রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১২:২৪ পূর্বাহ্ন

বৈষম্যমূলক আচরণকে ‘দণ্ডনীয় অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করার আহ্বান

ভয়েসবাংলা প্রতিবেদক / ৭২ বার
আপডেট : রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২২

বাংলাদেশে যে ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ প্রতিনিয়ত ঘটে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বৈষম্যমূলক আচরণকে ‘দণ্ডনীয় অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করতে হবে বলে মনে করেন এই আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলেন, কোনও আইনে ‘ক্রিমিনাল প্রভিশন’ না থাকলে এটি প্রকৃতপক্ষে আইন হয় না।

রবিবার (১৭ এপ্রিল) প্রস্তাবিত বৈষম্যবিরোধী আইনের উল্লেখযোগ্য অংশগুলো নিয়ে অনুষ্ঠিত এক ওয়েবিনারে এসব কথা উঠে এসেছে। ওয়েবিনারে অংশ নেন আইনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন প্রণেতা, বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা। ওয়েবিনারের আয়োজন করে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)।

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপ্রধান শহীদুজ্জামান সরকার। তিনি আয়োজকদের এই অনুষ্ঠানের সব সুপারিশমালা স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে পাঠানোর অনুরোধ করেন। যাতে করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতে পারেন।

উল্লেখ, নাগরিক সমাজ, আইন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বৈষম্যবিরোধী আইনের খসড়ায় বৈষম্যমূলক আচরণকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করা হয়েছে এবং পাশাপাশি ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু উপস্থাপিত বিলে শাস্তির কোনও বিধান রাখা হয়নি।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দলিত নেতা মিলন বিশ্বাস বলেন, ‘উপযুক্ত কারণ ছাড়া পিতৃ বা মাতৃ পরিচয় প্রদানে অসমর্থতার কারণে কোনও শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি, অমত বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা বাধা প্রদান করা যাবে না’ বলে আইনে যা বলা হয়েছে—তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। কোন কোন কারণে কোনও শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানানো যাবে বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে, তা সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। নয়তো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ কখনওই শিক্ষায় সমান সুযোগ পাবে না।

এমজেএফ-এর নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম অনুষ্ঠানটি পরিচালনাকালে বলেন, মানুষের মনোজগতে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা না গেলে, আইন করেও কোন লাভ হবে না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টি করা। আইনের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষ যেন বিচার পায়, সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।

এসডিজি প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অনেকেই বলেন আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু আমি বলতে চাই, আইন তখনই কার্যকর হয়, যখন রাজনৈতিক ইচ্ছা দৃশ্যমান হয়, দক্ষ প্রশাসন থাকে এবং নাগরিকদের পক্ষ থেকে সক্রিয় মনিটরিং করা হয়। তিনি বলেন, আইনে বৈষম্যের তালিকাটি আরও প্রসারিত ও সামগ্রিক করতে হবে।

চাকমা সার্কেলের চিফ রাজা দেবাশীষ বলেন, আইনটিতে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন কনভেনশনের ১০৭ ও ১১১ ধারা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এখানে আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে।

সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, ‘এই খসড়া আইনটি আমার কাছে খানিকটা অপেশাদার বলে মনে হয়েছে। মনিটরিং কমিশন নিয়েও আমি সন্দেহ পোষণ করছি। কারণ, এখানে সব শ্রেণি-পেশার লোকের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়নি। এছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় নাই। এটা একটা কাঠামোগত ত্রুটি। ফলে বিচারের জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে ছুটে বেড়াতে হবে।’

আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রংও একটি শক্তিশালী মনিটরিং কমিটি গঠনের কথা বলেন। নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী প্রধান জাকির হোসেন বলেন, যে খসড়া আইনটি প্রথমে প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেখানে ”বৈষম্য বিলোপ বা নিরসন” কথাটি ছিল। এখন বলা হচ্ছে ”বৈষম্য বিরোধী আইন”। এই সংজ্ঞাটি স্পষ্ট হওয়া দরকার।

যৌনকর্মী নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বলা হয়, মায়ের পেশার কারণে যৌনকর্মীদের শিশুরা মূলধারার স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় না। আইন প্রণয়ন বিষয়ক কমিটিতে যৌনকর্মীদের প্রতিনিধিত্ব নেই। একই অভিযোগ এসেছে হিজড়া, তৃতীয় লিঙ্গ বা ট্রান্সজেন্ডার কমিউনিটির পক্ষ থেকে। ২০২০ সালে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনও সুযোগ তারা পাচ্ছেন না।

আইনটিতে বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কোনও বৈধ পেশা বা চাকরি গ্রহণ বা বৈধ ব্যবসা পরিচালনায় নিষিদ্ধ করা যাবে না। তাহলে যৌনকর্মীর পেশা বা ব্যবসা কেন অবৈধ বলে গণ্য হবে তা সুনির্দিষ্ট করতে হবে। আইনের মারপ্যাঁচে এখনও বৈধ-অবৈধের মাঝখানে রয়ে গেছে। কাজেই ব্যাখ্যা দিয়ে এগুলো সুস্পষ্ট করার কথা বলেন বক্তারা।

বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্টের পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, সেবা প্রাপ্তিতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নানারকম বৈষম্যের শিকার হয়। যেমন, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি পাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে। বৈষম্যের সংজ্ঞাকে আরও ব্যাপকভাবে দেখতে হবে। এর কারণ ও মনিটরিং কমিটির কার্যপরিধি নিয়ে ভাবতে হবে। রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনাগুহ ঠাকুরতাও এই আইনের পরিধি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন।

উল্লেখ, এমজেএফ বৈষম্যবিরোধী আইনের খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে ২০০৮ সাল থেকে জড়িত। সঙ্গে ছিল রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ, নাগরিক উদ্যোগ, বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ, আদিবাসী ফোরাম, ব্লাস্টসহ ১৫টি দলিত সংগঠন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর