রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন

বংবং মার্কোস: চীনের জন্য আশীর্বাদ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিব্রতকর

ভয়েসবাংলা প্রতিবেদক / ৬৬ বার
আপডেট : বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০২২

স্বৈরশাসক পরিবারের ক্ষমতায় ফেরার নজিরবিহীন ইতিহাস রচনা করেছে ফিলিপাইনের মার্কোস পরিবার। প্রায় চার দশক আগে জনগণের বিক্ষোভের মুখে বাবা ফার্দিনান্দ মার্কোস সিনিয়র ক্ষমতা ও দেশত্যাগ করেছিলেন। সেই মার্কোসের ছেলে বংবং ডাকনামে পরিচিত ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র সোমবারের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন। তার এই জয় দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বিশ্লেষকদের ধারণা, মার্কোসের শাসনামলে বর্তমান বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দুই শক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইনের সম্পর্ক পুনর্নির্ধারিত হতে পারে। মার্কোস জুনিয়র বেইজিংয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক চাইতে পারেন।

ফিলিপাইনের সাবেক স্বৈরশাসক মার্কোস সিনিয়রের পুত্র জুনিয়র মার্কোসের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। দক্ষিণ চীন সমুদ্রের বিতর্কিত জলসীমা নিয়ে বেইজিংয়ের সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে চাইবেন তিনি।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মার্কোস জুনিয়রের সম্পর্ক কিছুটা জটিল। হাওয়াইয়ের এক জেলা আদালতকে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানানোয় যুক্তরাষ্ট্রে আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত তিনি। ১৯৯৫ সালে ওই আদালত মার্কোস পরিবারকে সিনিয়র মার্কোসের শাসনামলে আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের দুইশ’ কোটি লুটের অর্থ পরিশোধের নির্দেশ দেয়।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম কেন্দ্রে রয়েছে ফিলিপাইন। দক্ষিণ চীন সমুদ্রে মালিকানার দাবি রয়েছে ফিলিপাইনের। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদসমৃদ্ধ এই জলসীমার ওপর নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবি করে বেইজিং। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা তা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের অধীনে গঠিত একটি ট্রাইব্যুনাল চীনের দাবির বিষয়ে ফিলিপাইনের পক্ষে রায় দেয়। ওই জলসীমার দ্বীপগুলোতে চীনের সামরিক স্থাপনা নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দাবিদার রাষ্ট্রগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। তবে নির্বাচনি প্রচারণার সময়ে এক সাক্ষাৎকারে মার্কোস জুনিয়র বলেন, ওই আদালতের রায় ‘কার্যকর নয়’, কারণ চীন তা মানে না। তিনি বলেন, মতপার্থক্য নিরসনে তিনি চীনের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে চাইবেন।

ডিজেআরএইচ রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মার্কোস বলেন, ‘আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রবেশের সুযোগ দেন, তাহলে চীনকে শত্রু বানানো হবে। আমার মনে হয় আমরা (চীনের সঙ্গে) একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবো। প্রকৃতপক্ষে, চীনা দূতাবাসের মানুষেরা আমার বন্ধু। আমরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছি।’

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বুধবার বলেন, দুই দেশ ‘জলসীমার ওপারে একে অপরের মুখোমুখি, দীর্ঘকালের ঐতিহ্যবাহী বন্ধু’ এবং চীন আসন্ন প্রেসিডেন্টের অধীনে ‘ভালো প্রতিবেশী সুলভ আচরণের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’ রয়েছে। ট্রাইব্যুনালে ফিলিপাইনের আইনি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অ্যান্টনিও কারপিও। তিনি মনে করেন, মার্কোসের অবস্থান ‘বিশ্বাসঘাতকতা’। বলেন, ‘তিনি ফিলিপাইনের বিরুদ্ধে চীনের পক্ষ নিয়েছেন।’

ম্যানিলাভিত্তিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রোম্মেল বানালোই বলেন, মার্কোস চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চান। তবে তা কোনও ভূখণ্ড প্রদানের বিনিময়ে নয়। তার মতে, ‘মতপার্থক্য নিরসনে তিনি চীনের সঙ্গে সরাসরি এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য উন্মুক্ত। পশ্চিম ফিলিপাইন সাগরে তিনি প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের উন্নয়নসহ চীনের সঙ্গে বাস্তবসম্মত সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো খুঁজে দেখতে ইচ্ছুক’। দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ রয়েছে। তবে এটিও দাবি করে থাকে চীন। গত কয়েক বছরের মধ্যে এই এলাকায় দুই দেশের জাহাজের মধ্যে সংঘাতও হয়েছে।

‘প্রিয় স্মৃতি’

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রোম্মেল বানালোই বলেন, মার্কোস নিজের উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো কর্মসূচি বাস্তবায়নে চীনা বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে আগ্রহী। তিনি বলেন, ‘মার্কোসদের চীন ভ্রমণের খুব প্রিয় স্মৃতি রয়েছে।’

১৯৮৬ সালের আগ পর্যন্ত ২০ বছর ফিলিপাইন শাসন করেন মার্কোসের বাবা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। তবে ১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি চীনের সঙ্গে নিবিড় হওয়া শুরু করেন। এর এক বছর পূর্বে ওই সময়ে ১৮ বছরের জুনিয়র মার্কোস তার মা ইমালদার সঙ্গে এক ঐতিহাসিক ভ্রমণে বেইজিং সফর করেন। সেই সফরের মাধ্যমেই কূটনৈতিক দূরত্ব নিরসনের পথ সুগম হয়। সফরের ফুটেজে দেখা যায়, চীনের নেতা মাও সেতুংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন তরুণ মার্কোস জুনিয়র।

পরবর্তী সময়ে বহু সফর হলেও সেটাই ছিল প্রথম। উইকিলিকস-এর ফাঁস করা ২০০৭ সালের মার্চে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় মার্কিন দূতাবাসের তরফে বলা হয়, মার্কোস ‘বাণিজ্য সম্প্রসারণে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বারবার পিআরসি (চীনের সরকারি নাম) ভ্রমণ করেন।

ওই তারবার্তা লেখার একমাস পর ফিলিপাইনের লাওয়াগ শহরে কনস্যুলেট স্থাপন করে চীন। মার্কোস পরিবারের শক্তঘাঁটি হিসেবে পরিচিত প্রদেশ ইলোকোস নোরটের প্রাদেশিক রাজধানী লাওয়াগ শহর। ১১ কোটি জনসংখ্যার দেশে লাওয়াগ শহরের বাসিন্দা মাত্র এক লাখ দুই হাজারের মাত্র। রাজধানী ম্যানিলার বাইরে মাত্র দুটি কনস্যুলেটের একটি লাওয়াগ শহরে।

‘বলপ্রয়োগ এবং আগ্রাসন’

এই অঞ্চলে চীনের ‘বলপ্রয়োগ ও আগ্রাসন’ মোকাবিলায় গত কয়েক মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ফিলিপাইনে ব্যস্ততা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্চ ও এপ্রিল মাসে পাঁচ হাজারের বেশি মার্কিন সামরিক কর্মকর্তা ফিলিপাইনে সামরিক মহড়ায় অংশ নেন। যা গত সাত বছরের মধ্যে বৃহত্তম মহড়া।

ম্যানিলার দে লা স্যালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক রেনাটো ক্রুজ ডি ক্যাস্ট্রো বলেন, কৌশলগত বাধ্যবাধকতার কারণে ফিলিপাইনের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুয়ার্তে পুরনো ঔপনিবেশিক শত্রুতা সত্ত্বেও ওয়াশিংটনের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পরই দুয়ার্তে ফিলিপাইনকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার এবং চীনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার আহ্বান জানান।

বিশ্লেষক রেনাটো ক্রুজ ডি ক্যাস্ট্রো বলেন, ‘দুয়ার্তে বুঝতে পেরেছিলেন, আপনি চীনকে খুশি করুন বা চ্যালেঞ্জ করুন, তাতে কিছু যায় আসে না। তারা এখনও আপনার সামুদ্রিক অঞ্চল দখল করার চেষ্টা করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মার্কোসের কিছু সমস্যা থাকতে পারে (কিন্তু) তিনি তার আমলা এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবেন, যারা সত্যিই জোটকে গুরুত্ব দেয়।’

মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক সংবাদ সম্মেলেন বলেন, ফিলিপাইনের নির্বাচনের ফলাফল কিংবা সম্পর্কের ওপর প্রভাব নিয়ে মন্তব্য করার সময় এখনও আসেনি। তবে তিনি যুক্ত করেন, ‘আমরা আমাদের বিশেষ অংশীদারিত্ব পুনর্বিন্যাস করতে এবং ম্যানিলার নতুন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি’। ফিলিপাইনে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ওপর ওয়াশিংটন নজর রাখা অব্যাহত রাখবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

গত ১৫ বছর যুক্তরাষ্ট্রে যাননি মার্কোস। কারণ, তিনি এবং তার মা যুক্তরাষ্ট্রে আদালত অবমাননা এবং ৩৫৩ মিলিয়ন ডলার জরিমানার মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে রয়েছেন। মামলাটি দায়ের করা আইনজীবী রবার্ট সুইফট জানান, দুইশ’ কোটি ডলারের বাইরে মার্কোস এবং এবং তার মাকে এই জরিমানা করা হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া ৯ হাজার ৫৩৯ জন ব্যক্তিকে এই অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়। এরমধ্যে মাত্র ৩৭ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা গেছে।

ফিলিপাইনের সাংবাদিক অ্যান্থনি তাবেরনাকে গত আগস্টে মার্কোস বলেন, ‘কেউ ভাবতে এবং বলতে পারে, ঠিক আছে, আসুন এই ব্যক্তিকে জেলে দেই। আমরা আর এই ঝুঁকি নিতে পারি না।’

প্রেসিডেন্ট হিসেবে মার্কোসের যুক্তরাষ্ট্র সফরের পরিকল্পনা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তার এক মুখপাত্র। সফর করলে মার্কোস কূটনৈতিক দায়মুক্তি পাবেন কিনা এমন প্রশ্নেরও কোনও জবাব দেয়নি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও বিচার মন্ত্রণালয়। তবে আইনজীবী রবার্ট সুইফট মনে করেন, মার্কোস প্রথাগত দায়মুক্তি পেতে পারেন। রয়টার্স অবলম্বনে


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর