রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:৩২ পূর্বাহ্ন

‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান সেলিম খান কারাগারে

ভয়েসবাংলা প্রতিবেদক / ১৪৬ বার
আপডেট : বুধবার, ১২ অক্টোবর, ২০২২

গত ১ আগস্ট সেলিম খানের বিরুদ্ধে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। মামলায় বলা হয়, সেলিম অবৈধ উপায়ে ৩৪ কোটি ৫৩ লাখ ৮১ হাজার ১১৯ টাকার সম্পদ তাঁর জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণভাবে অর্জন করে নিজ ভোগদখলে রেখেছেন। এ ছাড়া তিনি ৬৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪৭৭ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। সেলিম যে সম্পদের বিবরণী দাখিল করেছেন, তা যাচাই-বাছাই করে অসংগতি পাওয়া গেছে।

ওই মামলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট সেলিম খানকে চার সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। এ সময়ের মধ্যে তাঁকে ঢাকার বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। পরে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে দুদক। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ২০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশ স্থগিত করেন। একই সঙ্গে আসামি সেলিম খানকে ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণ করার আদেশ দেন।

চাঁদপুর জেলার সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জনস্বার্থে নৌপথ সচল করার কথা বলে সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বালু তুলছেন সেলিম খান। বর্তমানে ছোট ও বড় প্রতিটি ড্রেজার দিয়ে দিনে ২০ থেকে ৪০ হাজার ঘনফুট বালু ও মাটি তোলা হচ্ছে। প্রতিটি ড্রেজারে ২০ হাজার ঘনফুট তোলা হলে ২০০ ড্রেজারে দিনে বালু উঠছে ৪০ লাখ ঘনফুট। মাসে তোলা হচ্ছে ১২ কোটি আর বছরে ১৪৪ কোটি ঘনফুট বালু।

ড্রেজার ও বালুর ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে তোলা বালু বর্তমানে প্রতি ঘনফুট বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে তিন টাকা। আড়াই টাকা হিসাবে দুই নদী থেকে দিনে এক কোটি টাকার বালু বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে মাসে বালু বিক্রি হচ্ছে ৩০ কোটি টাকার। বছরে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬০ কোটিতে। ২০১৫ সাল থেকে এই টাকার একটি কানাকড়িও সরকারের ঘরে যাচ্ছে না। গত আট বছরে কমবেশি ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা সেলিম খানের পকেটে ঢুকেছে।

‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান তিনি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, যে পদ্ধতিতে বালু তোলা হচ্ছে, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে নদীর বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। দুই পাড় ভেঙে যাচ্ছে।
অঞ্জনা খান মজলিশ জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর

চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সেলিম খান উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা দেখিয়ে নদী থেকে আগ্রাসী কায়দায় বালু তুলছেন।জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, যে পদ্ধতিতে বালু তোলা হচ্ছে, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে নদীর বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। দুই পাড় ভেঙে যাচ্ছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে তিনি চিঠি দেবেন।

সেলিম খান যে পদ্ধতিতে বালু তুলছেন, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে তা নিষিদ্ধ। এই আইন বলছে, নদীতীর ভেঙে যেতে পারে এবং মৎস্য ও জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে সেখান থেকে বালু ও মাটি তোলা নিষিদ্ধ।

কে এই সেলিম খান

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান। বর্তমানে তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। সর্বশেষ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে ৯ জন সদস্যসহ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন তিনি। ওই ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, সেলিমের পারিবারিক অবস্থাও তেমন সচ্ছল ছিল না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে জেলা বিএনপির প্রভাবশালীদের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন তিনি। এর আগে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে সখ্য তৈরি করেন সেলিম খান। এর পর থেকেই ধীরে ধীরে বালু তোলার একচ্ছত্র সম্রাট বনে যান সেলিম। উল্লেখ্য, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি চাঁদপুর–৩ (সদর–হাইমচর) আসনের সাংসদ।

সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণে সেলিম খানের নাম নতুন করে আলোচনায় আসে। অভিযোগ উঠেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাব করা জায়গার বড় অংশটি নামে-বেনামে কিনে নেন তিনি। এসব জমির দলিল করতে গিয়ে মৌজা দরের চেয়ে ২০ গুণ বেশি মূল্য দেখানো হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে কৌশলে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেওয়াই এর কারণ। যাঁদের কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়েছে, তাঁরা নামমাত্র টাকা পেয়েছেন বলে অভিযোগ।

বালুর ব্যবসায় নামার পর সেলিম খানের বিপুল সহায়-সম্পত্তি নিয়ে এলাকায় নানা কথা প্রচার আছে। বালুমহালের টাকা দিয়ে সিনেমায় লগ্নি করেছেন তিনি। এরই মধ্যে তাঁর প্রযোজিত একাধিক সিনেমা মুক্তিও পেয়েছে। ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানকালে সেলিমের নাম আলোচনায় আসে। যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সেলিম কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।

মন্ত্রীর ১৫ চিঠি

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেলিম খান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বালু তোলার কাজ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত—সাত বছরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অন্তত ১৫টি ডিও লেটার (আধা সরকারি পত্র) দিয়েছেন। এসব চিঠিতে সেলিমের ছেলে ও ভাইয়ের নামের প্রতিষ্ঠানকেও বালু তোলার কাজ দিতে সুপারিশ করেছেন মন্ত্রী।

সর্বশেষ গত বছরের আগস্টে সেলিম খানের ছেলের নামের প্রতিষ্ঠান শান্ত এন্টারপ্রাইজকে ৮ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট বালু ও মাটি তোলার অনুমতি দিতে অনুরোধ করেছেন দীপু মনি। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেওয়া চিঠিতে শিক্ষামন্ত্রী দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনব্যবস্থা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে দেশীয় প্রযুক্তির ড্রেজার দিয়ে বালু তোলার অনুমতি দিতে অনুরোধ করেন।

জেলা আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা বলেন, ২০০৯ সালের আগে দরপত্রের মাধ্যমে বালু তোলার কাজ বণ্টন করা হতো। সরকারও রাজস্ব পেত। কিন্তু ধীরে ধীরে তা সেলিম খানদের দখলে চলে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সেলিমের মধ্যে কী এমন মধু আছে যে তাঁকেই নিয়মবহির্ভূতভাবে সব দিয়ে দেওয়া লাগবে, বুঝি না।

নদী থেকে বালু তোলার বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে ডিও লেটার দেওয়ার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে গত ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর মন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়েরের কাছে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। ওই দিনই ই-মেইলের মাধ্যমে জানানো হয়, মন্ত্রী ঢাকার বাইরে আছেন। ১ মার্চের মধ্যে লিখিতভাবে জবাব দেবেন। এ সময়ের মধ্যে জবাব না পেয়ে তথ্য কর্মকর্তার সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে উল্টো জানতে চান, এখনো জবাব পাননি? আপনাকে তো মন্ত্রী জবাব দেবেন বলে জানিয়েছেন।

পরে তিনি বলেন, মন্ত্রী ঢাকার বাইরে আছেন। তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। পরে গতকাল দিবাগত ১২টা ২২ মিনিটে ই–মেইলের মাধ্যমে মন্ত্রীর বক্তব্য পাঠান তথ্য কর্মকর্তা। এতে দীপু মনি বলেন, ‘চাঁদপুর–৩ আসনের সাংসদ হিসেবে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। নদীর নাব্যতা রক্ষার্থে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের নৌ ও ফেরি চলাচলের সুবিধার্থে ড্রেজিং করা জরুরি মনে করে জনস্বার্থে ডিও লেটার প্রদান করেছি। বিআইডব্লিউটিএর হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ চার্টের নির্ধারিত স্থান থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু/মাটি উত্তোলন করা হয়, সরকারকে সকল প্রকার রাজস্ব প্রদান করে।

কারও কাছে তথ্য নেই

নদীপথ সচলের নামে ডুবোচর থেকে সেলিম খান এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ বালু তুলেছেন, সে তথ্য চাঁদপুর জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারের কোনো দপ্তরে নেই। জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, তিনি ২০২১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর এ হিসাব চাইলে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে আরও কী পরিমাণ মাটি ও বালু তুলতে হবে, সেই হিসাব তাঁকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কী পরিমাণ বালু তোলা হয়েছে, সেই তথ্য পাননি।

চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন ছয় ব্যক্তি বলেন, প্রথমে ২০১৪ সালে একটি মহলের প্রভাবে সেলিম খানের ভাই বোরহান উদ্দিনকে ৫০ লাখ ঘনফুট বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। পরের বছর সেলিম খানও বালু তোলা শুরু করেন। কিন্তু কী পরিমাণ বালু তোলা হয়েছে, সে তথ্য কেউ জানে না।

জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, সেলিম চেয়ারম্যানের বাইরে পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে কেউ বালু তুলতে পারছেন না। কেউ চেষ্টা করলেও তাঁদের ড্রেজার তিনি জব্দ করানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁর পরিচিত এক ব্যক্তির দুটি ড্রেজার আটক করে রাখা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে নামে-বেনামে যত ড্রেজার আছে, সব কটির নিয়ন্ত্রণ সেলিম চেয়ারম্যানের হাতে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরাও চাই অবৈধভাবে বালু তোলা বন্ধ হোক। নিয়মের মধ্য থেকে দরপত্র আহ্বান করে অন্যদেরও সুযোগ দেওয়া হোক।

কানাকড়িও পাচ্ছে না সরকার

সেলিম খান খেয়ালখুশিমতো বালু তুললেও ২০১৫ সাল থেকে সরকার এক টাকাও রাজস্ব পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। ২০ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আসে।

জেলা প্রশাসক বলেন, ২০১৪ সালে সেলিমের ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের চুক্তি ছিল, প্রতিদিন কত বালু তোলা হচ্ছে, তা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) তত্ত্বাবধান করবেন। কিন্তু ২০১৫ সালে আদালতের কাগজ দেখিয়ে সেলিম খান তাঁর প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজের নামে বালু তুলছেন। কিন্তু কারা বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবে, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে কোনো চুক্তিপত্র বা নথি নেই।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নদী থেকে বালু তোলার বিনিময়ে রাজস্ব হিসেবে ২০০৮ সালে জেলা প্রশাসনকে প্রতি ঘনফুটের জন্য ২৫ পয়সা, ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৩ শতাংশ আয়কর বাবদ মোট ১৮ শতাংশ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছেন সেলিম খান। এর বাইরে একই কাজের জন্য বিআইডব্লিউটিএকে প্রতি ঘনফুট বালুর জন্য ১৫ পয়সা হারে টাকাও দিয়েছেন। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন হওয়ার পর নদী থেকে বালু তোলার কাজটি দেখভালের দায়িত্ব বর্তেছে জেলা প্রশাসকের কাছে।

২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সেলিম খান অন্তত ১ হাজার ১৫২ কোটি ঘনফুট (বছরে ১৪৪ কোটি ঘনফুট হিসাবে) বালু তুলেছেন। জেলা প্রশাসনকে প্রতি ঘনফুটে ২৫ পয়সা করে রাজস্ব দিলে সরকারি কোষাগারে জমা পড়ত ২৮৮ কোটি টাকা। এর বাইরে ভ্যাট ও আয়কর বাবদ টাকা তো রয়েছেই।

জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি সেলিম খান জেলা প্রশাসনকে এক চিঠি দিয়ে বালু তোলার রাজস্ব হিসেবে ৯ কোটি ১৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা জমা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। জবাবে জেলা প্রশাসন বলেছে, আদালতের আদেশের পর জেলা প্রশাসন থেকে সর্বশেষ ২০১৯ সালের মার্চ মাসে কার্যাদেশ দেওয়া হলেও প্রায় চার বছর পর কেন সেলিম খান রাজস্ব দিতে চাইছেন, তাঁর কাছে এর উত্তর চাওয়া হয়েছে।

নির্দ্বিধায় বালু তোলার নেপথ্যে যা

প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা ও জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, নদীতে ডুবোচর সৃষ্টির কারণে নৌপথে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে—এই কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে সেলিম খান নিজ খরচে জনস্বার্থে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কাছে আবেদন করেন। নদীর তলদেশে কোথায় কত দূরত্বে মাটি রয়েছে, তা আধুনিক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা বা এর মানচিত্র তৈরি করা হয় হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে। ডুবোচর কাটতে হলে প্রথমে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে হয়।

সেলিম খানের ওই আবেদন মঞ্জুর হলে তিনি হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ শেষে নদী থেকে এককভাবে বালু তুলতে যান। তখনই প্রশাসন থেকে কেবল এক ব্যক্তিকে নদী থেকে বালু তোলার বিষয়ে আপত্তি তুললে সেলিম খান যান উচ্চ আদালতে। সেখানে তিনি নিজ খরচে জরিপকাজ শেষ করার যুক্তি দেখিয়ে বালু তোলার অনুমতি চান। পরে আদালতের একটি আদেশে তাঁকে ৩০ কোটি ৮৪ লাখ ঘনফুট বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরে এই আদেশ দেখিয়েই বালু তুলছেন তিনি।

চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সেলিম খানকে যেহেতু এ নিয়ে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না, তাই তিনি ইচ্ছেমতো নদী থেকে বালু তুলছেন। এসব বিষয়ে জানতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সেলিম খানের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি প্রশ্ন শুনে ‘সরি সরি’ বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিছুক্ষণ পর কল করলে আর ধরেননি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ চেয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বালু তোলার জন্য সেলিম খান ২০১৫ সালে রিট মামলা দায়ের করেন। ২০১৮ সালে তিনি বালু তোলার অনুমতি পেয়েছেন। তবে ২০১৫ সাল থেকেই তিনি বালু তুলে আসছেন। মামলার কারণে ওই তিন বছর জেলা প্রশাসন কোনো দরপত্র আহ্বান করতে পারেনি।

বিপর্যস্ত পরিবেশ, হুমকিতে শহর

২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনকে দেওয়া এক চিঠিতে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলায় জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। চিঠিতে বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বাছবিচারহীনভাবে নদী থেকে বালু তোলার কাজ বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে চাঁদপুর শহর ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। গত ২০ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসনের আয়োজনে মাসিক উন্নয়ন ও সমন্বয় সভায় এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

বিআইডব্লিউটিএর চাঁদপর জেলার উপপরিচালক কায়সারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কেবল চাঁদপুরেই নয়, যেকোনো নদ-নদী থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু তোলা হলে পাশের শহর হুমকির মধ্যে পড়বে। নদ-নদী থেকে বালু তোলার কাজে বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যে ড্রেজার ব্যবহার করে, সেটি বোমা ড্রেজার নামে পরিচিত। এর দাপ্তরিক নাম সাকশন ড্রেজার। এই ড্রেজারের মাধ্যমে নিয়ম মেনে কখনোই মাটি ও বালু তোলা হয় না বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়ের ড্রেজিং শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বলেন, বোমা ড্রেজার দিয়ে পানির তলদেশ থেকে একটি জায়গা থেকে ৭০-৮০ ফুট গভীর পর্যন্ত বালু তোলা হয়। এতে আশপাশের জায়গা ভেঙে পড়ে। একপর্যায়ে এটি তীরে গিয়ে ভাঙনের সৃষ্টি করে।

এভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশকে হুমকির মধ্যে ফেলে বালু উত্তোলন কি চলতে থাকবে, জানতে চাইলে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘আদালতের রায় পর্যালোচনা করে দেখেছি, সেলিম খানকে ডুবোচর থেকে বালু তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বালু বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়নি। এতে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাঁর বালু তোলার প্রক্রিয়াটিও আইনানুগ হচ্ছে না। বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানানো হবে।

মন্ত্রী–ঘনিষ্ঠদের দুর্নীতির জাল

গত ২৭ সেপ্টেম্বর সেলিম খান আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। আদালত দুই পক্ষের শুনানি নিয়ে আজ (১২ অক্টোবর) আবার জামিনের পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছিলেন। দুপুরে সেলিম খান আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে জামিনের পক্ষে তাঁর আইনজীবী শাহিনূর ইসলাম আদালতে বক্তব্য তুলে ধরেন। অন্যদিকে, দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান জামিনের বিরোধিতা করে বক্তব্য তুলে ধরেন। উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে আদালত আসামি সেলিম খানের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

মুহম্মদ শফিকুর রহমান, আওয়ামী লীগের সাংসদ, চাঁদপুর-৪ আসন

সরেজমিনে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় লোকজন থেকে এসব জমি নেওয়া হয়েছে অনেকটা জোর করে। এ ক্ষেত্রে কাউকে নামমাত্র দাম দেওয়া হয়েছে। কাউকে আবার জমি অধিগ্রহণের টাকা হাতে পেলে জমির দাম পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কেবল কৃষিজমির মালিকদের কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে। এই কাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছেন ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। তিনি চাঁদপুরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

এ–সংক্রান্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৩ একরের বেশি (২৩০৫ শতাংশ) জমির দলিল হয়েছে চেয়ারম্যান সেলিম খান ও তাঁর স্বজনদের নামে। এর মধ্যে সেলিম খানের ছেলে শাহিন খানের নামে ৪৪১ শতাংশ, শান্ত খানের নামে ৪২৮ শতাংশ, মেয়ে সেলিনা বেগমের নামে ৪৩০ শতাংশ ও পিংকি আক্তারের নামে ১৭৩ শতাংশ; সেলিম খানের নিজ নামে ৩৬২ শতাংশ, তাঁর প্রতিষ্ঠান মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজের নামে ১১৮ শতাংশ এবং তাঁর কর্মচারী জুয়েলের নামে ৩৫৩ শতাংশ জমি কেনা হয়।

সেলিম খান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি ফিল্ম সিটি করার জন্য নিজ এলাকায় আগে থেকেই জমি কিনে আসছেন। সেখানে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হবে—এই খবর তিনি জানতেন না। সেখানে একক নামে সর্বোচ্চ জমি নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ভাই জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ। তাঁর নামে দলিল হয় ৫৬৮ শতাংশ (৫.৬৮ একর) জমির। মন্ত্রীর মামাতো ভাই ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলামের নামে দলিল হয়েছে ১৬১ শতাংশ জমির। মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত চাঁদপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আইয়ুব আলীর নামে কেনা হয় ৯৩ শতাংশ এবং মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (রাজনৈতিক) টুটুল মজুমদারের নামে ৩৭ শতাংশের দলিল হয়েছে।

জাওয়াদুর রহিম দাবি করেন, তিনি হাসপাতাল ও বৃদ্ধাশ্রম বানানোর জন্য কিছু জমি কিনে দিতে সেলিম খানকে অনুরোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জায়গা নির্ধারণ ও প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ার অনেক আগে থেকেই তিনি অল্প অল্প করে জমি কেনা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু যখন দেখলাম ওখানে আর হাসপাতাল ও বৃদ্ধাশ্রম করা হবে না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জায়গা নেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে পড়ে গেছে। অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী আমার ছোট বোন, সুতরাং এখান থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া উচিত নয়। তাই গত বছরের ডিসেম্বরে আমার ক্রয়কৃত জমি বিক্রি করে দিই।

তবে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভূমি অধিগ্রহণ কমিটি গত বছরের মে মাসে যখন আগের এক বছরের জমি কেনাবেচার দলিল বিশ্লেষণ করে, তখন সেখানে জাওয়াদুর রহিমের নামে ৫৬৮ শতাংশ জমি কেনার দলিল পেয়েছে। পরে সেই জমি তিনি হস্তান্তর করেছেন কি না, সে তথ্য জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। ফরিদগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বলেন, যাতে দ্রুতগতিতে বিশ্ববিদ্যালয় হয়, সে জন্য পরিকল্পনা করে কাজে গতিশীলতা আনতে তাঁরা একসঙ্গে জমি কিনেছেন। তিনি দাবি করেন, কারও কাছ থেকে জোর করে জমি কিনিনি। সেখানে জমি কিনলে কিছু ব্যবসা হবে। ব্যবসার জন্য জমি কিনেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জায়গা ঠিক করার পর জমি কিনেছেন বলে জাহিদুল ইসলাম দাবি করলেও বাস্তবে তিনি জমি কিনেছেন ভূমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদনের আগে।

জেলা প্রশাসনের পর্যালোচনা

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া আইন মন্ত্রিসভা থেকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন পায় ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর। জাতীয় সংসদে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হয় ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয় ২০২১ সালের ৬ এপ্রিল। আর মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলটি নিজেদের নামে জমিগুলোর দলিল করে নেন ২০২০ সালের ১৮ মে থেকে এক বছরের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে সেসব জায়গাই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য নির্ধারণ করে অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে জানায়।

জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা বলছে, ওই এলাকার প্রকৃত মৌজা দর ধরে জমি অধিগ্রহণের দাম নির্ধারণ করলে সাড়ে ৬২ একরের জন্য (মূল দামের তিন গুণ ধরে) সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ১৯৪ কোটি টাকা। কিন্তু হঠাৎ উচ্চ মূল্য দেখিয়ে যেসব দলিল করা হয়েছে, সেটা আমলে নিলে সরকারকে ৫৫৩ কোটি টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ সরকারকে অতিরিক্ত দিতে হবে ৩৫৯ কোটি টাকা।

বিষয়টি নিয়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠান গত ১৬ নভেম্বর। তাতে বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত বছরের ৬ এপ্রিল চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সদর উপজেলার ১১৫ নম্বর লক্ষ্মীপুর মৌজার ৬২ দশমিক ৫৪৯০ একর ভূমি অধিগ্রহণের অনুমোদন দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১১ এপ্রিল জমির দাগসূচি চূড়ান্তকরণ করে অধিগ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব পায় জেলা প্রশাসন। কোন জমি অধিগ্রহণ করা হবে, সেটা নির্বাচন করেছে প্রত্যাশী সংস্থা; অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই মৌজায় সাবরেজিস্ট্রি অফিসের নির্ধারিত বাজারমূল্য অনুযায়ী নাল শ্রেণি প্রতি শতাংশ জমির দাম ১৩ হাজার ৮০২ টাকা। বিভিন্ন শ্রেণির ভূমির জন্য সাবরেজিস্ট্রি অফিসে সংরক্ষিত সর্বশেষ ২০১৬ সালে নির্ধারিত মৌজা দরের তুলনায় অধিগ্রহণের জন্য সংগৃহীত মূল্যহার ‘চরম অস্বাভাবিকভাবে বেশি’ (২০.৪ গুণ) দেখা যায়। এটা বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়–সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর।

এটাকে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ অবস্থায় ‘চরম অস্বাভাবিক’ দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হতো। একই সঙ্গে মানুষ ভূমি হস্তান্তরসহ এ–সংক্রান্ত বিষয়ে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতো। তাই ‘অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে সম্পাদিত’ দলিল ছাড়া ওই মৌজার অন্যান্য সাফ কবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ওই জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রায় ১৯৪ কোটি টাকার প্রাক্কলন করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসনের দুজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জেলা প্রশাসনের প্রাক্কলন সংশোধন করে বর্ধিত দরে প্রাক্কলনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট খারিজ হয়। এরপর সেলিম খান আরেকটি রিট করেছেন।

চাঁদপুর জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, জমি অধিগ্রহণে কত টাকা লাগবে, সে বিষয়ে প্রাক্কলন তৈরি করে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। তাঁর এ প্রাক্কলনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করেছেন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা। যেহেতু আদালতে এ নিয়ে মামলা রয়েছে, তাই এ নিয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি নন।

‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করবেন না’

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র বলছে, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য নির্বাচন করে দেওয়া হয়েছে মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। ভূমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক অনুমোদনের চার মাস আগে লক্ষ্মীপুর মৌজায় কয়েকটি জমির দাগ নম্বর উল্লেখ করে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্বাচন করতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান। সেই আবেদনের ওপর সুপারিশও করেছেন শিক্ষামন্ত্রী।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় হবে এমন কথা বলে সেলিম খান জোরপূর্বক সাধারণ মানুষের জমিতে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করেন। তিনি জমির মালিকদের কম টাকা দিয়ে বেশি মূল্য উল্লেখ করে দলিল করে নেন এবং কেউ কেউ এখনো টাকা পাননি বলেও অভিযোগ আছে।

এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করে সেলিম খান বলেন, জমি কেনার সময় বিশ্ববিদ্যালয় হবে জানতেন না। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ওই জমি নিতে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন কেন? এ প্রশ্ন করা হলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সেলিম খান। ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করবেন না। আমরা জমির ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। তাই এই জমি সরকারকে দেব না। এ নিয়ে আর কোনো কথা নেই।

চেয়ারম্যানের ভয়ে তটস্থ লোকজন

সম্প্রতি সরেজমিনে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে গেলে চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিষয়ে ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। একাধিক বাসিন্দা জানান, মানুষের জমি দলিল করে নেওয়ার পর এলাকায় পাহারা বসিয়েছেন সেলিম খান।

জমির বিক্রেতাদের মধ্যে ১১ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদক দেখা করলে কথা বলতে রাজি হন ৮ জন। তবে পত্রিকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে। এমনই একজন জমির মালিক বলেন, মাটি ভরাটের আগে চেয়ারম্যান জমির মালিকদের ডেকে নিয়ে বলেছেন, “জমিটা লাগবে দেন, না দিলেও নিয়ে যাব।” এমন কথা শুনে মানুষ ভয়ে জমি দিয়ে দিয়েছে। এসব জমির দখল নেওয়ার পর কেউ টাকা পেয়েছেন। কেউ পাননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলে জোর করে জমি লিখে নেওয়া হয়েছে জানিয়ে আরেক জমির মালিক বলেন, আমাকে বলা হয়েছে, যা টাকা দিয়েছি নিলে নে, না দিলে ফেরত দে। এই ‘ভূমি অধিগ্রহণ–বাণিজ্যে’ ঘনিষ্ঠ লোকদের যুক্ত থাকার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর মন্ত্রীর বক্তব্য জানতে চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়েরের কাছে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয় ২৩ জানুয়ারি। গতকাল বুধবার পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। গতকাল সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে তথ্য কর্মকর্তা মুঠোফোনে বলেন, আমি মন্ত্রী মহোদয়কে জানিয়েছি। তিনি উত্তর দেননি।

সমালোচনায় আওয়ামী লীগের নেতারাও

এই অধিগ্রহণ–বাণিজ্য নিয়ে সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা করে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ নিজ বাসায় নেতা-কর্মীদের নিয়ে এক সভায় বলেন, নদীর পারে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। এই সুযোগে শিক্ষামন্ত্রীর লোকজন জায়গাজমি কিনে বড় অঙ্কের টাকা লোপাটের পরিকল্পনা করেছেন।

গতকাল চাঁদপুর প্রেসক্লাবে জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, দীপু মনি ও তাঁর পরিবারকে জড়িয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। সংবাদ সম্মেলনে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. ইউসুফ গাজী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তা নির্ধারণে জড়িত তহশিলদার, ভূমি অফিস, উপজেলা অফিস, এডিসি রেভিনিউ অফিস, জমি অধিগ্রহণ কমিটি এবং এদের সবার মূল জেলা প্রশাসক। তাঁদের পরামর্শেই চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।

এদিকে এই ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে চাঁদপুর-৪ আসনের (ফরিদগঞ্জ) সরকারি দলের সাংসদ মুহম্মদ শফিকুর রহমান গত মঙ্গলবার একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে কলাম লিখেছেন। তাতে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ৫০০-৬০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছিল অবাধে। এর পেছনে যেহেতু খোদ শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ও তাঁর ভাই-বেরাদর জড়িত, তাই কেউ মুখ খুলছিল না।’ এই বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ মুহম্মদ শফিকুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তথ্য–প্রমাণের আলোকে সবকিছু লিখেছি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর