শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১০:১৯ অপরাহ্ন

ব্রিকস নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী

ভয়েস বাংলা প্রতিবেদক / ৮ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনে নিজের যোগদান সম্পর্কে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পুরোটাই তুলে ধরা হলো।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের ‘ব্রিকস-আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড ব্রিকস প্লাস ডায়লগ’-এ অংশগ্রহণের জন্য আমি ২২ আগস্ট ২০২৩ সেখানে যাই। এ সম্মেলনে যোগদানের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি সিরিল রামাফোসা গত জেনেভাতে ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক সামিটে সাইডলাইনে সাক্ষাৎকালে ও পরবর্তীকালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্রিকসের অর্থনৈতিক বাতায়ন New Development Bank-এর সদস্যপদ লাভ করে। এ সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য: Partnership for Mutually Accelerated Growth, Sustainable Development, and Inclusive Multilateralism.
২৩ আগস্ট সকালে আমি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ (বিডা) কর্তৃক যৌথভাবে আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড বিজনেস সামিটে’ প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেই। আমার বক্তব্যে আমি দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের কথা তুলে ধরি।
আমি তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানাই। বাংলাদেশের ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য আমাদের যে অভিযাত্রা, সেখানে তাদের সম্পৃক্ত হওয়ারও আহ্বান জানাই। এদিন দুপুরে আমি আফ্রিকা মহাদেশের ৯টি দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতগণের অংশগ্রহণে আঞ্চলিক দূত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি।
সম্মেলনে রাষ্ট্রদূতরা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি তুলে ধরেন। আমি রাষ্ট্রদূতদের সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘লুক আফ্রিকা পলিসি’র আওতায় আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দ্বিপক্ষীয় সম্ভাবনাময় খাতগুলো চিহ্নিতকরণ ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই। এছাড়া রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য রাষ্ট্রদূতদের স্বাগতিক দেশগুলোর সরকার যাতে জোরালো অবস্থান গ্রহণ করে সে জন্য কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করি। সন্ধ্যায় আমি ব্রিকসের চেয়ার এবং সম্মেলনের আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আয়োজিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে যোগদান করি।
একই দিন সন্ধ্যায় চীনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয়। বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারত্বের বিষয়ে আমাদের পারস্পরিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করি। চীনের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে সবসময় সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের জ্বালানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তা করতে তার দেশের আগ্রহের কথা জানান।
পরদিন আমি ব্রিকস- আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড ব্রিকস প্লাস ডায়লগে অংশগ্রহণ করি। এ সভায় ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমি বক্তব্য প্রদান করি। আমি গত সাড়ে ১৪ বছরে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন এবং নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরি। একই সঙ্গে আমি রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে অন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবহিত করি। আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করি যে টেকসই উন্নয়নের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি। ২০০৬ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫%, ২০২২ সালে আমরা দারিদ্র্যের হার কমিয়ে ১৮.৭% করেছি। একই সময়ের মধ্যে আমরা চরম দারিদ্র্যকে ২৫.১% থেকে ৫.৬%-এ হ্রাস করেছি। আমরা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি।
আমরা আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীনতার অভিশাপ থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে চলেছি। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। আমরা ১০ কোটি মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছি। ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিল্প-কারখানা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ প্রয়োজন মর্মে উল্লেখ করি। আমি আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের জন্য অপেক্ষমাণ থাকাকালীন কার্যকর বিকল্পের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করি। আমি উল্লেখ করি যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবদানে আমরা গর্বিত। খাদ্য উৎপাদন, সাশ্রয়ী মূল্যের ওষুধ, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস বিষয়ে আমাদের দক্ষতা আফ্রিকার দেশগুলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করতে বাংলাদেশের সদিচ্ছা প্রকাশ করি। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, মানবপাচার, সাইবার অপরাধ এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্বারোপ করি। সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুত অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি প্রাপ্তির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়েও আমি গুরুত্বারোপ করি।
আমি ক্লাইমেট জাস্টিস, অভিবাসীদের অধিকার, ডিজিটাল ইকুয়িটি এবং টেকসই ঋণের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য সকলকে আহ্বান জানাই। নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের সুযোগসহ আইনভিত্তিক বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু রাখার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরি।
আমি দৃঢ়কণ্ঠে ব্যক্ত করি যে বৈশ্বিক দক্ষিণে অবস্থানকারী দেশগুলোর ওপর আরোপিত কৃত্রিম সিদ্ধান্ত এবং বিভাজন নীতিকে না বলার এখনই উপযুক্ত সময়। সর্বজনীন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করা প্রচেষ্টাকে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদের নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই সকল হুমকি, উসকানি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। আমি বিপজ্জনক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় সম্পদ অপচয় না করে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের জন্য পণ্য ও পরিষেবা প্রদানে অর্থসংস্থান করার আহ্বান জানাই। বিশ্বজুড়ে শান্তি, ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতার জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানাই।
ব্রিকস- আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড ব্রিকস প্লাস ডায়লগ চলাকালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে আমি বক্তব্য প্রদান করি। সেখানে আমি নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের সফলতা বিশ্বনেতৃবৃন্দের কাছে তুলে ধরেছি।
সম্মেলনের সাইডলাইনে বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। বৈঠককালে তারা বাংলাদেশের প্রস্তাবনার সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকের সময় বাণিজ্য, কৃষি, প্রাণিসম্পদ ইত্যাদি বিষয়ে অব্যাহত সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়। এছাড়াও আমি তানজানিয়ার রাষ্ট্রপতি, মোজাম্বিকের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করি। তানজানিয়ার রাষ্ট্রপতিকে আমি জি-টু-জি ভিত্তিতে প্রযুক্তি সহায়তা বিনিময়, আইটি পণ্য ও পরিষেবার বাজারে প্রবেশ এবং স্ট্যার্টআপগুলোর অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে যৌথ উদ্যোগ শুরু করার প্রস্তাব দেই। এছাড়া, বাণিজ্য, ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ, চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ বা সুনীল অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়।
মোজাম্বিকের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পরিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের বিষয়ে সহমত হই। মোজাম্বিকের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর অংশগ্রহণে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে মোজাম্বিকের যুদ্ধবিরতি ও শান্তি পুনঃস্থাপন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান। একই দিন নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাৎকালে তাকে আমি একটি উচ্চ আয়ের বাংলাদেশ বিনির্মাণে এনডিবিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানাই। তাছাড়া, ইরানের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠককালে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বিষয়ক আলোচনা হয়।
সন্ধ্যায় আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিগণ আয়োজিত গণসংবর্ধনায় ভার্চুয়ালি যোগদান করি। আমি তাদের দেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সক্রিয় গ্রহণের মাধ্যমে জনযোগাযোগ বাড়াতে অনুরোধ করি। আমি তাদের বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশীদার হতে বলি।
ব্রিকস- আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড ব্রিকস প্লাস ডায়লগ সফরসঙ্গী হিসেবে মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বেসরকারি শিল্প বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টাসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। ২৬ আগস্ট ২০২৩ তারিখ সকালে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেই।
সামগ্রিকভাবে, ব্রিকস- আফ্রিকা আউটরিচ অ্যান্ড ব্রিকস প্লাস ডায়লগ সভায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমার সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পেরেছি। একই সঙ্গে আমরা রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তুতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবহিত করেছি। দক্ষিণের দেশগুলোর ওপর আরোপিত কৃত্রিম সিদ্ধান্তের কারণে আমরা আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে রাজি নই। সর্বজনীন নিয়মের নামে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অসম নীতিকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি দক্ষিণের দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছি।
আমরা আশা করবো, এ সম্মেলনের মাধ্যমে মিউচুয়ালি অ্যাক্সিলারেটেড গ্রোথ, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনক্লুসিভ মাল্টিলেটারিয়েলিজম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি ফলপ্রসূ হবে এবং ব্রিকস জোট এ ক্ষেত্রে একটি আদর্শ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করবে। আমার লিখিত বক্তব্য এখানেই শেষ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর