রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৮:৩০ পূর্বাহ্ন

ট্রিগার অনবরত চেপেছিলাম, কত রাউন্ড গুলি বের হয়েছে জানি না: আকাশ

ভয়েসবাংলা প্রতিবেদক / ২০৬ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০২২

মতিঝিলের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ বলেছে, আমি ট্রিগার অনবরত চেপেছিলাম, কত রাউন্ড গুলি বের হয়েছে জানি না। গুলি শেষ হয়ে যাওয়ার পর পিস্তল হাতে নিয়েই শামীমের মোটরসাইকেলে উঠি। আমার পুরনো মামলাগুলো থেকে রেহাই পেতে এই ঝুঁকি নিয়েছিলাম। এ কাজের জন্য কোনও টাকা দাবি করিনি। তারাও আমাকে টাকা দিতে চায়নি। তবে আমার সব মামলা শেষ করতে যত টাকা খরচ করা প্রয়োজন সবই দিতে রাজি হয়েছিল তারা। টিপু সাহেবের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনও শত্রুতা ছিল না’।

মঙ্গলবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে সে এই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। গত ২৭ মার্চ সকালে বগুড়া থেকে গ্রেফতারের পর সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে ঢাকার শাহজাহানপুর আমতলা এলাকার যানজটে গাড়িতে থাকা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় যানজটে রিকশা আরোহী কলেজ শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। আলোচিত এই ঘটনার দ্বিতীয় দিনে শুটার মাসুমকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশের খিলগাঁও জোনাল টিম। একই ঘটনায় দুই দিন আগে র‌্যাব হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে মতিঝিলের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুক ওরফে কানা ফারুকসহ চার জন গ্রেফতার হয়। এছাড়া অস্ত্রসহ মতিঝিল এলাকার আরফান উল্লাহ ওরফে দামাল নামে যুবলীগ নেতাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। মাসুমের স্বীকারোক্তিতে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় আরফান, শামীম, মানিক ও মুসার নাম উঠে এসেছে।

র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার চার জনর‌্যাবের হাতে গ্রেফতার চার জন

আলোচিত এই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে নেতৃত্ব দেওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহিদুর রহমান রিপন বলেন, ‘মূল শুটার গ্রেফতার হয়েছে। সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আমরা তার সহযোগীসহ অন্যদের গ্রেফতার করতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি।

আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মাসুম ওরফে আকাশ বলেছেন, গত ১৫ বা ১৬ মার্চ সন্ধ্যার পর শামীম আমার মোবাইল নম্বরে ফোন করে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে। কথোপকথনে সে আমাকে জানায়, যদি একটা কাজ করে দিতে পারি তাহলে আমি সব মামলার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাবো। আমি মামলার কারণে বাড়ি যেতে পারি না, বাবার সামনে দাঁড়াতে পারি না, আমার এই দুর্বলতার বিষয়টি শামীম জানতো। তার সঙ্গে আমার ৯-১০ বছরের সম্পর্ক। শামীমের এই প্রস্তাব পাওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করি, কী কাজ করতে হবে? তখন সে আমাকে বলে, একজন মানুষকে গুলি করতে হবে। আমি তখন জানতে চাই কাকে গুলি করতে হবে। সে তখন বলে নামটা পরে জানাবে।

গ্রাফিক্স ডিজাইনে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করা মাসুম উল্লেখ করেছে, ‘কয়েক দিন পর সন্ধ্যার দিকে শামীমের সঙ্গে কমলাপুরে তাদের বাসার সামনে আমার দেখা হয়। তখন সে তার ফোন থেকে মুসা নামের একজনকে কল করে আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। মুসা আমাকে জিজ্ঞেস করে, শামীম আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে কিনা। শামীমের সঙ্গে প্রথম দিন কথা বলার পর এবং মুসার সঙ্গে কথা বলার আগে আরেকবার শামীমের সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। সে সময় শামীম আমাকে বিস্তারিত বলেছিল। শামীম আমাকে বলেছিল, কমলাপুরে রূপালী ক্লাবে মুসা, মানিক, দামাল, শামীমসহ আরও চার-পাঁচ জন মিলে একটি বৈঠক করেছে। সেই বৈঠকে শামীমকে দায়িত্ব দিয়েছে মুসা। শামীম সেই দায়িত্ব থেকে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। শামীম আমাকে বলেছিল, টিপুকে গুলি করতে হবে। সে টিপুর পরিচয় বলেছিল। আমার সঙ্গে টিপুর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। তবে টিপু বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিল। আমি টিপুকে চিনতে পারি। আমি গুলি করলে আমার পুরনো মামলা-মোকাদ্দমা সংক্রান্ত সব ঝামেলা দূর করে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয় শামীম। তার ফোনের মাধ্যমে মুসার সঙ্গে কথা বলার সময় জানাই, শামীম আমাকে কাজের কথা বলেছে। মুসা আমাকে জানায়, আমাদের যা লাগে তা আমরা সময়মতো পেয়ে যাবো।’

পলাতক মুসা ও শামীমপলাতক মুসা ও শামীম

কিলিং মিশন বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মাসুম বলে, গত ২৩ মার্চ সন্ধ্যার দিকে কমলাপুর আইসিডির ওখানে একটি কালো করে অপরিচিত ছেলে বয়স অনুমান ৩০, উচ্চতায় খাটো এমন একজন এসে একটা বাইক,  একটা ব্যাগ এনে শামীমকে দিয়ে যায়। সে সময় আমি শামীমের পাশে ছিলাম। ব্যাগের মধ্যে একটা পিস্তল ছিল। ব্যাগটি ছিল ব্লু কালারের একটা ট্রালেভল ব্যাগ। সে ছেলের কাছ থেকে মোটরসাইকেল ও ব্যাগ নেওয়ার পর শামীম মোটারসাইকেলে উঠে চালু করে এবং আমি ব্যাগ নিয়ে পেছনে বসি। তারপর আমরা মোটরসাইকেল চালিয়ে টিপু সাহেব মতিঝিলে যেখানটায় সাধারণত বসে অর্থাৎ এজিবি কলোনী বাজারের গ্র্যান্ড সুলতান হোটেলের সামনে আসি। আমরা সেখানে আসার পরেই শামীমের মোবাইলে একটি মেসেজ আসে যে, টিপুকে সেখানে সেসময় পাওয়া যাবে না। এই মেসেজ পাওয়ার পর আমরা সেখানে দেরি না করে মোটরসাইকেল চালিয়ে গোড়ান ছাপড়া মসজিদের উল্টেপাশের গলিতে গিয়ে যে ছেলে আমাদের বাইক ও ব্যাগ দিয়েছিল তাকে বাইক ও ব্যাগ দুটোই দিয়ে দেই এবং  যে যার মতো চলে যাই।

আদালতে দেওয়া মাসুমের ভাষ্য, পরদিন অর্থাৎ ২৪ মার্চ সন্ধ্যার দিকে একই সময়ে একই জায়গায় গিয়ে একই ছেলের কাছ থেকে আমি ও শামীম মোটরসাইকেল ও ব্যাগ নেই। সেই ব্যাগে পিস্তল ছিল। তার কাছ থেকে মোটরসাইকেল ও ব্যাগ নিয়ে গত দিনের ন্যায় একইভাবে মেটারসাইকেল চালিয়ে আমরা দুইজন মতিঝিল এজিবি কলোনির একই জায়গায় যাই। আমি মোটরসাইকেলে পেছনে ব্যাগ হাতে নিয়ে বসা ছিলাম। শামীম মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল। আমরা এবার মতিঝিল এজিবি কলোনির গ্র্যান্ড সুলতান হোটেলের পাশে যেতেই দেখি টিপু সাহেব তার সাদা রঙের মাইক্রোবাসের ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসেছে। টিপু সাহেব উঠে বসার পরপরই তার গাড়ি স্টার্ট নেয়। আমরা পেছন পেছন তার গাড়ি অনুসরণ করতে থাকি। তার গাড়ি শাহজাহানপুর আমতলা রেল লাইনের সিগন্যালের একটু সামনে এসে দাঁড়ায়। যেখানে তার গাড়ি দাঁড়িয়েছিল তার একটু আগেই আমরা দেখতে পাই, সামনে জ্যাম আছে এবং তার গাড়ি সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। এই বিষয়টি লক্ষ্য করে শামীম একটু দূরেই রাস্তার রঙ সাইড দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে তার গাড়ির সোজা রোড ডিভাইডারের অপজিটে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি তখন মোটরসাইকেল থেকে নেমে যাই।’

হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে মাসুম আদালতকে বলে, ‘আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে রোড ডিভাইডার পার হয়ে হেঁটে এসে টিপু সাহেবের গাড়িতে টিপু সাহেব যে আসনে বসা ছিল সে সিটের পাশে তার গাড়ির জানালার কাঁচের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে নিয়ে তার খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে পিস্তলের ট্রিগার চেপে গুলি চালাই। আমি ট্রিগার চেপে ছিলাম এবং গুলি বের হচ্ছিল। কত রাউন্ড গুলি বের হয়েছে জানি না। গুলি শেষ হয়ে গেলে আমি পিস্তল হাতে নিয়ে যেভাবে এসেছিলাম সেভাবে গিয়ে শামীমের মোটরসাইকেলে উঠি। শামীম এবং আমি এরপর মোটরসাইকেল চালিয়ে গোড়ান ছাপড়া মসজিদের বিপরীত পাশের গলিতে গিয়ে অপরিচিত সেই ছেলেকে মোটরসাইকেল ও পিস্তলসহ ব্যাগটা ফেরত দেই। সেই ছেলে সেখানে আগে থেকেই আমাদের অপেক্ষায় ছিল। সেখানে শামীম ৫-৬ মিনিট থাকার পর চলে যায়।

মাসুম ওরফে আকাশ জানায়, শামীম চলে যাওয়ার পর আমার এক বন্ধু বাবুকে পাশেই পেয়ে বলি যে, আমি ঢাকার বাইরে একটু বেড়াতে যাবো। বাবুর বাড়ি ওই এলাকাতেই। তারপর বাবু তার বন্ধু সোহেলকে ফোন করে গাড়িসহ আসতে বলে। কারণ সোহেলের গাড়ি ছিল। সোহেলকে চিনতাম না। আমরা তিন জন মিলে সোহেলের গাড়ি নিয়ে সে রাতেই বগুড়ায় যাই। তারা এই ঘটনা জানতো না। তারা আমাকে বগুড়ায় নামিয়ে দিয়ে চলে আসে। আমি বগুড়ায় খাজা হোটেলে উঠি। খাজা হোটেলে থাকা অবস্থায় পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে।

গুলিতে নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং সামিয়া আফনানগুলিতে নিহত জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং সামিয়া আফনান

মাসুমের দাবি, ২০০৭ সালে রাজনৈতিক কারণে সে বেশ কিছু মামলায় জড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে। একটি মামলায় দুই মাস হাজতে ছিল সে। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর সে এলাকা ছেড়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকতো। সে আগেও মামলা থেকে রেহাই পেতে এমন ঝুঁকি নিয়েছিল।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মাসুম বলেছে, এই কাজের জন্য আমি কোনও টাকা দাবি করিনি। তারা আমাকে কোনও টাকা দিতেও চায়নি। তবে আমার মামলা শেষ করতে যা করার বা যত টাকা খরচ করার প্রয়োজন হবে তা তারা করতে রাজী ছিল। টিপু সাহেবের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল না। শুধু আমার মামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই কাজ করে নতুন মামলায় জড়িয়ে গেলাম।

টিপু হত্যার কারণ প্রসঙ্গে মাসুম বলেছে, টিপু সাহেবকে কেন গুলি করতে হবে এই বিষয়টি শামীমকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে সময় শামীম বলেছিল যে, বোচা বাবু হত্যা মামলার বাদিকে টিপু যথেষ্টভাবে আর্থিকসহ অন্যান্যভাবে সাপোর্ট করছিল। বোচা বাবু হত্যা মামলায় মাসু সাহে আসামী আছে। এছাড়া মতিঝিল কেন্দ্রীক অর্থ উপার্জন অর্থাৎ ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি কাজে মুসাসাহেব নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছিল। তার সাথে বিদেশে অবস্থানরত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান, ফ্রিডম মানিকদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তারা মুসা সাহেবকে সাপোর্ট করে। মতিঝিল কেন্দ্রিক ঠিকাদারি, চাঁদাবাজি কাজে টিপু সাহেব একটা বড় বাধা ছিল। এসব কারণে মুসা সাহেব টিপু সাহেবের ওপর রাগান্বিত ছিল।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর