রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৬:১৩ পূর্বাহ্ন

ঢাকাকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিচ্ছে জলবায়ু অভিবাসন

ভয়েসবাংলা প্রতিবেদক / ৪৮ বার
আপডেট : বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুনিয়ার বহু অংশে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ঘটনা ঘটছে। তবে সমুদ্রের কম উচ্চতা, ঘনবসতি এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর কারণে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বেশি নাজুক। গত কয়েক সপ্তাহের মৌসুমী বৃষ্টিপাত এই পরিস্থিতিকে আরও দৃশ্যমান করে তুলেছে। এই সময়ে অন্তত ৬০ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি বহু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বেড়েছে বড় নদীর পানি।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সমান আয়তনের দেশটিতে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বাস। দেশটিতে প্রায় এক কোটি জলবায়ু শরণার্থী রয়েছে। আর প্রতিদিন রাজধানী ঢাকায় যুক্ত হচ্ছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। আর এই তথ্য দিয়েছে মেয়র’স মাইগ্রেশন কাউন্সিল।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ১৫ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ২০ লাখ। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০১১ সালে রাজধানী ঢাকাকে দুই অংশে ভাগ করা হয়। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রতি সাত জনের মধ্যে একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে।

কড়াইল বস্তি অবস্থিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মধ্যে। সেখানকার মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার শহর জনবহুল, তবু আমি অভিবাসীদের ফিরিয়ে দিতে পারি না। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রতিবছর এক শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সালে বেড়েছে ৩.৩৯ শতাংশ। এই হিসাব সরকারের। তারপরেও অভিবাসী প্রবেশ থেমে নেই।

একটি অযাচিত সমস্যা

মিনাস আক্তার তার নিজ শহরের দিনযাপনের অভাববোধ করেন। রাবারের টিউবে প্রবাহিত পানি পান করে নিয়মিতভাবে সন্তানরা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়, ভাড়া আর খাবারের জন্য দাম দিতে হয়। কিন্তু তার নিজের শহরের কৃষি জীবনে ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ঢাকা নগরে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন তিনি। মাসে আয় করেন ছয় হাজার টাকা। করোনা মহামারি শুরুর পর কাজ হারান তিনি। তবে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘জানি না কোথায় যাব’।

ঢাকায় চাকরির সুযোগ খুঁজতে আসা জলবায়ু অভিবাসীদের কড়াইলের মতো অবৈধ বস্তির জীবন সহ্য করতে হয়। সেখানে বিশুদ্ধ পানি নেই এবং ড্রেনগুলোতে নিয়মিত ময়লা জমে থাকে। অবৈধ গ্যাস লাইনগুলো গলির মধ্য দিয়ে চলে গেছে আর বার্নার এবং শর্ট সার্কিট থেকে প্রায়ই আগুন লাগে। কিন্তু এর চেয়েও বেশি হুমকি হচ্ছে বস্তিটি যে ভিত্তির ওপর নির্মিত সেটা। মূলত ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে খালি উঁচু জমিতে নির্মিত বস্তিটি ধীরে ধীরে পানির কাছে আরও বিপজ্জনক নিচু এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে।

মিনাস আক্তারের দ্বিধা হলো ঢাকার বৃহত্তর দুর্দশার লক্ষণ—শহরের অবকাঠামো বিপর্যয়ের দিকে আগাচ্ছে। পানির উচ্চতা ক্রমে বাড়তে থাকায় কড়াইল বস্তি পানির নিচে চলে যাওয়া সময়ের ব্যাপার। ঢাকা এক অযাচিত সমস্যায় পড়েছে,’ বলেন সলিমুল হক। তিনি বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক। সলিমুল হক বলেন, অভিবাসীরা চাকরির সুযোগের জন্য ঢাকায় আসে এবং ঢাকার ভিড় কমানোর একমাত্র সমাধান হলো অভিবাসীদের অন্যত্র যেতে উৎসাহিত করা। তার সংস্থা প্রায় পাঁচ লাখ শরণার্থী ধারণ করতে পারে এমন ২৪টি শহর চিহ্নিত করেছে। অভিবাসী বান্ধব শহর নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ দুটি। প্রথমটি হলো প্রতিটি শহরে জলবায়ু প্রতিরোধী অবকাঠামো থাকতে হবে। দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর মোংলা এক্ষেত্রে অনুকরণীয় হতে পারে।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দরের শহর মোংলায় ২০১১ সালে জনসংখ্যা ছিল ৪০ হাজার। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ। শহরের রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় কাজের খোঁজে প্রতিদিনই যোগ দিচ্ছে অভিবাসী শ্রমিকরা। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে শহরে নির্মাণ করা হয়েছে সাত মাইল দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ। আর এর ড্রেনেজ সিস্টেম এমনভাবে করা হয়েছে যেন অতিরিক্ত পানি দ্রুত খাল দিয়ে সরে যেতে পারে।

দ্বিতীয় ধাপটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসীরা যেন শহরটিকে নিজেদের বলে মনে করে। সলিমুল হক বলেন, দুনিয়া জুড়ে শহরের আগের জনগোষ্ঠী এবং অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈরিতা রয়েছে এবং আমরা এটিই সমাধান করার চেষ্টা করছি’। অভিবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার কমানো কঠিন হলেও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষা ভালো সমতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয় সমাজে অভিবাসী পরিবারগুলোকে একীভূত করার জন্য, শহরগুলোতে অভিবাসী শ্রমিকদের শিশুদের জন্য স্কুল দিয়ে সাজানো দরকার বলে মনে করেন।

জলবায়ু ন্যায়বিচার

বাংলাদেশের অভিবাসী সংকট আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ বৈষম্যের একটি ছোট উপসর্গ – জলবায়ু অবিচার। ২০২০ সালে গড় বাংলাদেশিরা প্রায় ০.৫৬ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করেছে। এই তুলনায় গড়ে আমেরিকানরা করেছে ১৪.২৪ টন। তারপরেও বাংলাদেশ বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অবিরাম ঘূর্ণিঝড়, বর্ষা, বন্যা এবং হারিকেন উপকূলকে ক্ষয় করেছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ি-ঘর গ্রাস করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের গ্রাউন্ড জিরো

নিচু প্লাবনভূমির দেশ বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম নদী ব-দ্বীপগুলির মধ্যে একটি। জলবায়ু ঝুঁকির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে ধনী দেশগুলো ২০২০ সাল নাগাদ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলার পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা কোনও দিনই অর্জন করা যায়নি। গত বছর গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ ২৬ সম্মেলনের অন্যতম ইস্যু হয়ে ওঠে কে কত পরিমাণে অর্থ উন্নয়নশীল দেশগেুলোতে দেবে।

মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, কপ ২৬ এ বহু কথা হয়েছে। কিন্তু আমার সমাধান প্রয়োজন। আমার জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রয়োজন’। ২০১৯ সালে আতিকুল দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ঢাকা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে মোট সাড়ে ৯ কোটি ডলার তহবিল পেয়েছে। এই অর্থ ক্যালিফোর্নিয়ার জলবায়ু পরিবর্তন বাজেট ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের তুলনায় মাত্র ০.২ শতাংশ। ওইসিডি’র এক প্রতিবেদনে ধারণা দেওয়া হয়েছে, দাতা দেশগুলো ২০২৩ সালে ১০ হাজার কোটি ডলারের লক্ষ্যে পৌঁছাবে, কিন্তু বিশদ বিবরণ এখনও অস্বচ্ছ।

বন্যাবন্যা

এর বিপরীতে আরেকটি কার্ড জমা করে রেখেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয়বারের মতো তিনটি যোগ্যতার মানদণ্ড (আয়, মানব সম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দুর্বলতা) পূরণ করার পর দেশটি ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) গ্রুপ থেকে উন্নিত হতে প্রস্তুত। এই উন্নিত হলে বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং উন্নত হবে এবং আরও বেশি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। এছাড়া বাংলাদেশ বর্তমানে এলডিসি-নির্দিষ্ট যেসব তহবিল পাচ্ছে তাও বন্ধ হয়ে যাবে।

সলিমুল হক বলেন, ‘অনুদান দুর্বল করে দিচ্ছে। আপনি একবার অনুদান পেলে, আপনি অন্য ধরণের অর্থের সন্ধান করবেন না। এটা ভিক্ষুকরা করে। তাদের কোনও ইচ্ছা নেই। তাদের নিজস্ব কোনও সংস্থা নেই’। আরও সবুজ অর্থায়ন নিশ্চিত করতে চাইলে বাংলাদেশের শেখার অনেক কিছু আছে। কিন্তু এশিয়াজুড়ে অভিন্ন মান, বা শ্রেণিবিন্যাসের অনুপস্থিতি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাজারের বাধাগুলি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

অর্ধ শতাব্দী আগে যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার দেশটিকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন এটি অন্য দেশের সহায়তা ছাড়া টিকতে পারবে না। সলিমুল হক বলেন, আজকের বাংলাদেশ কিসিঞ্জারের মন্তব্য ভুল প্রমাণিত করেছে। দেশটিতে এখন একটি সমৃদ্ধশালী আবাসন বাজার, একটি ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং একটি বিকাশমান সাংস্কৃতিক চিত্র রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশাল অগ্রগতি করেছি এবং আমাদের এখনও অনেক দূর যেতে হবে’। ব্লুমবার্গ অবলম্বনে


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর