রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:৩২ পূর্বাহ্ন

শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি যেভাবে গণমানুষের হলো

রিপোর্টার / ৩৫৮ বার
আপডেট : রবিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২১

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা জাগরণে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল ভারতীয় সরকারি গণমাধ্যম আকাশবাণী কলকাতা। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ৭ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ‍নানা সভা-সমাবেশের খবরগুলো খুব গুরুত্ব দিয়েই প্রচার করতো এই প্রতিষ্ঠানটি।

এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অন্যতম সংগঠকের ভূমিকাই নিয়েছিল আকাশবাণী কলকাতা। সে সময় এক দল তরুণ সাংবাদিক, প্রযোজককে নিয়ে পুরো কার্যক্রম চালাতো আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ। যাদের অন্যতম একজন হচ্ছেন পঙ্কজ সাহা, যিনি একজন কবিও। তখন প্রযোজক ছিলেন। তবে শুধু অনুষ্ঠান সাজানো বা প্রচার করার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতেন না। একাধারে সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রায় সকল কাজই করতেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় বিদেশি বন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা রাখতে সফরেও এসেছিলেন পঙ্কজ সাহা। মুক্তিযুদ্ধ সময়ের নানা স্মৃতি নিয়ে বিস্তর কথা বলেছেন।

আকাশবাণী কলকাতায় আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনাদের আয়োজন কেমন ছিল? 

পঙ্কজ সাহা: আমাদের কন্ট্রোল রুমে একটা মেশিন ছিল। নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেই মেশিনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বেতার শুনতে পেতাম। ঘুরাচ্ছি আর বিভিন্ন দেশেরটা শুনছি। হঠাৎ দেখি বাংলাদেশ বেতার থেকে একটা গান প্রচার হচ্ছে। তখন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তো ‍গানটা হচ্ছে আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি.. সানজিদা খাতুনের গলায়। আর খেয়াল করলাম আকাশবাণী কলকাতা থেকেও একই সময় একই গান প্রচার হচ্ছে। আর এটা সুচিত্র মিত্রের কণ্ঠে। মনে হলো দুই বাংলা এক হয়ে যাচ্ছে। ভাবনায় প্রকাশে এক হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে দুটো গানই রেকর্ড করে নিয়ে একটা প্রোগ্রাম পরে শুরু করলাম-নাম ছিল রেডিও স্কেচ। এই প্রোগ্রামটা অনেকদিন চালিয়েছিলাম।

স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপ দা একটা প্রোগ্রাম শুরু করলেন রেডিও কার্টুন। এটা ছিল খান সেনাদের, পাকিস্তানি শাসকদের ব্যঙ্গ করে তৈরি করা প্রোগ্রাম। তখন আমার প্রোগ্রামটা বাদ দিয়ে দিই। কেননা, এটা আরো তীব্রভাবে আঘাত করবে। এটা সাড়া ফেলেছিল।

অপেন তরফদার করতেন সংবাদ বিচিত্রা। আর আমি তখন করছি যুব-জগত। আমরা খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতাম। এমন হতো যে, আমি কোনো অনুষ্ঠানে গেছি তিনি যাননি, পরে আমি তাকে খানিকটা দিয়ে দিতাম। অপেন দাও এমন সহায়তা করতেন।

একই সময় ‘স্টুডিওর বাইরে’ প্রোগ্রামটাও করা হতো। সেটা রোববার দিন যায়। তো সেদিন সন্ধ্যে বেলায় নব ঘুরিয়ে শুনছি। এটা ৭ মার্চের কথা বলছি। বাংলা কথা হচ্ছে- মনে হচ্ছে যেন কেউ বক্তৃতা করছেন। অপেন দা বললেন, যে তুমি আমায় সাহায্য কর। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু উঠছি দেখে তিনি বললেন, তুমি বরং ওটা রেকর্ডিংয়ে দিয়ে চলে এসো। আমি ওটা রেকর্ডিংয়ে দিয়ে চলে এলাম। অপেন দার প্রোগ্রাম তৈরি হলো।

কী রেকর্ড হলো পরে তা শুনতে বসলাম। শুনলাম একজন কেউ বজ্রকণ্ঠে বক্তৃতা করছেন। শুনতে পেলাম কেউ একজন স্বাধীনতার ডাক দিচ্ছেন। মনে হলো আজকে তো ঢাকায় জনসভা আছে মুজিব সাহেবের। যখন শুনলাম- এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম…, তখন বুঝলাম এটা মুজিব সাহেব ছাড়া আর কে বলবেন। ঘটনাক্রমে অজান্তে রেকর্ড করে ফেলেছি। তখন অপেন দা বললেন, এটা যখন হাতে পেয়ে গেছি, তখন যেটা তৈরি করলাম এটার মানে হয় না। কিন্তু আমরা যা রেকর্ড করেছি তা মাত্র পাঁচ-ছ মিনিট। এটা দিয়ে তো হবে না। কেননা স্লটটা ছিল চৌদ্দ মিনিটের মতো। তখন তিনি বললেন- শোন, আমি গতকাল একটা গান শুনেছি অশোক তরু বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িতে অংশুমান রায়ের গলায়। গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার যেটা লিখেছেন- শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণী…। এটা চালিয়ে দিলে কেমন হয়। দু’জনই একমত হলাম।

অবশেষে ক্যান্টিনে তাকে ডেকে এনে টেবিল বাজিয়ে রেকর্ড করে গানটি ওই বক্তৃতার সঙ্গে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেননা স্লটতো পূরণ করত হবে। রোববার ডিরেক্টরও ছিলেন না। কোনো অনুমতি না নিয়ে ঝুঁকির মধ্যেও আমরা গানটা ব্যবহার করে বক্তৃতা চালিয়ে দিলাম।

তখন তো রেকর্ডিং হয়নি, কিছুই না। গানটা কেবল পাতা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই গানটা ছড়িয়ে গেল। পরে তো ইতিহাস হয়ে গেল। পরবর্তীতে এইচএমভি থেকেও গানটিও রেকর্ড করে বের হয়েছে। ইতিহাসটা এমন অজান্তে তৈরি হয়েছে। খেলতে খেলতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি অবিস্মরণীয় খবর আর গান প্রচার করে ফেলেছিলাম।

 মুক্তিযুদ্ধে খবর কিভাবে সংগ্রহ করতে যেতেন?

পঙ্কজ সাহা: আমাদের যেহেতু সরকারি চাকরি ছিল। তাই যাওয়া নিষেধ ছিল। কেননা, নিরাপত্তা একটা বিষয় জড়িয়ে ছিল। আর ধরা পড়া গেলে প্রমাণ হয়ে যাবে যে, আমার সরকারিভাবে মাথা গলাচ্ছি। কেননা, আকাশবাণী কলকাতা তো সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাই আমি যতবারই ঢুকেছি, ততবারই বাধা পেয়েছি আর্মির কাছ থেকে। তবে একটা টেকনিক করতাম। আর সেটা হলো- আমি বলতাম আইডি কার্ড রেখে দিন। ধরা পড়লে বলবো সাধারণ মানুষ। ভারত সরকার যে ইনভলব তার কোনো প্রমাণ নেই। বলতাম, যেতে দিন সাংঘাতিক মেটেরিয়াল নিয়ে আসব। যেটা আপনাদেরও কাজে আসবে। তখন তারা আর বাধা দিতো না।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনুষ্ঠানে বা খবরে কোনো সংকেত ছিল?

পঙ্কজ সাহা: আমরা কখনই বলতাম না মুক্তিযোদ্ধারা হেরে যাচ্ছে। যেখানে হেরে যেত, সেখানে আমরা বলতাম, মুক্তিযোদ্ধারা প্রবলভাবে লড়াই চালাচ্ছেন। তখন অন্য জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা বুঝে নিতেন, যে ওখানে হেরে গেছেন। আর মুক্তিযোদ্ধারা জিতে গেলে, সেখানে আমরা বলতাম যে খানসেনাদের মেরে মুক্তিযোদ্ধারা তাড়িয়ে দিয়েছেন বা ধ্বংস করেছেন। যখন বলতাম, প্রবলভাবে লড়াই চালাচ্ছে, তখন মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতেন ওটা তাদের হাতে নেই।

 সীমান্ত অতিক্রম কেন ঝুঁকি নিতেন?

পঙ্কজ সাহা: ঝিকরগাছসহ যশোরের বিভিন্ন এলাকায় যেতাম। কেননা, খবরের কাগজের মতো শুনে লিখে দেওয়ার কোনো সুবিধা নেই রেডিওতে। তাই যেতেই হতো। নিজে শুনে রেকর্ড করে আনলে বিষয়টা আরো পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা যায়। এতে বিপুল আগ্রহ তৈরি হতো। আমার জন্ম বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তাই বাংলাদেশের প্রতি আমার আলাদা একটা টান অনুভব করতাম।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের সঙ্গে কেমন যোগাযোগ ছিল?

পঙ্কজ সাহা: যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হয়নি, তখন আমরা আকাশবাণী কলকাতা থেকেই অনুষ্ঠান রেকর্ড করে দিতাম। আমাদের ৬ নম্বর স্টুডিও থেকে আমরা অডিশন করতাম। সে সময় আমরা অডিশন করতাম না। ওখানে চরমপত্রসহ অন্যান্য বিষয় রেকর্ড হতো।

অনেক পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও হলো। যেটা শ্রী অরবিন্দ্র ভবনে নিয়ে আসা হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের একটা রাজধানী ঘোষণা করা হয়েছিল। সেটা ছিল মুজিবনগর। আর এই মুজিবনগর কিন্তু কলকাতাতেই ছিল। যার নামই হচ্ছে শ্রী অরবিন্দ্র ভবন। থিয়েটার রোড বলে একটা জায়গা, সেই থিয়েটার রোডটা ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে দিল। সে বাড়িতে শ্রী ‍অরবিন্দ্র জন্মেছিলেন। বাড়িটা ফাঁকাই ছিল। বিরাট চৌহদ্দিওয়ালা একটা বাড়ি। সেই বাড়িতেই তৈরি হলো মুজিবনগর। সেইখানেই তাজউদ্দীন সাহেব থাকতেন। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দও থাকতেন। সেখানেই চলে এলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সেখান থেকেই ব্রডকাস্ট হতো। যদিও আগে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র অন্য জায়গায় ছিল।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তৈরি হওয়ার আগে এমন হতো শিল্পীরা রেকর্ড করতে আসতো, রেকর্ড শেষ হলে আবার গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিতাম। পূর্ব পাকিস্তান শিল্পীর প্রথম গান আমিই ব্রডকাস্ট করি। যাদের গান প্রচার করি তাদের মধ্যে রয়েছেন- শাহিন সামাদ, ডালিয়া নওশীন। ধর্মতলা স্ট্রেট বলে একটা জায়গা আছে, কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে সেখানে তারা রিহার্সেল করছিলেন। আমি খবর পেয়ে সমস্ত গান রেকর্ড করে নিই। ‌এরপর দিল্লিতে প্রধান কেন্দ্র থেকে অনুমতি নিয়ে প্রচার করলাম। বিপুল সাড়া পড়ে গেল। অনুষ্ঠানের নাম ছিল- মুক্তির গান।

শিল্পীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কিভাবে হতো?

পঙ্কজ সাহা: যুদ্ধের শুরুর দিকে স্থানীয় মানুষদের জানানোর জন্য রবীন্দ্র সদনে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পীরা অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন। সারারাত ধরে সেট তৈরি হয়েছিল। শিল্পী মোস্তাফা মনোয়ার সেটটি তৈরি করেছিলেন। সেটটা হচ্ছে একটা শেকল, শেকলটা একটা বলিষ্ঠ হাত ছিঁড়ে ফেলবার চেষ্টা করছে। আর স্বাধীনতা লাল সূর্য উঠছে। তার সঙ্গে শিল্পীরা গান গেয়েছিলেন। তাদের সকলের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্টতা ছিল। নানাভাবে সাহায্য করার সুযোগ হয়েছিল।

আকাশবাণীতে নিয়ে এসে ডিরেক্টর ও দিল্লিকে অনুরোধ করে তাদের অতিথি শিল্পী করে দিয়েছিলাম। সেজন্য তারা আকাশবাণীতেও গান গাইতেন। সে সময় অতিথি শিল্পী হিসেবে তাদের সম্মান দক্ষিণা দেওয়া হতো। এটা তাদের বেঁচে থাকতে খুব কাজে দিয়েছিল। এটা ভাবতে খুব ভালো লাগে, যে এটা করতে পেরেছিলাম। রোজগারের একটা পথ, কাউকে টিউশনি জোগাড় করে দেওয়া, কাউকে বাড়ি জোগাড় করে দেওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদি কাজেও সহায়তা করার সুযোগ হয়েছিল।

শাহীন সামাদ, বেণু, ওয়াহিদুল হক, সানজিদা খাতুন তারা কিন্তু আরো অনেক, কত জন যে আমাদের ওখানে যেতেন। গান, কবিতা, খাওয়া-দাওয়া, এই ভালবাসা এখনো আছে।

 আকাশবাণীর কর্মযজ্ঞে কাদের ভূমিকা বেশি ছিল?

পঙ্কজ সাহা: সকলেই সহায়তা করেছেন। তবে প্রণবেশ সেন, যিনি সংবাদ পরিক্রমা লিখতেন; যিনি পাঠ করতেন, দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়; সংবাদ বিভাগের প্রধান ভৌমিক দা, পুরো নাম মনে নেই; স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত। তার আগে ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক পিভি কৃষ্ণমূর্তি। তিনিই কিন্তু জমিটা তৈরি করে দিয়েছিলেন। কারণ অনেক আগে থেকেই সরকার খবর দিচ্ছিল যে, এই দিকে যাচ্ছে ঘটনাটা। যেহেতু তিনি বাংলা জানতেন না, তাই তাকে বদলী করে দেওয়া হয়, দায়িত্ব নেন দিলীপ কুমার সেনগুপ্ত। পিভি কৃষ্ণই নির্দেশনা দিয়েছিলেন, এই ধরনের প্রোগ্রাম বানাতে হবে, সংবাদ তৈরি করতে হবে। তবে আকাশবাণীর সকল কর্মীর খুব ভূমিকা ছিল। তাদেরও ভুলে গেলে চলবে না।

 বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সে সময় বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

পঙ্কক সাহা: প্রথম যখন কোলকাতা এলেন বঙ্গবন্ধু, সে মিটিংয়ের যখন রানিং কমেন্ট্রি করছি আমাদের খুব প্রিয়, প্রবাদ পুরুষ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ও দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায় আর আমি ধারাভাষ্য দিচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের স্টেশন ডিরেক্ট দীলিপ কুমার সেনগুপ্ত ফিরে এসো, জরুরি দরকার বলে একটা স্লিপ পাঠালেন। ফিরে যাওয়ার পর তিনি বললেন- খবর আছে শেখ মুজিব কলকাতায় থাকবেন। আর তার সম্মানার্থে একটা অনুষ্ঠান করতে হবে। সেটা আমরা করবো কিন্তু দুই বাংলা একসঙ্গে ব্রডকাস্ট করবে। অর্থাৎ আকাশবাণী ও বাংলাদেশ বেতারে একসঙ্গে প্রচার হবে।

‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলাদেশের প্রতি’ নামে একটা অনুষ্ঠান করলাম তখন। এতে বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বিশিষ্ট জনকে বেছে নিলাম। যেমন নাটক থেকে শম্ভু মিত্র, চলচ্চিত্র থেকে সত্যজিৎ রায়, তাকে না পাওয়ায় পরে মৃণাল সেনকে নেওয়া হলো, সঙ্গীত থেকে পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বিজ্ঞান থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আর ইতিহাস থেকে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার।

এদের মধ্যে মৃণাল সেন বললেন, তোমরা তো ভাবছ দুই বাংলা এক হয়ে গেল। কিন্তু দুই বাংলা এক হলো না। বাস্তবতাটা হচ্ছে, এই উপমহাদেশে দুটো দেশ ছিল। ভেঙে তিনটে হলো। এমনভাবে একেকজন একেক কথা বললেন।

এরপর গেলাম রমেশচন্দ্র মজুমদারের কাছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন। জগন্নাথ হলের প্রভোস্টও ছিলেন। তিনি বললেন, আমি ওখানে অনেকদিন থেকেছি। ওখানে পড়িয়েছি। আমি যদি কিছুমাত্র ইতিহাস বুঝে ‍থাকি, তাহলে তোমাদের আজকের এই আবেগের উত্তেজনার কোনো অর্থ নেই। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিতে থাকতে ‍পারবেন না। তাদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ, লড়াই শুরু হবে। বাংলাদেশের মাটি রক্তাক্ত হবে। শেষ অব্দি শেখ মুজিবের প্রাণ সংশয় ঘটবে। এছাড়া আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য মাথাব্যথা হবে। তার এমন কথা শুনে আমি শিউরে উঠলাম। আমাদের আশা আনন্দের ব্যাপার তখন। কিন্তু এতোবড় প্রসিদ্ধ এবং প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদ এমন করে বললেন!

সবশেষে গেলাম সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে। তিনি কত বড় বিজ্ঞানী। তার নামে থিওরি আছে। তিনিও বললেন, আমি ঢাকাতে পড়িয়েছি। এই শান্তি থাকবে না। একটা অশান্তি আসছে সামনে।

আমি এসব রেকর্ড করে ডিরেক্টরকে বললাম এসব। তিনি শুনে বললেন সর্বনাশ হয়েছে। তোমার চাকরি থাকবে না। এটা কিভাবে ব্রডকাস্ট করবে জানি না। তবে যেভাবে রেকর্ড করে এনেছ, সেভাবেই প্রচার করতে হবে। অনেক ভেবে একটা ভাষ্য লিখলাম- ‘যে এঁরা তো দূরদর্শী। বহুদূর অবধি ইতিহাস দেখতে পান। তাই তাঁরা আমাদের সতর্ক করে যাচ্ছেন, যেন ইতিহাস সেদিকে না যায়। ইতিহাস তো মানুষই গড়ে। তাই আজকে যারা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক তাঁরা তাদেরকে সচেতন করছেন। প্রতিবেশী হিসেবে আমাদেরও সতর্ক করছেন যেন ইতিহাস সেদিকে না যায়। ’ এটা জুড়ে দিয়ে তাঁদের বক্তব্য হুবহু ব্রডকাস্ট করে দিই। আশ্চর্য ব্যাপার ইতিহাস সেদিকেই গেল!


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর