রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৩:০১ পূর্বাহ্ন

মামলা চালিয়ে নিঃস্ব জজ মিয়া একটা চাকরি পেলেই ‍খুশি

ভয়েসবাংলা প্রতিবেদক / ৪৩ বার
আপডেট : রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২

সবাই আমারে আশা দিছে। কেউ শেষ পর্যন্ত কিছু করে দেয় নাই। একটা স্থায়ী কর্মসংস্থান কেউ করে দিল না। এখন সিজনাল ব্যবসা করে কোনোরকম জীবন চালাইতেছি। মামলা চালাইতে গিয়া আমি নিঃস্ব। ভিটেমাটিও নাই।

একবুক আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন আলোচিত সেই জজ মিয়া। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলার মূল আসামিদের আড়াল করতে যাকে আসামি করেছিল তৎকালীন চারদলীয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এক পর্যায়ে জজ মিয়াকে রাজসাক্ষী করার পরিকল্পনাও করা হয়। কিন্তু গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি জজ মিয়ার কাহিনি থেকে সরে আসে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ সেই গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ নিহত হন ২৪ জন। আহত হন শত শত মানুষ।ঘটনার পরপরই হামলার মূল কুশীলবদের আড়াল করতে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের নির্দেশে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি ফেঁদেছিল জজ মিয়া কাহিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে সিআইডি শৈবাল সাহা পার্থ নামের এক তরুণকে গ্রেফতার করে। এরপর গ্রেফতার করা হয় মগবাজারের ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেছুর রহমানকে। তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতে না পেরে ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জালাল ওরফে জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়।

১৭ দিনের রিমান্ড শেষে ওই বছরের ২৬ জুন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক ‘জবানবন্দি’ দেন জজ মিয়া। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে গ্রেনেড হামলা করেছে বলে জানায় সে। হামলার নেপথ্যে সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদসহ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামও বলে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। ২০০৬ সালের আগস্টে জজ মিয়ার ছোট বোন খোরশেদা বেগম সাংবাদিকদের জানান স্বীকারোক্তির জন্য সিআইডি তাদের প্রতিমাসে টাকা দেয়। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে যবনিকা পড়ে জজ মিয়াকে নিয়ে সাজানো নাটকের।

জজ মিয়া বলেন, রিমান্ডে নিয়ে মারধর ও মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ার কারণে তিনি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটানো হতো। তিনি হামলার বিষয়ে কিছুই জানতেন না। সিআইডির তৎকালীন কর্মকর্তারা অন্যায়ভাবে তাকে ২১ আগস্ট মামলায় জড়িয়ে তার জীবনটা তছনছ করে দিয়েছে। জজ মিয়ার ভাষ্য, ওই মামলার খরচ চালাতে গিয়ে তাদের নোয়াখালীর সেনবাগে যে পৈত্রিক ভিটে ছিল সেটা বিক্রি করতে হয়েছে। এখন তিনি নিঃস্ব। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের একটি ভাড়া বাসায় চার বছরের কন্যা ও স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন। মৌসুমী ব্যবসায়ী হিসেবে এটা-সেটা বিক্রি করে সংসার চালান।

জজ মিয়া জানান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের মাধ্যমে তিনি গাড়িচালক হিসেবে একটি চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু করোনার সময় সেই চাকরি চলে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একবার চার লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সেটা মায়ের চিকিৎসাতেই খরচ হয়েছিল। মা জোবেদা খাতুনকেও বাঁচাতে পারেননি। চার বছর আগে তিনি মারা যান। জজ মিয়া বলেন, এখন একটা স্থায়ী চাকরি দরকার। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একাধিকবার আবেদন করেছি। কার্যালয় থেকে পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হবে বলে বলা হয়েছিল। এখনও কিছু হয়নি।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জজ মিয়ার কাহিনি নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমালে ২১ আগস্ট হামলার মামলায় নতুন করে তদন্ত শুরু হয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন জজ মিয়াকে অব্যাহতি দিয়ে বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই তাজ উদ্দিন, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। তবে ২০০৯ সালে আদালতের নির্দেশে সিআইডি এই মামলার অধিকতার তদন্ত করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়।

ওই অভিযোগপত্রে জজ মিয়ার কাহিনি তৈরির কারিগর হিসেবে সিআইডির তৎকালীন কর্মকর্তাদেরও অভিযুক্ত করা হয়। বিচার শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এই মামলার রায় দেন আদালত। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের ফাঁসির দণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।

আমি তো জজ মিয়া নই, জালাল ড্রাইভার

আমি তো জজ মিয়া নই, জালাল ড্রাইভার। পুলিশ ও মিডিয়ার মাধ্যমে দুনিয়ার সবাই আমাকে জজ মিয়া নামে চেনে। ওইটা তো আমার আসল নাম না। ভোটার আইডি কার্ড অনুযায়ী আমার নাম জালাল উদ্দিন। আমি এখন প্রাইভেটকার চালক। হাসপাতালের রোগী টেনে সংসার চালাই।

জালাল উদ্দিন জানান, কিস্তিতে একটি পুরনো প্রাইভেটকার কিনে নিজেই চালান। বহন করেন হাসপাতালের রোগী। এর মাধ্যমে যে টাকা আসে তা দিয়ে মা ও ভাইবোন নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তারা থাকেন নারায়ণগঞ্জে সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাক এলাকায়। দুই রুমের বাসায় তিনি ছাড়াও আছেন ছোটবোন খোরশেদা (১৯), ছোটভাই সাইফুল ইসলাম (১৭) ও বৃদ্ধা মা জোবাদা খাতুন। তবে পরিচয় গোপন রাখার জন্য বারবার বসবাসের জায়গা পরিবর্তন করেন বলে জানিয়েছেন জালাল উদ্দিন। তার কথায়, ‘জজ মিয়া একটি কলঙ্কিত নাম। কারণ এই নাম ব্যবহার করেই তিন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছিল তারা। বিনিময়ে আমার পরিবারকে প্রতি মাসে আর্থিক সহায়তা দিতো। কিন্তু সত্যি কখনও চাপা থাকে না। সব সত্যি প্রকাশের ফলে আমাকে আসামি বানানো ব্যক্তিরাই আসামি হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, অন্যায়ের শাস্তি দুনিয়াতেই দেখে যেতে পারবো মনে হচ্ছে। তাদের পাপের বিচার দুনিয়াতেই হচ্ছে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন দণ্ডবিধির ১২০/বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ২০১, ১১৮, ১১৯, ২১২, ৩৩০, ২১৮, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এর নম্বর ৯৭। ওই মামলায় গত বছরের আগস্টের আগেই সাক্ষ্য দিয়েছেন জালাল উদ্দিন। তিনি ছিলেন ১০৪ নম্বর সাক্ষী। তার মা ১০৩ ও বোন ১০২ নম্বর সাক্ষী ছিলেন । তারাও সাক্ষ্য দিয়েছেন।আক্ষেপ নিয়ে জালাল উদ্দিন সবলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত না হয়েও জেল খেটেছি। ভিটেমাটি হারিয়েছি। গ্রেফতারের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তিন কর্মকর্তা আমাকে গ্রেনেড হামলার ঘটনার ভিডিও দেখিয়েছিল। ওই ঘটনা সংশ্লিষ্ট শিখিয়ে দেওয়া কথা মুখস্থ করিয়েছিল। তারা বলেছিল— ‘আমরা তোকে রাজসাক্ষী বানাবো। যেসব কথা শিখিয়ে দেবো, আদালতে সেগুলোই বলবি। যাদের নাম বলতে বলবো তারা সব বড় সন্ত্রাসী। জেল থেকে বের হলে তারা তোকে মেরে ফেলতে পারে। তাই জেল থেকে বের হওয়ার পর তোকে সপরিবারে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবো। সেখানে তুই আরাম-আয়েশে থাকবি।

জালাল উদ্দিন জানান, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর কেউই তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চায়নি। জজ মিয়া নাম শুনলেই বিব্রত হতো। তাই প্রকৃত নামে বিয়ে করার পরও ঝামেলা শুরু হয়েছে। আট মাস আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন স্ত্রী। তিনি বলেন, ‘মামলা খাওয়া মানুষের সঙ্গে ঘর করবে না বলে জানিয়ে গেছে সে। সবাই মনে করে, সরকার বদল হলে আমাকে ফের জেলে যেতে হবে। বছরখানেক আগে পরিচয় গোপন করে চাঁদপুরে বিয়ে করি। কিন্তু কিছুদিন পরই জানাজানি হয়ে যায় গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি ছিলাম। এই নকল পরিচয় গোপন করার জন্যই বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি।চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে জালাল উদ্দিন মেজ। তার ভাষ্য, ‘আমার বড় দুই ভাই থাকেন আলাদা। চারজনের সংসার আমাকে চালাতে হচ্ছে। মামলায় জড়িয়ে পড়ায় মা আমার জন্য গ্রামের ভিটেমাটি বিক্রি করেছেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশ চলাকালে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক কর্মী। মুহূর্তেই এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয় সেখানে। এ ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে নাটক সাজায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে গ্রেফতার করা হয় জজ মিয়াকে। এরপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে তাকে দিয়েই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করা হয়।

খবর দেখলেই সেই দিনের কথা মনে পড়ে

‘খবর দেখলেই সিআইডি কার্যালয়ের সেই দিনের কথা মনে পড়ে। জেলখানার কষ্টের কথা মনে পড়ে। ২১ আগস্টের এই দিন এলেই গ্রেনেড বিস্ফোরণের খবর ও আমার ছবি দেখায়। তাই দেখে অনেকেই ফোন করেন। কেউ কেউ এড়িয়েও চলেন আমাকে। একটানে কথাগুলো বলে চলছিলেন জজ মিয়া ওরফে জালাল উদ্দিন, যিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার প্রথম ও প্রধান আসামি।
সোমবার ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ১৩তম বর্ষপূর্তির দিন সকাল ১১টার দিকে রাজধানীর মাতুয়াইল সংলগ্ন ঢাকা-চিটাগাং রোডের পাশেই গড়ে ওঠা শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা পাওয়া যায় জজ মিয়ার। ওই কার্যালয়ে বসে টেলিভিশনে দেখছিলেন নিজেকে নিয়েই প্রচার করা খবর।
খবর শেষ হলে গিয়ে কথা বলি জজ মিয়ার সঙ্গে। জানতে চাই, খবরে কী দেখেন। জবাবে জজ মিয়া বলেন, ১২ বছর আগে ২১ আগস্টের সেই ভয়াল গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় কিভাবে প্রধান আসামি হয়েছিলাম, কিভাবে খবরের শিরোনাম হয়েছিলাম— তাই দেখি।
জজ মিয়া বলেন, খবর দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সেই দিনের সিআইডি কার্যালয়ের কথা মনে পড়ে যায়। যে ঘটনায় এত মানুষের জীবন গেছে, এত মানুষ আহত হয়েছেন— সেই বিস্ফোরণের মূল আসামি আমি ছিলাম! চিন্তা করলেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। আবার ভাবি, আমি দুনিয়াতেই বিচার পেয়ে গেছি। যারা আমাকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েছিল, তারাই তো এখন আসামি।
ঢাকা-চিটাগাং রোডের পাশের ওই শ্রমিক সংগঠনের কার্যালয়ে জজ মিয়া ওরফে জালালের পাশে বসেই টিভিতে খবর দেখছিলেন আরও কয়েকজন। তাদের একজন ফুটপাথের ব্যবসায়ী শফি উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘জালালের ছবি দেখার জন্যই বসেছিলাম।’ গ্রেনেড হামলার আসামিদের ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘পাপের শাস্তি যে একসময় ভোগ করতে হয়, এইটাই আল্লাহর বিচার।
জজ মিয়ার পূর্বপরিচিত গাড়িচালক মোস্তফা বললেন, জজ মিয়াকে অনেক দিন ধরেই চিনি। ওর মতো একজনকে লোককে এত বড় একটা ঘটনায় ক্যামনে ফাঁসানো হইছিল, সেইটা ভাইবা কোনও কূল-কিনারা পাই না। তাদের কথার সূত্র ধরে জজ মিয়া বলে ওঠেন, ওরা আমার খোঁজখবর নিলেও ঘনিষ্ঠদের অনেকেই এখন আমাকে এড়িয়ে চলেন। অনেকেই আমার পরিচয় পেয়ে বিব্রত হন।’ বিব্রত হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওরা ভাবে, আমাকে ধরে যখন নিয়ে গেছে তখন কিছু না কিছু তো হইছিলই, কোনও না কোনও ঘটনা নিশ্চয় ছিল। এইসব ধারণা থেকেই কেউ কেউ দূরে থাকে।
এখন কী করছেন জানতে চাইলে জালাল উদ্দিন ওরফে জজ মিয়া বলেন, আমি রাজধানীর গুলিস্তানে কখনও ফল বিক্রি করেছি, কখনও সিনমোর পোস্টার বিক্রি করেছি। কখনও স্কুলের গাড়ি চালিয়েছি। এখন নিজেই নিজের প্রাইভেটকার চালিয়ে মা-বোনকে নিয়ে আমার সংসার চালাই।

যেভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি
জজ মিয়া বলেন, ১৯৯৮ সালে সূত্রাপুর থানায় দায়ের হওয়া একটি বিস্ফোরক মামলায় আসামি হয়েছিলাম। ওই মামলায় আমার ছয় বছরের সাজা হয়। সেই মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি হিসাবে আমাকে নোয়াখালীর সেনবাগ এলাকার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর চোখ বেঁধে ঢাকায় আনা হয়। এসপি রশীদ আমাকে নিয়ে আসেন।
জজ মিয়া বলতে থাকেন, আমার চোখ খুলে দেওয়া হলে নিজেকে একটি রুমের মধ্যে দেখতে পাই। সামনে একাই বসা ছিলেন এসপি রশীদ। রুমে অনেক লাঠি, প্লাস (প্লায়ার্স), হাতুড়ি এসব ছড়ানো-ছিটানো ছিল। ওপরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রশি ঝুলানো ছিল। বুঝতে পারলাম এই রুমে কী হয়!’
ওই সময়ের ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে জজ মিয়া বলেন, ‘‘এসপি আমাকে বলেন, তোর কাছে বড় স্যার আসবে, তার সঙ্গে কথা বলবি।’ ঘণ্টাখানেক পর আবার চোখ বেঁধে অন্য রুমে নিয়ে যায়। ওই রুমে ছিলেন রুহুল আমিন স্যার। তিনি আমার সামনে বসেছিলেন, আমাকেও বসতে বললেন। তারপর টিভি ছেড়ে দিয়ে বললেন, দেখ, তুই কিভাবে হামলা করেছিস। বল।’ আমি তখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
জজ মিয়া জানান, ওই হামরার এক সপ্তাহ আগে থেকেই তিনি ছিলেন গ্রামের বাড়ি। ১৯৯৮ সালের একটি মামলার কথা বলে তাকে গ্রাম থেকে ধরে আনা হয়। ফলে পুলিশ কর্মকর্তাদের কথার কিছুই বুঝতে পারছিলেন না বলে দাবি করেন তিনি। তা সত্ত্বেও তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেওয়া হয়।
জজ মিয়া বলেন, রশীদ স্যার আমাকে আলাদা করে নিয়ে গেলেন। এরপর উল্টাপাল্টা ব্যবহার শুরু করলেন, গালিগালাজ করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে আমাকে ফ্যানের সঙ্গে রশি লাগিয়ে আমাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে হাত ও পায়ের তালুতে পেটাতে থাকেন। কে কে ছিল, বল— এই প্রশ্ন করতে করতেই মারতে থাকেন আমাকে।
ওই নির্যাতনের কারণে জজ মিয়ার ডান হাতের হাড়ে চিড় ধরে বলে জানান তিনি। নির্যাতনের সময় বারবার তাকে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করতে বলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। জজ মিয়ার ভাষ্য, ‘‘রুহুল আমিন স্যারের রুমে নিয়ে গেলে তিনি আমাকে বললেন, ‘হামলার কথা স্বীকার কর। তাহলে তোর ভালো হবে। তুইও বাঁচ, আমাদেরও বাঁচা।’ স্যারের কথা শুনে আমি বললাম, ‘ক্যামনে বাঁচাবো?’ তখন তিনি বলেন, ‘এই মামলার আসামিদের আমরা পাচ্ছি না। আমরা চাপে আছি। তুই আমাদের কথা না শুনলে তোরে ক্রসফায়ার দিয়ে এই মামলা ধামাচাপা দিবো।’ তখন আমি ভয় পেয়ে বলি, ‘আমি স্বীকারোক্তি কিভাবে দিবো? আমি তো কিছুই জানি না।’ তখন তিনি বলেন, ‘আমরা তোকে শিখিয়ে দিবো।’ স্বীকারোক্তি দিলে আমাকে বাঁচাবেন কিভাবে— জানতে চাইলে সিআইডি কর্মকর্তারা বলেন, ‘তোকে আমরা রাজসাক্ষী বানাবো। কোর্টে রাজসাক্ষীর জন্য পিটিশন করব, মঞ্জুর হলেই তুই রাজসাক্ষী হয়ে যাবি। তুই বেঁচে যাবি।
খানিকটা বিরতি দিয়ে আবারও বলতে শুরু করেন জজ মিয়া, এরপর তারা আমাকে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ছবি, ভিডিও দেখাতে থাকেন। বড় বড় সন্ত্রাসীদের ছবি দেখিয়ে মুখস্থ করতে বলেন। তাদের গাড়িতে করে হামলার স্পটসহ বিভিন্ন স্পটের লোকেশন বুঝিয়ে দেন। আমি যেন কোর্টে গিয়ে আসামিদের চিনতে পারি ও সব ঘটনা বলতে পারি, সে জন্য অনেকবার পরীক্ষাও নিয়েছেন তারা।
আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার কথা কথা বলতে গিয়ে জজ মিয়া বলেন, আদালতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হামলার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে থাকি। কোনও তথ্য ভুলে গেলে ওসি মনে করিয়ে দেন। ম্যাজিস্ট্রেটকে আমার ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এইরকম না, ওইরকম হবে।’ এভাবে আমার জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে বলেন, ‘তোমার কথা সব রেকর্ড করা আছে। আমার কাছে যেভাবে বলেছ, উচ্চ আদালতে গিয়েও একইভাবে বলবে।
এরপর কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জজ মিয়াকে। সেখানেই কাটে ছয় বছর। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা আসার পর নতুন করে মামলার তদন্ত শুরু হয়। এসময় অনেকেই জজ মিয়াকে গ্রেনেড হামলা মামলার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে জানতে চাইলেও তিনি মুখ খোলেননি।
শেষ পর্যন্ত প্রকৃত ঘটনা কিভাবে প্রকাশ পেয়েছিল, জানতে চাই জজ মিয়ার কাছে। তিনি বলেন, ‘‘একদিন মুন্সি আতিক স্যার ও কর্নেল গুলজার স্যারসহ কয়েকজন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তারা আমার কাছে ঘটনার সত্যতা জানতে চান। তখন আমি কর্নেল গুলজার স্যারকে জিজ্ঞাসা করি, ‘স্যার, আমি সত্য বললে কি আমাকে ক্রসফায়ারে দিবেন? নাকি আমারে আসামি বানিয়ে ফাঁসিতে দিবেন?’ গুলজার স্যার আমাকে আশ্বস্ত করেন, আমার কিছু হবে না। স্যার অভয় দিলে সব কথা বলে দেই। তিনি কথা রেখেছিলেন। আমার আর কিছু হয়নি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর