রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:৪৯ পূর্বাহ্ন

রোমানিয়া কি অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার নতুন রুট?

মো. আশরাফ আলী / ১০ বার
আপডেট : সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০২৩

রোমানিয়া হচ্ছে পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ। যার আয়তন দুই লাখ ৩৮ হাজার ৩৯৭ বর্গকিলোমিটার। তবে দেশটির বাসিন্দা মাত্র এক কোটি ৮৯ লাখ। এর চারদিকে হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, সার্বিয়া, মলদোভার মতো দেশের সীমান্ত রয়েছে। বিদেশে শ্রমিক বা শিক্ষার্থী পাঠানো নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলছেন, তুলনামূলকভাবে ভিসা পাওয়া সহজ হওয়ার কারণে পূর্ব ইউরোপের দেশ রোমানিয়ায় যাওয়া অনেকের কাছে পছন্দের দেশ হয়ে উঠেছে।
শরীয়তপুরের বাসিন্দা জাফর হোসেন নয় লাখ টাকা দিয়ে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে রোমানিয়ায় গিয়েছিলেন এই বছরের শুরুতে। সেখানে তার মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ৬৫০ ইউরো, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। তিনি একটি প্যাকেজিং কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি বলেন, বাড়ির একটা জমি বিক্রির পরেও ধার দেনা করে রোমানিয়ায় এসেছিলাম। যে বেতনের কথা বলেছিল, তাতে দুই-আড়াই বছরে ধার শোধ হয়ে যেতো। কিন্তু এখনে এসে দেখি, বেতন ভাতা তার চেয়ে অনেক কম। কবে ধার শোধ করতে পারবো, কবে নিজের পায়ে একটু মাটি পাবো, জানি না।
রোমানিয়ার জেনারেল ইনস্পেক্টরেট ফর ইমিগ্রেশন (আইজিআই) একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই বছরের প্রথম ছয় মাসে পাঁচ হাজার ৭৬৫ জন বিদেশি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছে, যাদের মধ্যে দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি রয়েছে। গত আড়াই বছরে অনেকটা হঠাৎ করেই বাংলাদেশ থেকে রোমানিয়ায় যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
ঢাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন একটি ট্রাভেল এজেন্সিকে ছয় লাখ টাকা দিয়েছেন রোমানিয়ায় যাওয়ার জন্য। এখনো তার ভিসা হয়নি। তিনি বলছেন, এর আগে একবার মালয়েশিয়া গিয়ে কিছুদিন কাজ করেছি। সেখানে সুবিধা হয়নি। আমাদের গ্রামের একজন রোমানিয়ায় গেছে। তার পরামর্শে আমিও যাওয়ার চেষ্টা করছি। তাকে ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বলা হয়েছে, বিমান টিকেটের বাইরে আরও কিছু টাকা দরকার হতে পারে।
বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, রোমানিয়ার বিভিন্ন কারখানায় কাজের জন্য শ্রমিকদের একটা চাহিদা আছে। গত বছর তাদের একটা টিম এসে বেশ কিছু বাংলাদেশিকে সরাসরি রিক্রুট করে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সেখানে যাওয়ার হিড়িকের মূল কারণ হলো তারা ইউরোপে ঢুকতে চায়। ইউরোপের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে রোমানিয়ার ভিসা পাওয়া একটু সহজ, কারণ ওয়ার্ক পারমিট বা স্টুডেন্ট হলে ভিসা দিয়ে দিচ্ছে। যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, আমার ধারণা তাদের তথ্যের চেয়ে বেশি গিয়েছে। এরা সেখান থেকে হয়তো অন্য কোন দেশে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইটালি, পর্তুগাল, স্পেন ইত্যাদি দেশে চলে যাচ্ছে।
রোমানিয়া, সার্বিয়ার মত দেশ কি অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকার নতুন রুট? এক কর্মী ভিসায় রোমানিয়া এসেছিলেন। কিন্তু কিন্তু ট্রাভেল কোম্পানি তাকে শর্ত দিয়েছিল, ওয়ার্ক ভিসায় রোমানিয়া পাঠাতে পারবে কিন্তু বাস্তবে চাকরির কোন ব্যবস্থা হবে না। রোমানিয়া যাওয়ার পর তিনি ইতালি চলে গেছেন, কারণ সেখানে তার আত্মীয়স্বজন আছে।
বাংলাদেশ থেকে কর্মী হিসাবে মূলত মাল্টা, গ্রিস, ইতালি, পোল্যান্ডে কর্মীরা যান। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় কর্মী বা অভিবাসনের জন্য যাওয়ার প্রবণতা কম হলেও গত দুই বছর ধরে উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে এই অভিবাসীদের পছন্দের অন্যতম প্রধান দেশ হয়ে উঠেছে রোমানিয়া। গত আড়াই বছরে বাংলাদেশ থেকে ১৮ হাজারের বেশি মানুষ রোমানিয়ায় গিয়েছে। এ বছর থেকে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বোয়েসেলের মাধ্যমেও কর্মী পাঠানো শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে রোমানিয়ার কোন দূতাবাস বা কনস্যুলেট নেই। ভারতের দিল্লিতে রোমানিয়ার দূতাবাসে ভিসা আবেদন করতে হয়।
ইটালির রোমে একটি আবাসিক হোটেলের ব্যবসা করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, এখন ইতালিতে অনেক বাংলাদেশি রোমানিয়া হয়ে আসছে, অনেকে আবার পর্তুগালে, জার্মানির দিকে চলে যাচ্ছে। কারণ ওই সব দেশে কাগজপত্র না থাকলে সরাসরি আসা কঠিন। কিন্তু রোমানিয়ায় একবার ঢুকতে পারলে সেনজেন ভিসায় তো যেকোনো দিকে যাওয়া যায়।
এভাবে বসবাসকারীদের অনেক সময় পুলিশ আটক করে কারাগারে বা দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আবার অনেকে আইন মেনে এসব দেশে বসবাস করে একসময় নানাভাবে বৈধ হয়ে যান। জাফর হোসেন যেমন আশা করছেন, একসময় তিনিও বৈধ হবেন। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে বৈধ হওয়ার সুযোগ হয় না, বলছেন ইটালির ব্যবসায়ী মি. মামুন। তবে শুধুমাত্র বাংলাদেশি নয়, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারতের, নেপাল, সিরিয়া, সোমালিয়া, তুরস্ক, মিশর বা ইরাকের লোকজনও রোমানিয়ায় প্রবেশ করছেন। এই তালিকায় এগিয়ে রয়েছে ইউক্রেন। গত বছরে ইউক্রেনের চার হাজারের বেশি নাগরিককে রোমানিয়ার আশ্রয় দেয়া হয়েছে।
রোমানিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, রোমানিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা শেখ কৌশিক ইকবাল বলেন, বাংলাদেশ থেকে গত বছর ২০ হাজারের বেশি মানুষ রোমানিয়ায় এসেছিলেন। কিন্তু এখানকার ইমিগ্রেশন পরে পরীক্ষা করে দেখেছে, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই এখন রোমানিয়ায় নেই। ফলে তারা আগে ওয়ার্ক পারমিট দেখেই ভিসা দিলেও এখন অনেক যাচাই বাছাই শুরু করেছে। এ কারণে এ বছর ভিসার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। এরপরেও এখন রোমানিয়ায় আনুমানিক ১০ হাজার বাংলাদেশি কর্মী রয়েছে বলে দূতাবাস ধারণা করছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে এখানে আসার অন্যতম একটি আকর্ষণ, তারা রোমানিয়াকে ইউরোপে ঢোকার একটি রুট হিসাবে ব্যবহার করে। কিন্তু এখানেও অনেক ভালো কাজের ব্যবস্থা আছে। কারণ রোমানিয়ার অনেক মানুষ ইউরোপের অন্যান্য দেশে চলে যাচ্ছে, ফলে এখানেও কর্মী সংকট আছে। কিন্তু দেখা গেছে, যারা লোক আনছে, তাদের লোক দরকার এখন, লোক আসছে হয়তো এক বছর পরে। আবার আসার পরে তারা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। ফলে রোমানিয়ার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশি কর্মীদের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশি কর্মীরা যাতে অন্য দেশে চলে না যায়, সেজন্য নানা রকম উদ্যোগের মাধ্যমে তাদের উৎসাহিত করার জন্য দূতাবাস চেষ্টা করছে বলে তিনি জানান। বিবিসি


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর