রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০১:০৩ পূর্বাহ্ন

শেখ হাসিনা নির্বাচনে হেরে গেলে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতায় পড়তে পারে বাংলাদেশ: দ্য হিন্দু

ভয়েস বাংলা প্রতিবেদক / ৮ বার
আপডেট : সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০২৩

শেখ হাসিনা নির্বাচনে হেরে গেলে বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় পতিত হতে পারে। আবারও সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী শক্তির অভয়ারণ্যে পরিণত হতে পারে। আওয়ামী লীগের বিদায় শুধু ভারতের জন্য নয়, সমগ্র অঞ্চলের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, যদি তা দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি অস্থিরতা ও সহিংসতার সূচনা করে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া শুধু ভারতকে উদ্বিগ্ন করবে না,দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক অস্থিরতা ও সহিংসতার উদ্বেগও বাড়িয়ে দেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া রাজনৈতিক সংকট থেকে বাংলাদেশকে মুক্তি দেয়ার জন্য ভারতের ওপর চাপ বাড়ছে। যে সংকট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ সংকুচিত করছে এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের, বিশেষ করে ইসলামপন্থি মৌলবাদী দলগুলোকে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তাকে কোনঠাসা করতে উৎসাহিত করছে।
শেখ হাসিনা সরকার সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে কাছের এবং একমাত্র নির্ভরযোগ্য অংশীদার। যে অঞ্চলে ভারতবিরোধী অনুভূতি এবং আনুগত্য নিয়মিত পাল্টাচ্ছে।বদলানোতে পরিপূর্ণ। যদিও ভারত ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ‘বড় শক্তি’ হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সেই অবস্থানকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের স্বার্থ ও অবস্থান প্রতিদিন বাড়ছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রের অবনতি’ ঠেকাতে এবং সংসদীয় নির্বাচন যেন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়— তা নিশ্চিত করতে একাধিক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্বাচনে জালিয়াতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আধা-সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)-এর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গত নির্বাচনে জয়ী হতে র‍্যাব শেখ হাসিনার দল আওয়ামীলীগকে সহযোগিতা করেছে। ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপি ও রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ এসব পদক্ষেপ তার অপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্তৃত্বের পথ ও টানা নির্বাচনে জয়ের পথ সুগম করে তাকে দেশের সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা নেতা বানিয়েছে। তিনি (শেখ হাসিনা) দাবি করে আসছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন সব সময় অবাধ ও নিরপেক্ষ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো তার দলের সমর্থক, সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারি সংস্থাগুলোর লাগাম টানতে এবং সব রাজনৈতিক দলকে নির্ভয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি ঢাকায় একটি উপনির্বাচনের সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে— যখন আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা একজন বিরোধী প্রার্থীর ওপর হামলার ফলে ইইউ সরকারের সমালোচনা করে একটি কঠোর ভাষায় বিবৃতি জারি করে। বিগত বছরগুলোতে গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যদিও তিনি অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাকিস্তান ও ভারতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মে মাসে বিশ্বব্যাংকের বৈঠকে ওয়াশিংটনে যাওয়া শেখ হাসিনাকে উপেক্ষা করে তার প্রশাসন।
শেখ হাসিনা মনে করেন, বাইডেন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চাইছেন। একবার সংসদে তিনি বলেছিলেন, আমেরিকা বিশ্বের যেকোনও সরকারকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি একটি মুসলিম জাতি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া সংকট শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সুবিধাকে সংকুচিত করছে
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ অবস্থান শেখ হাসিনার বিরোধীদের চাঙ্গা করেছে। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উচ্ছ্বসিত এবং সরকারকে আক্রমণ করে সমাবেশ ও সভা করছে। অন্যান্য সংগঠন, যেমন- জামায়াতে ইসলামী, একটি ইসলামি সংগঠন, যেটি পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল, তারাও মার্কিন অবস্থানের কারণে দ্বারা উৎসাহিত বোধ করছে। শেখ হাসিনার আমলে জামায়াতের অনেক নেতাকে ‘যুদ্ধাপরাধের’ অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সংগঠনটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। তবে সম্প্রতি জামায়াত নেতারা ঢাকায় একটি বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে, যা ১০ বছরের মধ্যে তাদের প্রথম শক্তি প্রদর্শন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে আওয়ামী লীগের পতন হবে। প্রকৃত পক্ষে, জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠনের সমর্থনে বিএনপি বাংলাদেশে শাসন করার সম্ভাবনায় ঢাকা এবং দিল্লিতে বিপদের ঘণ্টা বাজছে।
ভারতের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র
প্রায় এক দশক ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা বিশ্বাস ও আস্থার একটি দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, যা উভয় দেশ ও অঞ্চলের ভালো উপকারে এসেছে। প্রায়শই বাংলাদেশকে নির্দেশ করে বিজেপি নেতাদের মুসলিম-বিদ্বেষী উপহাস উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সফলভাবে ধরে রেখেছে এবং নিশ্চিত করেছে এই সম্পর্ক শক্তিশালী থাকবে।
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত অংশীদারিত্ব বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে কানেক্টিভিটি ও নিরাপত্তায় বিস্তৃত হয়েছে। যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ অনুঘটক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। দুটি সরকার একটি জয়-জয় পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একে অপরের ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সাফল্য দিল্লিকে একটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরির অনুমোদন দিয়েছে, যাতে ভারতের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশগুলো উপকৃত হতে পারে।
১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জন্ম, তাতে ভারত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সেই উজ্জ্বলতার অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশের একাধিক শাসনব্যবস্থা সক্রিয়ভাবে ভারতবিরোধী শক্তিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই চালাতে উৎসাহিত করেছিল। ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা সম্পর্ক স্থিতিশীল করেন এবং দেশ থেকে ভারতবিরোধীদের বিতাড়িত করেন। তবে নয়াদিল্লি এবং ঢাকা আশঙ্কা করছে যে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো এই সম্পর্ককে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ওপর অনেক গুরুত্ব দেয়। তবে এগুলোর প্রসারে তাদের অতীত পদক্ষেপ সংশয়পূর্ণ। গণতান্ত্রিকভাবে পিছিয়ে যাওয়া দেশগুলোকে প্রায়শই পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যখন তাদের কৌশলগত স্বার্থ জড়িত থাকে, তখন এই বিষয়টি উপেক্ষা করে যায় তারা। সুতরাং, মূল বিষয় হলো— কেন তারা গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করতে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ঝুঁকি নেয়ার জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার কিন্তু মার্কিন পরিকল্পনায় প্রধান কৌশলগত দেশ নয়। এটিই বাইডেন প্রশাসনকে অধিকার এবং গণতন্ত্রের ইস্যুতে চাপ দেয়ার সুযোগ দিচ্ছে।
শেখ হাসিনার অধীনে অর্থনৈতিক পরিবর্তন
এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতি বদলে দিয়েছেন। ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ গত এক দশকে বার্ষিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অর্জন করেছে। দেশটির সামাজিক সূচকগুলোও বেশিরভাগ দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের চেয়ে ভালো।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে প্রচুর অগ্রগতি করেছে। স্বাধীনতার পর দরিদ্রতম দেশগুলোর তালিকায় থাকলেও এখন এটি দ্রুত বর্ধনশীল একটি অর্থনীতি। দেশটি কোভিড মহামারি ও ইউক্রেনের যুদ্ধের পরে খাদ্য, জ্বালানি এবং সার সরবরাহে বাধার কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবিলায় ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ঋণ চায় এবং তা পায়। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণের জন্য নেতৃস্থানীয় শক্তিগুলোর মধ্যে চলমান ক্ষমতার লড়াইয়ে পক্ষ নিতে অস্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ ভারত মহাসাগরের অংশ বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট জোন, যেখান দিয়ে বিশ্ব সামুদ্রিক বাণিজ্যের আনুমানিক ৮০ শতাংশ পরিবহন হয়। বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন থেকে সমদূরত্ব বজায় রেখে ‘ন্যায্য ও টেকসই উন্নয়ন’ প্রচারের জন্য ‘নিয়ম-ভিত্তিক বহুপাক্ষিক ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ভারত ও চীনের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উভয় দেশ সেখানে তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় (এলএসি) বিরাজমান উত্তেজনা তাদের অবস্থানকে আরও কঠোর করেছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে জাহির করার জন্য পদক্ষেপ নেয়ার কারণে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, মার্কিন-চীন বৈরিতা বাংলাদেশের ওপর ছায়া ফেলেছে।
ঢাকার একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীয় শাহাব এনাম খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য স্বার্থ রয়েছে, তৈরি পোশাকের বড় বাজারগুলোর একটি হলো দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের আর্থিক সংযোগ এবং শ্রম গতিশীলতাকে উল্লেখযোগ্য চাপ দিতে পারে।
ঘনিষ্ঠ হচ্ছে চীন
বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের টানাপোড়েন চীনকে শেখ হাসিনার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। জুন মাসে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি। তারা স্বাধীন অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি সমুন্নত রাখতে এবং তার জাতীয় বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই একটি উন্নয়নের পথ অনুসরণে বাংলাদেশকে সমর্থন করে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ভারত দ্বিমুখী আঘাত হিসেবে দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে হস্তক্ষেপের প্রত্যাশা বাড়িয়েছে। আর ঢাকার পাশে চীনের অবস্থানের সিদ্ধান্তের ফলে এটি এখন অপরিহার্য করে তুলেছে যে, ওয়াশিংটনের সঙ্গে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনাকে সংকট থেকে উত্তরণ করবে দিল্লি। যুক্তরাষ্ট্র না মানলে ক্ষতি হবে ভারতের।
ভারত আশঙ্কা করছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে বাংলাদেশে বিরোধী শাসককের মুখে পড়তে হবে তাদের। তবে চীন বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যে দলটির নেতৃত্বও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ। তাই বিএনপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে চীনের স্বার্থ বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা কম।
লন্ডনের এসওএএস ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার ও দক্ষিণ এশীয় কৌশলগত বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অভিনাস পালিওয়াল বলেছেন, ভারতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে— শেখ হাসিনা গুরুতর ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতার মুখোমুখি হচ্ছেন এবং বিএনপি রাজনৈতিক গতি পাচ্ছে। তার কথায়, নির্বাচনে এর প্রভাব জারি থাকলে নয়াদিল্লির জন্য এই চ্যালেঞ্জ আরও চাপের হবে।
একাধিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, শেখ হাসিনার প্রতি মার্কিন বিরোধিতার আসল কারণ চীনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা এবং তথাকথিত গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ নয়। পালিওয়াল বলেছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক চীনা বিবৃতি দুই পরাশক্তির মধ্যে একটি দীর্ঘ ভূ-রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি।
শাহাব এনাম খান জোর দিয়ে বলছেন, চলমান বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে চীন। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে চীনের অর্থনৈতিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশটি সফর করার পর তা আরও গতি পেয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এ যোগদানের পর থেকে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। চীনও বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। চীন-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বর্তমানে ২৫ বিলিয়ন ডলারের। সেই তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার এবং ভারতের সঙ্গে ১৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। তবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তি হলো প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব। এটি ১৯৮০-এর দশকে শুরু হয়েছে এবং পরের বছরগুলোতে ক্রমাগত বেড়েছে। এখন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার ৭২ শতাংশ সরবরাহ করে চীন। পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ হলো চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ের জন্যই উদ্বেগের প্রধান কারণ। বছরের পর বছর ধরে ভারতের পীড়াপীড়িতে শেখ হাসিনা চীনকে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে প্রকল্পটি বাতিল করে দেন। তিনি এখন চট্টগ্রামের কাছে কক্সবাজারের কাছে মাতারবাড়িতে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য জাপানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
মার্চ মাসে শেখ হাসিনা বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলের কাছে বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটি পেকুয়া উদ্বোধন করেন। যা ১.২১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল। চীনের কাছ থেকে ২০১৬ সালে কেনা দুটি সংস্কারকৃত সাবমেরিনের ঘাঁটি হিসেবে এটি কাজ করবে। চীনা বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশি কর্মীদের ঘাঁটি এবং সাবমেরিন পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণ দেবেন। তবে ঢাকা সতর্কতা অবলম্বন করেছে, এই ঘাঁটি চীনের নৌবাহিনীর ব্যবহারের জন্য নয়। ২০১০ সাল থেকে ঢাকা বেইজিংয়ের কাছ থেকে ২.৩৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কিনেছে মাত্র ১২৩ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র।
বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থ
ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। এটি ঢাকাকে একটি ফ্রিগেট এবং সামরিক পরিবহন বিমান সরবরাহ করেছে। ওয়াশিংটন চায়, বাংলাদেশ সরকার দুটি মৌলিক চুক্তি স্বাক্ষর করুক। এই দুটি চুক্তির মধ্যে রয়েছে, সামরিক চুক্তির সাধারণ নিরাপত্তা ও অধিগ্রহণ (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিারি অ্যাগ্রিমেন্ট অ্যান্ড দ্য অ্যাকুইজিশন) এবং পারস্পরিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ক্রস সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোনও তাড়া নেই। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, চুক্তিগুলো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সম্পর্ক তৈরি করতে এবং প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত বাণিজ্য, তথ্য আদান-প্রদান এবং সামরিক-সামরিক সহযোগিতার সুযোগ প্রসারিত করতে সহায়তা করবে।
পালিওয়ালের মতে, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারিতা বাংলাদেশে চীনের অবিচলিত প্রবেশের পথকে আরও সুগম করে তুলছে। মার্কিন প্রশাসন মনে করে যে, বিএনপি চীনের প্রভাব রোধ করতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, চীনের উপস্থিতি কমানো লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হলো তা সীমিত করা। জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি বিগত বছরগুলোতে ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য ঢাকার প্রশংসা করেন। তবে তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন।
এশিয়া ইনস্টিটিউটের কুগেলম্যান বলেছেন, ঢাকার সঙ্গে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্বে সত্যিকার অর্থে আগ্রহী ওয়াশিংটন। তবে এটি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি শক্তিশালী প্রণোদনা দিতে চায়, যাতে করে ঢাকার সঙ্গে তার সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন না হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’র সাময়িকী ফ্রন্টলাইন-এ বাংলাদেশকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন প্রণয় শর্মা। ২০ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনটির শিরোনাম ‘ইফ শেখ হাসিনা লসেস জানুয়ারি ইলেকশন, বাংলাদেশ কুড ফেস প্রলঙ্গড পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ইনস্ট্যাবিলিটি’। প্রণয় শর্মা রাজনৈতিক ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ের বিশ্লেষক। ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে তিনি সিনিয়র সম্পাদকীয় পদে কাজ করেছেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর