ব্রাজিলের ‘জাহান্নাম’ থেকে বিশ্বকাপে আন্তনি
আন্তনিকে চেনেন তো? ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপে খেলবেন এবার। মৌসুম শুরুর আগে রেকর্ড অর্থে আয়াক্স থেকে তাকে দলে নিয়েছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। অথচ অবিশ্বাস্য যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
প্লেয়ার্স ট্রিবিউনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি শুনিয়েছেন সেই দুঃসহ জীবনের গল্প।
আমার জন্ম জাহান্নামে। ভাবছেন মজা করছি? একটুও না। ইউরোপের বন্ধুরা হয়তো জানেন না, সাও পাওলোর যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি, একে ‘ছোট জাহান্নাম’ বললেই ঠিকঠাক বোঝানো যায়। যদি আপনার সত্যিই মানুষ হিসেবে আমাকে বুঝতে হয়, তাহলে জানতে হবে আমি কোত্থেকে উঠে এসেছি। আমার ইতিহাস। আমার মূল। ইনফেরনিনহো। জায়গাটা এমনিতে তেমন পরিচিত না।
আমাদের সামনের দরজার ১৫ হাত দূরত্বে ড্রাগ ডিলাররা ব্যবসা করতো, তাদের মালগুলো হাত বদল হতো। জানালা দিয়ে আমরা ঘ্রাণ পেতাম। আমার মনে প্রথম দিককার একটা স্মৃতি হচ্ছে- বাবা রোববার দিন ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার শুরু করতেন, যেন ড্রাগ বিক্রি করা লোকজন সরে যায় আর তার সন্তানরা একটু শান্তিতে ফুটবল দেখতে পারে।
আমরা এত বেশি বন্দুক দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, এরপর আর ভয়ই করতো না। এসব প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। আমরা বরং বেশি ভয় পেতাম পুলিশ দরজায় টোকা দিলে। একবার তারা আমাদের ঘরে এসে কাউকে খুঁজতে শুরু করলো আর অট্টহাসি হাসছিল। পুলিশ অবশ্য কিছু খুঁজে পায়নি। কিন্তু আমার বয়স অনেক কম তখন, মনে একটা ক্ষত তৈরি হয়ে গেল।
আমি এমন সব জিনিস দেখেছি….শুধু যারা তেমন জায়গায় থেকেছে তারাই উপলব্ধি করতে পারবে। ৮ বা ৯ বছর বয়সের একটা গল্প বলি। স্কুল থেকে ফিরছি। সরু গলিতে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। কোনো নড়াচড়া করছে না। যখন কাছে গেলাম, বুঝতে পারলাম লোকটা মরে গেছে। বস্তিতে থাকলে আপনাকে প্রায়ই এমনভাবে অনুভূতিশূন্য হয়ে যেতে হবে। আর কোনো রাস্তাও ছিল না, আমাকে স্কুলে যেতেই হতো। কী আর করার! চোখ বন্ধ করলাম আর মৃতদেহের উপর দিয়ে দিলাম লাফ।
এসব বলে কঠিন পরিস্থিতি বোঝাচ্ছি না। এটা আসলে আমার বাস্তবতা। অবশ্য আমি নিজেকে সবসময় সৌভাগ্যবান মনে করি, কারণ অনেক দুর্ভোগ থাকলেও আমার জন্য স্বর্গ থেকে আসা একটা উপহার ছিল। বল ছিল আমার বেঁচে থাকার সম্বল। ভালোসার দোলনা। বস্তিতে ক্রিসমাসে পুতুলের ব্যাপারে ভাবতামই না। যেকোনো ধরনের বল পেলেই খুশি।
প্রতিদিন আমার বড় ভাই ফুটবল খেলতে নিয়ে যেতো। বস্তিতে সবাই খেলতো। বাচ্চা, বুড়ো, শিক্ষক, কনস্ট্রাকশনের শ্রমিক, বাসের ড্রাইভার, ড্রাগ ডিলার, গ্যাংস্টার; আক্ষরিক অর্থেই সবাই। ওখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমার বাবার সময় জায়গাটা ছিল ময়লার ভাগাড়। আমার সময় হয়ে গিয়েছিল মাঠ।
শুরুর দিকে আমি জুতা ছাড়াই খেলতাম, পুরো পা রক্তাক্ত হতো। জুতা কেনার টাকা ছিল না আমাদের। আমি বাচ্চা ছিলাম, কিন্তু ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভায় ড্রিবল করতে পারতাম। প্রকৃতিগতভাবেই হয়ে যেতো। কারও কাছে মাথা নত করতাম না। ড্রাগ ডিলার, বাস ড্রাইভার, চোর; কাউকে গোনার সময় ছিল না। পায়ে বল থাকলে, আমার কোনো ভয় নেই।
আমি সব কৌশল শিখেছি কিংবদন্তিদের কাছ থেকে। রোনালদিনহো, নেইমার, ক্রিস্তিয়ানো। চাচা তোনিলোর কল্যাণে ইউটিউবে তাদের ভিডিও দেখতাম। তিনি অবশ্য আমার রক্তের চাচা ছিলেন না। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। তবে আমাকে দেখতেন পরিবারের মতো করে। যখন আমি ছোট ছিলাম, উনার ওয়াই-ফাই চুরি করতে দিতেন যেন ফুটবল শিখতে পারি। এমনকি আমাকে প্রথম ভিডিও গেমও দিয়েছিলেন তিনি। যদি তোনিলো দুটো ব্রেড পায়- একটা তার আর অন্যটা আমাদের। বস্তির এই ব্যাপার মানুষ বুঝে না। যদি একজন খারাপ করে, ভালো লোক আছে দুইজন।
আমি সবসময় বলি, ভুল জায়গায় কিন্তু সঠিক মানুষের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। যখন আমার আট বছর বয়স, প্রথম স্বর্গীয় দূত আমার পথ পাড়ি দিয়ে গেল। বুড়ো ওই ভদ্রলোক দেখলেন আমি গ্যাংস্টারদের বিপক্ষে বাস্টার্ডের মতো নিজের কৌশল দেখাচ্ছি।উনি পাশের লোকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ছোট ছেলেটা কে?’ ‘পিচ্চিটা? আন্তনি। ’ জবাব গেল তার কাছে।
প্রশ্নকারী লোকের নাম হলো ডিরেক্টর গ্রেমিও বারউরি। উনি আমাকে প্রথম ঘিঞ্জি বস্তির বাইরে গিয়ে তাদের ফুটসাল টিমে খেলার সুযোগ দিলেন। এরপর শুরু হলো আমার স্বপ্ন দেখা। মনে আছে একবার মায়ের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, দেখলাম আমাদের সামনে দিয়ে একটা লাল গাড়ি যাচ্ছে। ওটা ছিল রেঞ্জ রোভার, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল ফেরারি দেখছি। সবাই গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। কী যে সুন্দর লাগছিল!
আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, ‘একদিন আমি ফুটবলার হবো আর এমন গাড়ি কিনবো। ’ উনি অবশ্য হেসেছেন। কিন্তু আমি সিরিয়াস ছিলাম। তারপর মাকে বললাম, ‘চিন্তা করো না, কিছু সময় পর আমি তোমাকে গাড়িটা চালাতেও দেবো।
ওই সময় আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতাম। শুধু আমার জন্য খাট কেনার সামর্থ্য ছিল না। প্রতি রাতে আমি একদিকে তাকালে বাবাকে দেখতাম, আরেকদিকে মা। আমরা খুব কাছাকাছি থাকতাম আর এটা বোধ হয় আমাদের বেঁচে থাকতেও সাহায্য করতো। এরপর এমন একটা ব্যাপার ঘটলো, আমার পুরো জীবনই বদলে গেল।
যখন আমার বয়স ১১, বাবা-মা আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত, কারণ এর আগে অন্তত আমরা একে-অন্যের জন্য ছিলাম। এখন যখন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে মায়ের দিকে তাকাই, কেবলই শূন্যতা। এই ব্যাপারটা ভেঙে চুরমার করার মতো, কিন্তু আমাকে প্রেরণাও জুগিয়েছে অনেক। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতাম, ‘এসব থেকে আমাকে বের হতেই হবে। ’
ভোর পাঁচটায় বাবা ঘর ছেড়ে বের হতেন কাজের জন্য, ফিরতেন রাত আটটায়। তাকে বলতাম, এখন তুমি আমার জন্য দৌড়াচ্ছো। শিগগিরই আমি তোমার জন্য দৌড়াবো।
যদি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন, তারা স্বপ্নের ব্যাপারে জানতে চায়। চ্যাম্পিয়নস লিগ? বিশ্বকাপ? ব্যালন ডি অর? এগুলো কোনোটাই আমার স্বপ্ন না। লক্ষ্য। আমার একমাত্র স্বপ্ন ছিল বাবা-মাকে বস্তির বাইরে নিয়ে যাওয়া। এখানে কোনো প্ল্যান-বি নেই। হয় এটা করবো, নয়তো মরে যাওয়ার চেষ্টা করবো।
১৪ বছর বয়সে সাও পাওলো এফসিতে সুযোগ পেলাম। প্রতিদিন স্কুলের পর খালি পেটে একাডেমিতে যেতাম। কোনো কোনো দিন হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে টাকা মিলিয়ে বাসে চড়ে বাড়ি ফিরতাম। ক্ষুধার অনুপ্রেরণার ভান করার দরকার নেই। আমার ক্ষুধা সত্যি।
আমার মধ্যে একটা প্রবণতা ছিল- কেউ হয়তো এটাকে রাগই বলবেন। আবেগজনিত কিছু সমস্যা আছে। আলাদা তিন সময়, আমি ক্লাব থেকে প্রায় বিতাড়িত হয়ে যাচ্ছিলাম। ছেড়ে দেওয়ার তালিকায় ছিলাম। কিন্তু তিনটা আলাদা সময়েই ক্লাবে কেউ আমার জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আমাকে রেখে দিতে চেয়েছে। এটা সৃষ্টিকর্তারই পরিকল্পনা।
আমি দেখতে খুবই রোগা কিন্তু সবসময় ‘চোখে রক্ত’ নিয়ে খেলি। এ ধরনের তীক্ষ্মতা আসে রাস্তা থেকে। এটা আপনি নকল করতে পারবেন না। মানুষ ভাবে হয়তো তাদের মিথ্যা বলেছি যে সাও পাওলোতে অভিষেকের পরও বস্তিতে থাকতাম।
একটুও মিথ্যা বলিনি- এটাই সত্যি যে ১৮ বছর বয়স অবধি বাবার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতাম। হোক তা পাটি অথবা খাট! আমাদের হাতে কোনো বিকল্প ছিল না। আরে ভাই এমনকি ২০১৯ সালেও যখন করিন্থিয়াসের বিপক্ষে পাউলিসতার ফাইনালে গোল করলাম, সরাসরি পাশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। লোকজন আমাকে রাস্তায় দেখে বলতো, ‘তোমাকে মাত্রই তো টিভিতে দেখলাম। এখানে তুমি কী করছো?’ ‘ভাই, আমি এখানেই থাকি। বলার পর সবাই হাসতো। তারা বিশ্বাস করতো না।
এক বছর পর আমি আয়াক্সে গেলাম, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেললাম। এরপর দ্রুত সব বদলে গেল। আমার কেবল নিজের বিছানাই না, লাল রঙের ওই রেঞ্জ রোভারও হলো। মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে তাকে বললাম, দেখেছো? আমি তোমাকে বলেছিলাম কিনবো। কিনেছি।
১০ বছর বয়সে আমি যখন তাকে কথাটা বলেছিলাম, হেসেছেন। এখন যখন মনে করিয়ে দিলাম, তখন? কেঁদেছেন। বস্তি থেকে আয়াক্স এরপর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে গিয়েছি। সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে কীভাবে এত দ্রুত ভাগ্য বদলে ফেললাম। সত্যি বললে এর কারণ হচ্ছে ফুটবল মাঠে আমি কোনো চাপই অনুভব করি না। কোনো ভয়ও না। ভয়? আরে কীসের ভয়? যখন আপনি মৃতদেহের উপর দিয়ে লাফিয়েছেন কেবল স্কুলে যাওয়ার জন্য; তখন আপনি ফুটবলের কোনো কিছুতে আর ভয় পেতে পারেন না। আমি যেসব জিনিস দেখেছি, বেশিরভাগ ফুটবল বোদ্ধা তা কল্পনাও করতে পারে না।
জীবনে দুর্ভোগ গেছে যথেষ্ট। চিন্তাও করেছি অনেক। কম কান্না করিনি। কিন্তু ফুটবলে? পায়ে বল থাকলে আনন্দ অনুভব করা উচিত। আমি ড্রিবলার হিসেবে জন্মেছি, এটাই আমার মূল। আমাকে বস্তি থেকে থিয়েটার অব ড্রিমসে নিয়ে এসেছে। আমি কখনো আমার খেলার ধরন বদলাবো না, কারণ এটা কোনো স্টাইল না; এটাই আমি। ব্রাজিলিয়ানদের গল্পের অংশ।
যদি আপনি আমার ১০ সেকেন্ডের ক্লিপ দেখেন, কখনো বুঝতে পারবেন না। আমি কোনো কিছুই মজা করে করি না। সবকিছুর একটা উদ্দেশ্য আছে। দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া, প্রতিপক্ষের মনে ভয় ধরানো, জায়গা তৈরি করা, দলের জন্য ব্যবধান গড়ে দেওয়া।
যদি আপনার আমাকে ভাঁড় মনে হয়, তাহলে আপনি আমার গল্প বোঝেননি। রোনালদিনহো, ক্রিস্তিয়ানো, নেইমাররা আমাকে বাচ্চা বয়সে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমি চুরি করা ওয়াই-ফাই দিয়ে তাদের ভিডিও দেখেছি বিস্ময় নিয়ে। এরপর কংক্রিটের পিচে গিয়ে চেষ্টা করেছি নিজে করতে।
এমনকি জাহান্নামে জন্মেও, স্বর্গ থেকে পাওয়া একটা উপহার ছিল এটা। যখন আমাকে লোকজন জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার স্টাইলের মানে কী? কী মেসেজ পাঠাতে চাও?’ ভাইয়েরা, আমি আমার জন্মস্থানে মেসেজ পাঠাই।
ইউরোপে প্রতি রাতে টেবিলে ব্রেড থাকে, কখনো কখনো মানুষজন ভুলে যায় ফুটবল কেবলই একটা খেলা। সুন্দর খেলা কিন্তু তারপরও শুধুই খেলা। সিরিয়াস ব্যাপার হচ্ছে জীবন, বিশেষত আমার মতো যারা ছোটখাটো জাহান্নামে জন্মেছে তাদের জন্য।
আমি সবসময় বলি যেখানেই যাই না কেন জীবনের, যা কিছুই হোক। আমি ওই জায়গার প্রতিনিধিত্ব করি যেটা আমাকে সবকিছু শিখিয়েছে। আমার ঘর, আমার মানুষেরা ছাড়া এসব কিছুতেই যায়-আসে না।
প্রতি ম্যাচের আগে বুট পরার সময় নিজেকে একটা কথা মনে করিয়ে দেই, ‘বস্তি। যখন জুতার ফিতা লাগাই, আমার মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে সবকিছু। এটা আমার গল্প। যদি এখনও আমাকে বুঝতে না পারেন, যদি আমাকে ভাঁড় মনে হয়, তাহলে আমার বাহুর লেখা দেখিয়ে দেবো…যারাই বস্তি থেকে এসেছে, কিছুটা হলেও জানে কীসের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। এসব শব্দ আমার হয়ে হয়ে কথা বলে। আমাদের সবারও।