রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:০৯ পূর্বাহ্ন

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন রনিল বিক্রমাসিংহে

ভয়েসবাংলা প্রতিবেদক / ৫৬ বার
আপডেট : বুধবার, ২০ জুলাই, ২০২২

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। বুধবার পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে ১৩৪ জন এমপির সমর্থন নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিরোধী দল সমর্থিত দুল্লাস আলাহাপেরুমার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন ৮২ জন এমপি। বামপন্থী নেতা অনুরা কুমারা দেশনায়েক পেয়েছেন তিন ভোট। এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থীকে বিজয়ী হওয়ার জন্য ন্যূনতম ১১২টি ভোট পেতে হয়। তবে প্রায় দুই ডজন ভোট বেশি পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন বিক্রমাসিংহে। স্থানীয় সময় বুধবার সকাল ১০টায় পার্লামেন্টে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোট গণনা শেষে দুপুর সোয়া ১টার দিকে রনিল বিক্রমাসিংহকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন স্পিকার।

এদিন ২২৫ জন এমপির মধ্যে একজন পার্লামেন্টে অনুপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে পার্লামেন্টে হাজির হলেও একজন ভোটদান থেকে বিরত ছিলেন। বাকি ২২৩ জন ভোটাভুটিতে অংশ নেন। তবে এর মধ্যে চারটি ভোট বাতিল ঘোষণা করা হয়। বাকি ভোট গণনা করে রনিল বিক্রমাসিংহকে নতুন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়।

লঙ্কান রাজনীতিতে রনিল বিক্রমাসিংহের উত্থান-পতন

নির্বাচনে একটি আসনেও জয়লাভে ব্যর্থতার পর ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি)-এর অবশিষ্ট অংশের সভাপতি থেকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হওয়া রনিল বিক্রমাসিংহের ভাগ্যের নাটকীয় বদল হয়েছে দেশটির ইতিহাস বদলে দেওয়ার বছরে।

মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রনিল বিক্রমাসিংহে। ছবি: রয়টার্স

মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। ছবি: রয়টার্স

বুধবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে ২২৫ জন আইনপ্রণেতার মধ্যে ১৩২ জনের ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বিক্রমাসিংহে। তিনি সদ্য পদত্যাগ করা গোটাবায়া রাজাপাকসের অবশিষ্ট মেয়াদ দায়িত্ব পালন করবেন। গোটাবায়ার মেয়াদ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে। ফলে বিক্রমাসিংহে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।

ইউএনপি থেকে মনোনীত একজন পার্লামেন্ট সদস্য বিক্রমাসিংহে। পার্লামেন্টে তার দলের আর কোনও সদস্য নেই। ২০১৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ইউএনপির কোনও সদস্য জয়ী হতে পারেননি। কলম্বোর একটি আসনে প্রার্থী হয়ে হেরেছিলেন বিক্রমাসিংহে। তিনি মূলত পদত্যাগ করা রাজাপাকসের শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) দলের আইনপ্রণেতাদের ভোটের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।

গোপন ব্যালটে ভোট হওয়ার কারণে এসএলপিপি দলের সব সদস্যদের কিংবা তিনি আগের বিরোধী দলের সব সদস্যদের ভোট পেয়েছেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডালাস আলাহাপ্পেরুমা ছিলেন এসএলপিপির প্রার্থী। এছাড়া প্রধান বিরোধী দল সাজিথ প্রেমাদাসার সামাগি জানা বালবেগায়া (এসজিবি) দলটি গঠিত হয়েছে ইউএনপি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নেতাদের দ্বারা। বিক্রমাসিংহে ইউএনপির নেতা হওয়ার কারণে তারা অসন্তুষ্ট ছিলেন।

দেউলিয়া দেশ, ক্ষুব্ধ জনগণ

প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিক্রমাসিংহের দায়িত্ব নির্ধারিত। তিনি এমন সময় দেশের দায়িত্ব নিচ্ছেন যখন তার নিজের কথায় দেশটি ‘দেউলিয়া’। জ্বালানি, খাদ্য সামগ্রী বা ওষুধ কেনার মতো বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নেই। প্রায় ৭০ লাখ লঙ্কান অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। জ্বালানি সঞ্চয়ের পদক্ষেপ হিসেবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে স্কুল এবং শিশুরা বেশ কয়েক বছর অপুষ্ঠির মধ্য দিয়ে যাবে। এছাড়া করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধের পর আবারও শিশুদের পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে।

গোটাবায়া যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিক্রমাসিংহে। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েই তিনি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সঙ্গে ঋণের জন্য আলোচনা শুরু করেছিলেন। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে তার দায়িত্ব পালন চালিয়ে যাওয়া শ্রীলঙ্কাকে হয়ত একটা সুবিধা দিতে পারে। কিন্তু দেশটির রাজপথে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার জয়লাভ মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার সরকারবিরোধীরা তাকে রাজাপাকসের প্রক্সি হিসেবে মনে করেন। তারা মনে করেন, রাজাপাকসে পরিবারকে রক্ষার জন্য তিনি সম্ভাব্য সবকিছু করবেন। এমনকি গোটাবায়ার দেশে ফেরার পথও উন্মুক্ত করতে পারেন।

রাজনীতির ময়দানে পুরনো ঘোড়া

রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন বিক্রমাসিংহে। তার বাবা ছিলেন একটি সংবাদপত্রের মালিক। বর্তমানে লেক হাউজ গ্রুপ অব পেপার্সের মালিক ছিলেন তিনি। ১৯৭০-এর দশকে এটিকে রাষ্ট্রীয়করণ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সিরিমা বন্দরনায়েক। তার চাচা ছিলেন জে আর জয়াবর্ধনে। যিনি ১৯৭৮ সালে নতুন সংবিধানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থা কায়েম করেন। ইউএনপি দলকে প্রায়ই ‘আংকেল নেফিউ পার্টি’ (চাচা ভাতিজার দল) হিসেবে ডাকা হয়।

বিক্রমাসিংহে দুইবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সরাসরি প্রার্থী হয়েছেন, দুবারই হেরেছেন। ১৯৯৮ সালে তিনি হারে চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার বিরুদ্ধে এবং ২০০৫ সালে মাহিন্দা রাজাপাকসের কাছে। ২০১০, ২০১৫ ও ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হননি। ২০১০ ও ২০১৫ সালে ইউএনপি বিরোধী প্রার্থীকে সমর্থন করে এবং ২০১৯ সালে দলের মধ্যে বিদ্রোহ নিরসনে সাজিথ প্রেমাদাসাকে ইউএনপি থেকে প্রার্থী করতে রাজি হন বিক্রমাসিংহে।

সাম্প্রতিক উত্থান-পতন

২০১৫ সালে বিরোধী প্রার্থী শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি (এসএলএফপি)-এর বিদ্রোহী নেতা মৈত্রিপালা সিরিসেনা জয়ী হওয়ার পর রনিল প্রধানমন্ত্রী হন। দুই নেতা সম্মিলিতভাবে দেশ পরিচালনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। তাকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা। কিন্তু আইনি চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে দায়িত্ব ফিরে পান। দায়িত্ব ফিরে পেলেও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার শীতল যুদ্ধের অবসান হয়নি। একসঙ্গে কাজ করতে ব্যর্থতার ফলে ২০১৯ সালে ইস্টারে সন্ত্রাসী হামলা ঠেকাতে সক্ষম হয়নি সরকার। এক বছর পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গোটাবায়া এবং এসএলপিপিকে নিয়ে ২০২০ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন মাহিন্দা রাজাপাকসে।

একটি সংবাদ সম্মেলন শেষে রনিল বিক্রমাসিংহে। ছবি: রয়টার্স

একটি সংবাদ সম্মেলন শেষে রনিল বিক্রমাসিংহে। ছবি: রয়টার্স

ভাগ্যবান মানুষ

সব মিলিয়ে বিক্রমাসিংহে পাঁচবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু একবারও পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। ১৯৯৩-৯৪ সালে ডি বি বিজেতুঙ্গার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একবছর দায়িত্ব পালন করেন। আর শেষবার ১২ মে শুরু হয়ে বুধবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তার প্রধানমন্ত্রীত্ব।

বিক্রমাসিংহে একবার মনে করতেন শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের অবসানকারী নেতা হিসেবে ইতিহাস তাকে মনে রাখবে। ইউএনপি’র শহুরে আসনগুলো গৃহযুদ্ধে অর্থনীতিতে প্রভাব নিয়ে গভীর অসন্তোষ ছিল। ২০০১ সালের শেষ দিকে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন দেশটির প্রবৃদ্ধি ছিল নেতিবাচক, ১.৪ শতাংশ। তামিলদের গুড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি।

প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি নরওয়ের মধ্যস্থতায় এলটিটিই প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেন। অবশ্য দুই নেতা মুখোমুখি হননি। বিক্রমাসিংহে তামিলদের উত্তর ও পূর্বের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দায়িত্ব দিতে রাজি ছিলেন। যুদ্ধবিরতির ফলে বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ বাড়ে।কিন্তু তার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা বেশিদিন টিকেনি। প্রেসিডেন্ট কুমারাতুঙ্গা যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তে নাখোশ ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের ক্ষমতার ব্যবহার করে ২০০৪ সালে বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্ত করেন। ততদিন পর্যন্ত তার কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। পরে রাজাপাকসে ভাইয়েরা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটায় এলটিটিই-এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে।

আরও একটি সূবর্ণ সুযোগ

এবার নিয়তি বিক্রমাসিংহেকে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দেওয়ার আরও একটি সুযোগ দিয়েছে। তার সামনে সুযোগ রয়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারকারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাওয়ার। তার ওপর পশ্চিমা পূঁজির আস্থা রয়েছে। শ্রীলঙ্কার অনেকের তুলনায় ভারতীয় রাজনীতিকদের আস্থাভাজনও তিনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কার জন্য সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হলে তাকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসতে হবে। এজন্য তাকে প্রথমে দেশটির নাগরিকদের কাছে প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি রাজাপাকসে ভাইদের কোনও প্রক্সি নন।

দেশটির জনগণ মনে করেন, ২০১৫-২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে রাজাপাকসে ভাইদের বিরুদ্ধে তদন্ত জোরদারে ভূমিকা নেননি বিক্রমাসিংহে। তিনি যদি রাজাপাকসে পরিবারের বন্ধু হিসেবে নিজেকে ধরে রাখেন তাহলে জনগণের ‘লড়াই’ খুব শিগগিরই শেষ হবে না।

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর