলম (শহীদ) এবং উপপরিচালক (অপারেশন্স) সারোয়ার হোসেন মোল্লার পৃথক লেখনীতে এসব তথ্য উঠে আসে। এ বাহিনী গঠনসহ কার্যক্রম নিয়ে আনোয়ার উল আলম ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ এবং সারোয়ার আলম মোল্লা ‘রক্ষীবাহিনীর অজানা অধ্যায়’ নামে পৃথক দুটি বই লিখেছেন। ওই দুটি বইয়ে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং এরপরের ঘটনার বর্ণনাও রয়েছে। দুটি বইয়ের তথ্য ও বর্ণনা প্রায় একই রকম। দুই জনের লেখায় পরস্পরবিরোধী কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
লেখনীতে উঠে আসে, রক্ষীবাহিনী বেশ কয়েক দফায় বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। বঙ্গবন্ধু এ বাহিনীর প্রস্তাবের জবাবে প্রতিবারই বলেছেন—এই দায়িত্বটা তো পুলিশ ও সেনাবাহিনীর, এটা রক্ষীবাহিনীর নয়। বাঙালিরা যে তাঁর ক্ষতি করতে পারে, সেটা বঙ্গবন্ধু ভাবতেও পারতেন না। এমনকি রক্ষীবাহিনী ধানমন্ডি-৩২ নম্বর ছেড়ে গণভবনে বসবাস করার জন্য অনুরোধ করলেও সাড়া মেলেনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে। রক্ষীবাহিনীর সদর দফর গণভবনের কাছেই ছিল।
রক্ষীবাহিনীর কোনও শক্তিশালী ব্যাটালিয়ন ঢাকায় ছিল না বলেও তারা লেখায় উল্লেখ করেছেন। সদর দফতরের নিরাপত্তার জন্য তাদের কিছু সদস্য ছিল। এছাড়া সাভারে ছিল দুটি রিক্রুট (প্রশিক্ষণ) ব্যাটালিয়ন। তাদের বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্যই খুলনা, বরিশাল, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মোতায়েন ছিল।
১৫ আগস্টের ঘটনার বর্ণনা করে আনোয়ার উল আলম (শহীদ) লিখেছেন, ভোর সাড়ে ৫টা থেকে পৌনে ৬টায় বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোন করে জানান, শেখ মনির বাসায় কালো পোশাক পরা কারা যেন অ্যাটাক করেছে। বঙ্গবন্ধু বিষয়টি দেখার জন্য নির্দেশ দেন। এর পরপরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যাট্রোল ডিউটিতে থাকা রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের ধানমন্ডি এলাকায় শেখ মনির বাসায় যেতে বলেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার শিডিউল থাকায় নিরাপত্তার জন্য সাভার থেকে রক্ষীবাহিনীর রিক্রুট সদস্যদের আনা হয়েছিল বলে বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
টহল সদস্যদের নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি অফিসে যাওয়ার জন্য নিজেও প্রস্তুত হন শহীদ। এ সময় তাকে ফোন করেন বঙ্গবন্ধুর এপিএস তোফায়েল আহমেদ। তিনি ফোন করে বলেন, রক্ষীবাহিনীর লোকেরা নাকি মনি ভাইয়ের বাড়িতে অ্যাটাক করেছে, তাড়াতাড়ি দেখো। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা কেন অ্যাটাক করবে, এই প্রশ্ন তোলেন শহীদ। পাশাপাশি বিষয়টি দেখছেন বলে জানান। পরে তিনি রক্ষীবাহিনীর ডিউটি রুমে ফোন করেন। সেখান থেকে জানতে পারেন মন্ত্রিপাড়ায়ও গোলাগুলি হচ্ছে। পরে তিনি বাহিনীর উপপরিচালক (অপারেশন) সরোয়ার হোসেন মোল্লাকে ফোন ঘটনাটি জানান এবং অফিসে আসতে বলেন। নিজেও অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
সারোয়ার মোল্লাও তার লেখায় আনোয়ার উল আলম ও তোফায়েল আহমেদের কথোপকথনের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, শেখ মনির বাসায় রক্ষীবাহিনীর আক্রমণের কথা শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে যান।
আনোয়ার উল আলম (শহীদ) লিখেছেন, খবর পাওয়ার পরপরই তিনি প্রস্তুত হয়ে অফিসের উদ্দেশে বের হন এবং সারোয়ার হোসেনকেও অফিসে যেতে বলেন। অফিসে পৌঁছে শহীদ ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খানকে দ্রুত অফিসে আসতে অনুরোধ করেন। অফিসে যাওয়ার পর প্যাট্রোল ডিউটি টিমের মাধ্যমে খবর পান সেনা পোশাক পরা একদল আক্রমণকারী শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে আক্রমণ করে তাকে ও তার স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করে চলে গেছে। শেখ মনির বাসায় খোঁজ নিতে যাওয়া প্যাট্রোল টিমের মাধ্যমে জানতে পারেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেও হামলা হয়েছে। ওই টিমকে দ্রুত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যেতে বলেন তিনি।
ওই সময় চিকিৎসার জন্য বিদেশে অবস্থানকারী রক্ষীবাহিনীর পরিচালক নূরুজ্জামানের লাল টেলিফোন দিয়ে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে ফোন করেন এবং ঘটনা জানান আনোয়ারুল আলম শহীদ। বঙ্গবন্ধু তাকেও ফোন করে ফোর্স পাঠাতে বলেছেন বলে সেনাপ্রধান জানান। এ সময় রক্ষীবাহিনীর এই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা সেনাপ্রধানের কাছে করণীয় জানতে চান এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দ্রুত ফোর্স পাঠাতে অনুরোধ করেন। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলকে পাচ্ছেন না জানিয়ে ওই সময় ফোন রেখে দেন বলে বইয়ে লিখেছেন।
এ সময় ঢাকা বিমানবন্দরের দেয়াল ভেঙে কয়েকটি ট্যাংক রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। সেনাবাহিনীর একটি অংশের বিদ্রোহে এ অভ্যুত্থান হয়েছে, এমন ধারণা হয় রক্ষীবাহিনীর। তারা সঙ্গে সঙ্গে রক্ষীবাহিনীর সবাইকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের তৈরি থাকতে বলেন। এর একপর্যায়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পান। রক্ষীবাহিনীর লিডার আলিমুজ্জামান জোয়ারদার দৌড়ে এসে জানান, রেডিও থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এর পরপরই সেনাপ্রধান সফিউল্লাহকে আবার ফোন করলে তিনি জানান, সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং ডিজিএফআইয়ের প্রধান আবদুর রউফ তার সঙ্গে আছেন। তিনি আরও বললেন, ‘উই আর গোয়িং টু ডু সামথিং, তোমরা অপেক্ষা করো এবং তৈরি থাকো।’
শহীদ তার বইয়ে লিখেছেন, ওই সময় তিনি ও অপর উপপরিচালক সারোয়ার অ্যাকশনে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। তারা মনে করেন, সেনাবাহিনীর প্রধান সঙ্গে থাকলে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করা সম্ভব হবে। এ সময় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে ফোন করলে জানান, তিনি সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর কাছে যাচ্ছেন।
এরমধ্যে টহল ডিউটিতে থাকা লিডার সাহেব আলী বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে ফিরে এসে সেখানকার মর্মস্পর্শী ও রোমহর্ষক চিত্র তুলে ধরেন। মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে আক্রমণ ও হতাহতের খবর আসে। রক্ষীবাহিনীর এই কর্মকর্তা এরপর উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে ফোন করেন। উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নিয়ে সব বাহিনীর প্রধানকে ফোন করে বিদ্রোহী সেনাদের প্রতিহত করার আদেশ দিতে অনুরোধ করেন। তাদের নির্দেশ মতো শহীদ উপ-রাষ্ট্রপতির বাসায় গিয়ে জানতে পারেন, তিনি এক আত্মীয়ের সঙ্গে বেরিয়ে গেছেন। টেলিফোন করে প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীকে পাননি। তাদের না পেয়ে তিনি অনেকটা আশাহত ও হতোদ্যম হয়ে পড়েন এবং অতি দ্রুত অফিসে ফিরে আসেন বলে বইয়ে লিখেছেন।
অফিসে ফিরে তিনি ভারপ্রাপ্ত পরিচালক আবুল হাসান খান ও সরোয়ার হোসেন মিলে ওই মুহূর্তে তাদের কী করণীয় তা নিয়ে পরামর্শ করেন। তারা বুঝতে পারেন সরকার ভেঙে পড়েছে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা আত্মগোপনে গেছেন এবং সেনাবাহিনীর প্রধান কোনেও ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বা নিতে পারছেন না। ঢাকা থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না এবং তারা ক্রমেই আটকা পড়ে যাচ্ছেন বলে উপলব্ধি করেন। তারা আলোচনা করে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে সাভার চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আমিনবাজার পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসেন। সিদ্ধান্ত নেন, মরেন আর বাঁচেন ঢাকায়ই থাকবেন এবং একটা ব্যবস্থা করবেনই। কিন্তু নিরস্ত্র অবস্থায় তা তো করা যাবে না। প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন অস্ত্রশস্ত্রের।
বইয়ে আনোয়ারুল আলম শহীদ আরও লিখেছেন, ঢাকায় প্রতিরোধ গড়ার মতো কোনও শক্তি রক্ষীবাহিনীর ছিল না। কারণ, তখনও রক্ষীবাহিনী সদস্যদের ঢাকায় রাখার কোনও ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। রক্ষীবাহিনীর যা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল, নিজেদের কাছে রাখার কোনও সুবিধা না থাকায় রাখা হয়েছিল পিলখানায় বিডিআরের অস্ত্রাগারে।
প্রধান কার্যালয়ে ফিরেই তারা সিনিয়র ডেপুটি লিডার হাফিজ উদ্দিনকে রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন সদস্যসহ একটা ট্রাক দিয়ে পিলখানায় অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আনতে পাঠালে তাদের পিলখানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে তাদের এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয় বলেও বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ক্রমে তাদের জন্য পরিস্থিতি ধোঁয়াটে হয়ে আসে বলে মনে করেন। কারণ, তাদের সাংগঠনিক শক্তি তেমন ছিল না। কোনও দিকেই তারা আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলেন না বলেও লেখনীতে বর্ণনা করেছেন শহীদ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর এক খুনি মেজর ফারুক সেনা নিয়ে তার বাসায় গিয়েছিলেন বলেও লিখেছেন শহীদ। তিনি উল্লেখ করেন, বাসায় গিয়ে তাকে (শহীদ) না পেয়ে তার বাসা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে ফোন করে ফারুক জানান, ‘অপারেশন সাকসেসফুল।’
এছাড়া তারা সাভারের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর ফারুক রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে এসে পরিচালকের রুমে ঢুকে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলতে বলেন। তবে যাওয়ার আগে এটাও বলে যান, তাদের ট্যাংকের নলগুলো রক্ষীবাহিনী সদর দফতরের দিকে তাক করা আছে। কোনও মুভমেন্ট নেওয়া হলে সদর দফতর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
পরিস্থিতি আস্তে আস্তে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে বইয়ে উল্লেখ করেন শহীদ। এরপরও তিনি ভাবতে থাকেন, তাদের যেভাবেই হোক একটা কিছু করতেই হবে। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদকে ফোন করলে তিনি উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ নেন। ঘাতকদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নিতে হলে সেনাপ্রধানকে প্রয়োজন বলেও তাকে জানান তাজউদ্দীন আহমদ।
তারা আবারও সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহকে ফোন করলেন, কিন্তু পেলেন না। তার খোঁজে সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে ফোন করে জানতে পারেন সেনাপ্রধান প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দফতরে অবস্থান করবেন। সেখানে যোগাযোগ করলে তাদের (শহীদ ও সারোয়ার) ৪৬ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্সে যেতে বলেন। আরও জানালেন, তিনিও সেখানে যাচ্ছেন। কিছু একটা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এমনটা ভেবে আরা আশাবাদীও হন। ধরে নেন ৪৬ ব্রিগেড সদর দফতর থেকেই অ্যাকশন শুরু হয়ে যাবে। তবে সেখানে গিয়ে তারা হতাশ হন বলে বইয়ে উল্লেখ করেছেন। গিয়ে দেখেন, ব্রিগেড কমান্ডারের কক্ষে একটা টেবিল ঘিরে খালেদ মোশাররফ, শাফায়াত জামিলসহ দুই-তিনজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা বসে আছেন। ৩০-৩৫ জন সেনা কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন। তারা অভ্যুত্থানের পক্ষে না বিপক্ষে চেহারা দেখে বুঝতে পারেন না। সেখানে গিয়ে সত্যতা জানতে পারেন এবং তাদের বলা হয়—মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে, দেশকে বাঁচাতে হবে ইত্যাদি। সেনাপ্রধান ওই সময় রেডিও স্টেশনে গেছেন বলেও জানতে পারেন। হতাশা নিয়ে তারা রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে ফিরে আসেন।
পরিস্থিতি দ্রুত পর্যালোচনা করে বুঝতে পারেন, সরকার ও সরকারের রাজনৈতিক ভিত্তি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের সবাই তাদের প্রিয় নেতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হয়েছেন জেনে বিস্মিত, ব্যথিত ও হতবাক হয়ে পড়েছেন। তাদের বেশিরভাগই দেশের এই চরম মুহূর্তে নিজেদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার নিজেরাই ত্যাগ করে জীবন বাঁচানোর তাগিদে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন।
কর্নেল সারোয়ার হোসেন মোল্লা তার বইয়ে লিখেছেন,‘(বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর) সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে তার পদক্ষেপ এবং করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা চান। তবে তার কথাবার্তায় তাদের মনে হয়, কোনও সিদ্ধান্ত দেওয়ার অবস্থা বা ক্ষমতা তার হাতে নেই। তা না হলে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধান তার ব্রিগেড কমান্ডারকে পাবেন না কেন? তিনি লিখেছেন, সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি অংশ ক্যুর সঙ্গে জড়িত ছিল। তবে সেনাবাহিনীর বাকি অংশও রক্ষীবাহিনীর যেকোনও উদ্যোগের বিরোধিতা করবে বলে মনে হয়েছিল। সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহর অসহায়ত্ব দেখে সেই ধারণা হয়েছিল। রক্ষীবাহিনী তখন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটা গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা ভেবেছিল বলেও সারোয়ার হোসেন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তবে একটা সশস্ত্র বাহিনীর লোক অস্ত্রশস্ত্রসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কাও তাদের মনে ছিল।
এছাড়া রক্ষীবাহিনী প্রতিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করলে সেনাবাহিনী একযোগে যে তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাবে—এ ব্যাপারে তাদের কোনও সন্দেহ ছিল না। সেনাবাহিনীর সংঘবদ্ধ আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো কোনও শক্তি রক্ষীবাহিনীর থাকবে না।’
সারোয়ার হোসেন মোল্লা লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তোফায়েল আহমেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে আসেন। পরে রাষ্ট্রপতির অফিস বঙ্গভবনের চাপে রাতে লিখিতভাবে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হস্তান্তর করেন।
সারোয়ার হোসেন আরও লিখেছেন, ‘… ইতোমধ্যে খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হয়ে সরকার গঠন করে। তার প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান, নৌবাহিনী প্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান, বিডিআর প্রধান এবং পুলিশ প্রধান সবাই আনুগত্য ঘোষণা করে। তারপর রক্ষীবাহিনীর প্রশ্ন আসে। এ পরিস্থিতিতে অন্যান্য বাহিনী যখন আনুগত্য স্বীকার করেছে তখন রক্ষীবাহিনীরও আনুগত্য স্বীকার ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। কেননা, সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। সরকারের পক্ষ থেকে রক্ষীবাহিনীর আনুগত্য স্বীকারের তাগিদ আসতে থাকে। তখন সিদ্ধান্ত মতো রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবুল হাসান খান আনুগত্য স্বীকার করে আসেন।’ পরে অতিমাত্রায় পীড়াপীড়ির কারণে এবং যেহেতু সেই মুহূর্তে আমাদের পক্ষে কিছু করাও সম্ভব ছিল না, শেষ পর্যন্ত তিনি ও আনোয়ার উল আলমও আনুগত্য ঘোষণা করেন।
এদিকে ওসমানী সাহেব রক্ষীবাহিনীকে ভেঙে যাদের ফিট পাওয়া যাবে তাদের পুলিশ, বিডিআর ও আনসারে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেন। পরে অবশ্য ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুরের মধ্যস্থতায় রক্ষীবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে সেনাবাহিনীতে একীভূত করা হয় বলে সারোয়ার হোসেন লিখেছেন। ওই অন্তর্ভুক্তির সময় তিনি ও আনোয়ার উল আলম যোগ দিতে চাননি। তবে, দুদিন পরে দেখতে পান তাদের দুজনকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তারা সেনাবাহিনীতে যোগদানও করেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর