শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১১:৫৮ অপরাহ্ন

রোহিঙ্গা: বিশ্বব্যাংকের প্রলোভনে পড়বে না তো বাংলাদেশ?

রিপোর্টার / ১৯০ বার
আপডেট : শুক্রবার, ৬ আগস্ট, ২০২১

সম্প্রতি রোহিঙ্গাদেরকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের ওপর বিশ্বব্যাংকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপের বিষয়টি সত্যিই বাংলাদেশের জনগণসহ বিশ্বের অনেককে হতবাক করেছে। বিশ্বব্যাংক তার গৃহীত ‘রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক’- এর মাধ্যমে ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকের সমমর্যাদা দিতে বলছে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের স্থানীয় বাজারসহ বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাচলের সুযোগ এবং স্থানীয় ভাষা মানে- বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার সুযোগের কথা বলছে। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত এ কর্মসূচিটি সম্পূর্ণই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিকরণের আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বলেই মনে হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেকটা দৃঢ়তার সাথেই এ ধরনের অযৌক্তিক প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিশ্বব্যাংকের এই গড়পড়তা প্রস্তাব গৃহীত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা প্রচণ্ড ঝুঁকিতে পড়বে এবং এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। বাংলাদেশসহ উদ্বাস্তু গ্রহণকারী দেশসমূহের জন্য তৈরি বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত ফ্রেমওয়ার্কের তিনটি উদ্দেশ্য হচ্ছে- উদ্বাস্তু ও হোস্ট কমিউনিটির জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা, উদ্বাস্তুরা যে দেশে অবস্থান করছে সেই সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া অথবা তাদের ফেরত পাঠানো এবং দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাতে করে নতুন উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়। এ ধরনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং রোহিঙ্গাদের সম্মানজনকভাবে ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশ কর্তৃক এ পর্যন্ত যতসব উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে তা ভেস্তে যাবে।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কর্তৃক নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৫ অগাস্ট ২০১৭ সালের পর ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। সত্তর ও নব্বই দশক এবং এর পরে আসা পুরাতন রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুসহ বর্তমানে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান করছে। অধিক জনসংখ্যাপূর্ণ ও উন্নয়নশীল একটি ছোট দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ উদারতার মনোভাব দেখিয়ে চরম নির্যাতিত রোহিঙ্গাদেরকে গ্রহণ করে। কিন্তু মিয়ানমারের চতুরতা ও অনিচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক মহলের ভূ-রাজনীতি ও ব্যর্থতার কারণে আজ অব্দি একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

রোহিঙ্গাদের আদিভূমি রাখাইন (আরাকান), একটি বিস্তীর্ণ সমভূমি এবং বঙ্গোপসাগরের ১২০০ মাইল উপকূলরেখা যা চীন, ভারত এবং জাপানের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে ভূ-কৌশলগত ভূমি হিসাবে বিবেচিত হয়। তাছাড়া ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য ঠেকাতে কোয়াডভুক্ত (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপান) দেশসমূহের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত মিয়ানমারের গুরুত্ব অত্যাধিক। তাইতো ২০১৭ সালে তাতমাদো (মিয়ানমার সামরিক বাহিনী) পরিচালিত “ক্লিয়ারেন্স অপারেশন” এর মাধ্যমে ২৪,০০০ রোহিঙ্গা নিহত, ১৮,০০০ রোহিঙ্গা মুসলিম নারী ও মেয়ে ধর্ষিত এবং ৩৬,০০০ রোহিঙ্গা পুড়ে নিহত হলেও আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কিছু নিষেধাজ্ঞা এবং নিন্দা প্রস্তাব ও বক্তব্য ব্যতীত প্রায়োগিক ও সময়োপযুক্ত কোনও উদ্যোগ নিতে পারেনি। উপরন্তু, পয়লা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার জান্তা প্রধান মিন অং লাইংয়ের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান (ক্যু) মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‍ক্যু পরবর্তীতে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনরত প্রায় ১ হাজার সাধারণ মিয়ানমার নাগরিকদের হত্যার পরও তাতমাদোকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে স্বার্থান্বেষী ও বিবেকহীন দেশসমূহ। ২৪ এপ্রিল আসিয়ানের বিশেষ সম্মেলনে মিয়ানমার সামরিক জান্তা প্রধানের অংশগ্রহণ, ২২-২৪ জুন রাশিয়া কর্তৃক আয়োজিত নিরাপত্তা সম্মেলনে মিন অং লাইংয়ের অংশগ্রহণ, ৭ জুন মিয়ানমারের সামরিক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আসিয়ানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক, ১৪ জুলাই আসিয়ানের পরারাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনের ভার্চুয়াল বৈঠক, আগামী ৬ অগাস্ট অনুষ্ঠিতব্য মেকং নদীবেষ্টিত ৫ রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের (মিয়ানমারের সামরিক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ) সাথে জাপানের ভার্চুয়াল বৈঠক এবং আসন্ন আসিয়ান আঞ্চলিক নিরাপত্তা সম্মেলন মিয়ানমার সামরিক সরকারের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করার সমূহ সম্ভাবনার মতো ঘটনাসমূহ প্রমাণ করে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের জীবনের চেয়েও মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে বিশ্ব রাজনীতিতে। আর ভূ-রাজনীতির এই কূটচালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের সাময়িক বা স্থায়ীভাবে গ্রহণ ও ভরণপোষণ কোনোভাবেই সম্ভবপর নয়।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের অযাচিত প্রস্তাবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র গত ৫ বছর ধরে রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতার হাত বাড়িয়ে দেয়া বাংলাদেশকে আরো ভাবিয়ে তুলছে। ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে বিদ্যমান প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে অন্তর্ভূক্তিকরণ এবং ভবিষ্যতে আরো শরণার্থী আসলে তা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি রাখার মতো বিষয়সমূহ মিয়ানমারে অবস্থানরত ৬ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আগামীতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে উৎসাহব্যঞ্জক হিসেবে কাজ করবে বলে প্রতীয়মান। বিশ্বব্যাংকের এ প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধমে পুরো রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করে কে কার স্বার্থ হাসিল করছে তা ‍বিশ্ববিবেক আজ জানতে চায়।

বিশ্বব্যাংকের অধিকাংশ শেয়ারের মালিক এবং এর নেতৃত্বদানকারী যুক্তরাষ্ট্র কি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি আওড়িয়ে অবশেষে রোহিঙ্গা গণহত্যাকারী মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকেই তুষ্ট করতে যাচ্ছে? যদি তা না হয়, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত বিশ্বব্যাংককে বাধ্য করা যাতে তারা অযৌক্তিক ও বিবেকহীন ঋণ শর্ত উপেক্ষা করে মানবতার খাতিরে বাংলাদেশের মতো দেশসমূহকে ঋণ প্রদান করে।

অবশেষে, বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর জাতিসত্তা মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র রুখতে এবং রোহিঙ্গাদেরকে তাদের আদিভূমিতে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে বিবেকবান বিশ্বকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশ আপাতত তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী রাষ্ট্রসমূহের বিবেককে জাগ্রত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর