রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০১:০৫ পূর্বাহ্ন

হারিয়ে যাচ্ছে কাঁসা-পিতল শিল্প

রিপোর্টার / ২৪৭ বার
আপডেট : শনিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১

আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শিল্প কাঁসা-পিতল। এর কাঁচামাল পাচার ও তৈরি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় হারাতে বসেছে শিল্পটি।

তবে ধুঁকে ধুঁকে চলা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন কারিগররা। চলছে নিত্য প্রয়োজনীয় বাসনপত্র তৈরির কাজ।

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সহযোগিতা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পে আবার খুলবে সম্ভাবনার দ্বার।

শহরের উপকণ্ঠে আজাইপুর, আরামবাগ, শংকরবাটি ও রামকৃষ্টপুর গ্রামের মানুষের এক সময় ঘুম ভাঙত হাতুড়ির টুং টাং শব্দে। ভোর রাত থেকে সারা দিন কর্মব্যস্ত থাকতেন ওই এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। কারখানায় তৈরি হতো পিতলের কলস, আবার কোথাও কাঁসার বাটি। কোনোটিতে থালাসহ কাঁসা-পিতলের বিভিন্ন আসবাবপত্র ও ঘর সাজানোর জিনিসপত্র।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার শংকরবাটি মহল্লার কারিগর শহীদ আলী জানান, ১৩ বছর বয়স থেকে তিনি কাঁসার বাটি তৈরি করছেন। এখন কাঁসার তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে কাজ কমে গেছে। সে কারণে তার সন্তানরা এসব কাজ শিখছেন না। অনেকে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে।

একই মহল্লার এন্তাজ আলী জানান, কাঁসা-পিতলের কাজে শারীরিক পরিশ্রম খুব বেশি, সে তুলনায় মজুরি ও বিক্রি কম। বাপ-দাদার পেশা হওয়ার কারণে তিনি এখনও ধরে রেখেছেন।

পৌর এলাকার রামকৃষ্টপুর গ্রামের কারখানা মালিক আমিনুল ইসলাম জানান, কাঁসার বাসন তৈরিতে ব্যবহৃত রাং ও তামার দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তাই কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসের দামও বেড়ে যাচ্ছে। সে কারণে এর ব্যবহার ও বিক্রি কমে যাচ্ছে। এ শিল্পকে বাঁচাতে হলে কাঁচামাল রাং ও তামা সহজ শর্তে আমদানিতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।

কারখানা মালিক নূর আমিন জানান, কাঁসা-পিতলের বাসন তৈরির কাঁচামাল ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আনতে ব্যয় বাড়ছে। কারিগরের অভাব ও হাতে তৈরি করায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তবে এখন আধুনিক যন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। সরকার যদি বিদেশ থেকে এসব মেশিন আমদানি করতে সহযোগিতা করে তাহলে কাঁসা ও তামার জিনিসপত্র তৈরিতে খরচ কমে যাবে। ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার ভিতরে আসলে চাহিদাও বাড়বে। না হলে দিন দিন কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র বিক্রেতা চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুরাতন বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল হামিদ জানান, আগে বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিনের উপহার ও অতিথি আপ্যায়নে কাঁসা-পিতলের তৈরি উপহার ব্যবহৃত হলেও এখন এর উল্টো চিত্র। সহজলভ্যতা ও দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এবং বিভিন্ন রঙের বাহারি ডিজাইনে পণ্য হওয়ায় কাঁসা-পিতল ছেড়ে এসবের দিকেই ঝুঁকেছেন মানুষ।

শিবগঞ্জের তাহসিন বেল মেটাল স্টোরের মালিক আশরাফুল ইসলাম জানান, কালের বিবর্তনে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার কমে যাওয়ায় ক্ষতির বোঝা কাঁধে নিয়েও এখনো তিনি বাপের এ দোকানটি ধরে রেখেছেন। আগের মতো এ ব্যবসা আর নেই।

ইসলামী বাসনালয়ের মালিক ব্যবসায়ী রাকিম আলী জানান, তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পণ্যগুলো কিনে দোকানে সাজিয়ে রেখেছেন। কাঁসা-পিতলের পণ্য তেমন একটা বিক্রি না হওয়ায় ক্ষতি পোষাতে দোকানের অর্ধেক অংশ প্লাস্টিকের পণ্য বিক্রির জন্য তুলেছেন।

জেলার কোথাও এর উৎপাদন না হলেও কাঁসা শিল্পের ঐতিহ্য এখনও টিকিয়ে রেখেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে কারিগররা। ভারতে পাচার বন্ধ হওয়ায় আধুনিক যন্ত্রপাতি বসিয়ে সরকার এ শিল্পে মনোযোগ দিলেই ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পে আবার খুলবে সম্ভাবনার দ্বার।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আবদুল ওয়াহেদ জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে আজাইপুর, আরামবাগ, শংকরবাটিসহ ওই এলাকার ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ এক সময় কাঁসা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওই এলাকা তৈরি কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র বাংলাদেশসহ বিদেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হতো। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে এ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল অবৈধ পথে ভারতে চলে যাওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

তিনি আরও বলেন, সুলভ ও সহজলভ্য প্লাস্টিক পণ্যের কারণে ধীরে ধীরে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন যে কয়েকটা কারখানা চালু রয়েছে, সেগুলো ধুঁকে ধুঁকে চলছে।

তিনি বলেন, জেলার ঐতিহ্য কাঁসা শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে এই খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোকেও অর্থ সহায়তার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর