এতে দলটিতে আবার ভাঙনের গুঞ্জন ছড়ালেও বিদিশাকে নিয়ে কোনো ‘মাথাব্যথা’ নেই বলেই জানালেন এরশাদের ভাই জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
সেনাপ্রধান থেকে ক্ষমতা দখল করে এরশাদ যে জাতীয় পার্টি গড়েছিলেন, তা তিন যুগে তিন বার ভেঙেছে। তবে এরশাদ নেতৃত্বাধীন অংশ বরাবরই শক্তিশালী থেকেছে।
ক্ষমতাচ্যুত এরশাদকে ২০০০ সালে বিয়ে করেন কবি আবু বকর সিদ্দিকের মেয়ে বিদিশা সিদ্দিক। সন্তান শাহতা জারাব এরিকের জন্মের পর সেই সংসার টুটে যায় ২০০৫ সালেই।
তখন এরশাদের দেওয়া চুরির মামলায় জেলেও যেতে হয়েছিল বিদিশাকে। আইনি লড়াই চালিয়ে এরিককে নিজের কাছে রাখেন এরশাদ।
দুই বছর আগে এরশাদের মৃত্যুর পর তার বাড়ি বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে উঠে পড়েন বিদিশা। তার ছেলে এরিককে ‘চরম অবহেলা করে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটানো হয়েছে’ বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
মাস দুয়েক আগে এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে এরিক জাতীয় পার্টির ‘নতুন কমিটি’ ঘোষণা করেন; যদিও তাকে রাজনীতি থেকে দূরেই রেখেছিলেন এরশাদ, আর দলেও তার কোনো পদ নেই।
এরিক তার সৎ মা সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে ‘নতুন কমিটি’র চেয়ারপার্সন ঘোষণা করেন। মা বিদিশার সঙ্গে রওশনের ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদকে (সাদ এরশাদ) কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন তিনি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে ঘোষণা করা হয় এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদের নাম।
দুই মাস আগে এই অনুষ্ঠানেই এরিক জাতীয় পার্টির ‘নতুন কমিটি’ ঘোষণা করেন।
দুই মা, ভাইকে নিয়ে জাতীয় পার্টির ‘নতুন কমিটি’ দিলেন এরিক
গত ১৪ জুলাই এরিকের সেই ঘোষণার পরপরই জাতীয় পার্টি জানায়, রওশন জাতীয় পার্টির চেয়ারপার্সন হতে চান না। এরশাদের মৃত্যুর পর রংপুরে তার আসনের এখনকার সংসদ সদস্য সাদ সরাসরি কোনো বক্তব্য দেননি।
এরপর দুই মাসে আর কোনো খবর না এলেও ‘নতুন কমিটি’ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নেতা বলেছেন, বিদিশার লক্ষ্য আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। আর সে লক্ষ্যেই তিনি, বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পুরনো নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। জাতীয় পার্টিরও জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতাও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদিশা সিদ্দিকের নতুন কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিত এবং বহিষ্কৃত অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এখন পদে আছেন এমন অনেকেই যোগাযোগ রাখছেন।
“তবে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে চাইছেন না। কারণ প্রকাশ্যে বললেই দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উত্তরের বিভিন্ন জেলার পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের সাথে বিদিশা যোগাযোগ করছেন বলে জানি। কেন্দ্রেরও অনেকে তার সাথে যোগাযোগ করছেন। আর তিনিও যোগাযোগ করছেন।”
১৪ বছর পর রংপুরে বিদিশা, এরশাদের কবরে শ্রদ্ধা
কী বলছেন বিদিশা?
বিদিশার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি পুরোমাত্রায় জাতীয় পার্টিতে যুক্ত হতে চাইছেন, আর একে তিনি বলছেন ‘দল পুনর্গঠন’। তিনি বলেন, দেখুন আমি কিন্তু কোনো পার্টি ঘোষণা করিনি। এটা জাতীয় পার্টির পুনর্গঠন। বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক মানুষ বহিষ্কার হয়, বঞ্চিত হয়। তাদের নিয়ে আমি দলকে পুনর্গঠন করতে যাই। এরা জাতীয় পার্টির দুঃসময়ের মানুষ। এরশাদ সাহেবের কর্মী। আমি তাদেরকে নিয়েই পথ চলতে চাই।
জাতীয় পার্টি এখন লাইফ সাপোর্টে: বিদিশা
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, ২০১৭ সালে ৫৮ দল নিয়ে একটি নির্বাচনী জোট করেছিলেন এরশাদ সাহেব। সেই জোট নিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান কিছুই করেননি। সেই জোটের অনেকগুলো দলের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তারাও আমার পাশে আছে। ওই দলগুলোর মধ্যে ইসলামিক ফ্রন্ট শুধু নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।
বিদিশা বলেন, “নির্বাচন তো অবশ্যই লক্ষ্য। কিন্তু সব কথা এখন বলাটা ঠিক নয়। আমাদের নিজস্ব কিছু চিন্তা-ভাবনা আছে। দল গুছিয়ে নেই, তারপর এসব বিষয় নিয়ে কথা বলব। জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে কারা কারা এই প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি।
রংপুরে ছেলেকে নিয়ে বিদিশা। ফাইল ছবি
বিভিন্ন জেলার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিশেষ করে রংপুরে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিদিশা বলেন, “শুধু একটা জেলা কেন। আমি সব জেলায় খোঁজ-খবর রাখছি। যোগাযোগ রাখছি। উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। প্রেসিডেন্ট পার্কে অনেকেই আসছেন।”
রওশন চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী নন: জাপা
চেয়ারপাসনের পদ নিতে রওশনের আগ্রহী নন বলে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে যে বক্তব্য এলেও বিদিশা মনে করেন, এরশাদের প্রথম স্ত্রীর ‘দোয়া’ তার উপর রয়েছে। দেখুন রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী। তিনি তো তার প্যাডে কোনো বিবৃতি দেননি। ওটা জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান দিয়েছে। ম্যাডামের (রওশন) দোয়া আমাদের সঙ্গে আছে।
রওশন এরশাদ
চেয়ারপারসন পদে জি এম কাদেরের থাকার বৈধতা নেই বলে দাবি করেন বিদিশা। বর্তমান চেয়ারম্যানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট হয়েছিলো কোর্টে। সেটার জবাব এখনও দেননি তিনি। তার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন আছে।
বিদিশা এরশাদ কথন
জাপায় জি এম কাদেরের ‘শেষ’ দেখছেন বিদিশা
‘মাথাব্যথা’ নেই কাদেরের
বিদিশার নতুন তৎপরতার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, “দেখুন বিষয়টা নিয়ে কথা বলার মতো কিছু নেই। আমি আগেও বলেছি, দেশের সংবিধান অনুযায়ী যে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন। রাজনৈতিক দল কেউ করলেই হবে না। নির্বাচন কমিশন থেকে সেই দলের নিবন্ধন নিতে হবে। আর এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান একই। এ ব্যাপারে আমাদের মাথাব্যথা নেই।
রওশন এরশাদ বর্তমানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন থাকায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এরশাদের বড় ছেলে সাদ এরশাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
এরিকের ঘোষিত কমিটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সাড়া দেননি।
নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিদিশা যোগাযোগ করছেন কি না- জানতে চাইলে এরশাদের জেলা রংপুরের জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “জাতীয় পার্টি তো একটাই। এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টি। সেই দলই আমরা করি। এর বাইরে আমরা কিছু চিনি না। কেউ যদি দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে কাজ করে তবে সংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
দ্বন্দ্ব বাঁধছে, বদলাচ্ছে সমীকরণ
সামরিক শাসক এরশাদ জাতীয় পার্টি চালাতেন তার ইচ্ছামাফিক। তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ মহাসচিব বদলাতেন যখন-তখন। সেজন্য দেখা যায়, তিন দশকে ডজনখানেক মহাসচিব পেয়েছে জাতীয় পার্টি। আবার এই মহাসচিবদের তিনজন নতুন জাতীয় পার্টিও গঠন করেন।
জাপা মহাসচিব: এই আছে, এই নাই
বিয়ের পর তেমনি জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীতে স্থান পান বিদিশা; আবার নিজের প্রথম স্ত্রী রওশনকে আগে থেকে সেই পরিষদে বসিয়ে রেখেছিলেন এরশাদ। এরশাদের জীবদ্দশায় রওশন-কাদের দ্বন্দ্বে বিদিশাকে জি এম কাদেরের পক্ষেই দেখা যেত। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর পর উল্টোচিত্র দেখা যায়।
ফিরোজকে নিয়ে এরশাদ-রওশন পাল্টাপাল্টি
ভাইকে উত্তরসূরি ঘোষণা করলেন এরশাদ
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর ছোট ভাই জি এম কাদের দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের আগেই বসে যান চেয়ারম্যানের আসনে। এরপর জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিতে দ্বন্দ্বে জড়ান ভাবি রওশনের সঙ্গে। তখন রওশনের নেতৃত্বে আলাদা কমিটির ঘোষণাও এসেছিল। পরে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকের পর চেয়ারম্যানের পদে থাকলেও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদটি রওশনকে ছেড়ে দিতে হয় কাদেরকে। এরপর ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির নবম কাউন্সিলে কাদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
এরশাদের বাড়ি প্রেসিডেন্ট পার্ক
জি এম কাদেরের আপত্তি উপেক্ষা করে ছেলে এরিক এরশাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পার্কে উঠে আসা বিদিশা দাবি করেন, তাকে ‘ভয়’ পাচ্ছেন এরশাদের ভাই।
এরিককে নিয়ে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে বিদিশার অভিযোগ
গত বছর বিদিশা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এখন যে চেয়ারম্যান এসেছে, তিনি নিজেই তো একজন বিতর্কিত চেয়ারম্যান। উনি এখন ক’দিন চেয়ারম্যান আছেন, সেটাই দেখার বিষয় অবশ্য। এটা আমরা দেখার অপেক্ষায় আছি।
রওশনকে গুলশানের একটি বাড়ি দিয়ে ছোট ছেলে এরিককে নিয়ে এরশাদ প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকতেন। এরিককে তিনি বিশাল সম্পত্তি দিয়ে গেলেও তার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করে দিয়ে যান। সেই ট্রাস্টি বোর্ডে রওশন, বিদিশা কিংবা জিএম কাদের কাউকে রাখেননি এরশাদ। বড় ছেলে সাদকেও রাখেননি। স্বজনদের মধ্যে শুধু এরিককে রেখে গেছেন সেই বোর্ডে।
কত সম্পদ রেখে গেলেন এরশাদ?
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কত টাকার সম্পত্তি রেখে গেছেন সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই কারও কাছেই; কোন সম্পত্তি তিনি কাকে দিয়ে গেছেন, তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।
তবে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি তার সম্পদের একটি অংশ ট্রাস্টে দান করেছেন এবং বাকিটা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে গেছেন বলে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ‘গরিব দেশের ধনী প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে পরিচিত এরশাদ ৯০ বছর বয়সে রোববার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান।
সেনাপ্রধান থেকে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে নয় বছর দেশ শাসনের পর ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের ক্ষমতা হারানোর পরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব নিয়ে ছিলেন এরশাদ।
আওয়ামী লীগের গত সরকারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের মর্যাদায় থাকার পর একাদশ সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন তিনি, তবে অসুস্থতার জন্য এই দায়িত্বে সক্রিয় হতে পারেননি।
শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ২৪ এপ্রিল নিজের স্বাক্ষর জাল ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কার কথা জানিয়ে বনানী থানায় জিডি করেছিলেন এরশাদ।
জিডিতে তিনি বলেন, “তার বর্তমান ও অবর্তমানে স্বাক্ষর নকল করে পার্টির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, দলের বিভিন্ন পদ-পদবী বাগিয়ে নেওয়া, ব্যাংক হিসাব জালিয়াতি এবং পারিবারিক সম্পদ, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য হাতিয়ে নেওয়া ও আত্মীয়-স্বজনদের জানমাল হুমকির মুখে রয়েছে। এ কারণে তিনি মনে করেন অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে কেউ যেন এমন অপরাধ করতে না পারে, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দরকার।”
থানায় জিডি করার পাঁচ দিন পর গত ২৯ এপ্রিল রাতে বনানীতে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এরশাদের কক্ষের লকার ভেঙে ৪৩ লাখ টাকা লুট হয়ে যায়।
গত রোজায় নিজের বারিধারার বাড়িতে এতিমদের সঙ্গে ইফতার অনুষ্ঠানে ছেলে এরিককে নিয়ে এইচ এম এরশাদ
এরশাদের উত্তরাধিকারদের মধ্যে রয়েছেন প্রথম স্ত্রী রওশন এরশাদের ছেলে রাহগির আল মাহি (শাদ এরশাদ), দ্বিতীয় স্ত্রী বিদিশার ছেলে শাহতা জারাব (এরিক এরশাদ)। বিদিশার সঙ্গে এরশাদের বিচ্ছেদ ঘটলেও রওশন স্ত্রী হিসেবে ছিলেন।
নিজের গড়া দল জাতীয় পার্টিতে উত্তরাধিকার হিসেবে ভাই জি এম কাদেরকে মনোনীত করে যান এরশাদ। দলে জ্যেষ্ঠ কো চেয়ারম্যান পদে রওশনও রয়েছেন।
কত সম্পদ ছিল এরশাদের?
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এরশাদ নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন, তাতে তিনি তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ১ কোটি ৭ লাখ টাকা।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, সংসদ সদস্য, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সম্মানী ও ব্যবসা থেকে তার এই অর্থ আসে বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। এছাড়া ব্যবসা থেকে তার আয় দেখান দুই লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা।
এরশাদ বছরে ১ কেটি ৫ লাখ টাকা বেতন-ভাতাদি বাবদ পেতেন। এরমধ্যে রাষ্ট্রীয় বিশেষ দূত হিসেবে সম্মানী ১৯ লাখ ৪ হাজার ৬৯৬ টাকা; সংসদ সদস্যের সম্মানী ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সম্মানী ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ১০ টাকা।
এরশাদ তার গুলশান ও বারিধারায় দুটি ফ্ল্যাটের দাম দেখিয়েছিলেন এক কোটি ২৪ লাখ টাকার কিছু বেশি।
এর বাইরে ৭৭ লাখ টাকা দামের একটি দোকান রয়েছে তার। স্ত্রীর গুলশানের দুটি ফ্ল্যাটের দাম ছয় কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর বাইরে বসুন্ধরায় একটি ফ্ল্যাট এবং ঢাকার পূর্বাচল ও রংপুরে ৫০ লাখ টাকার বেশি দামের দুটি জমি রয়েছে স্ত্রীর নামে।
ছয় মাস আগে নির্বাচনী হলফনামার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এরশাদের হাতে নগদ অর্থ ছিল ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৯৯৮ টাকা।
এছড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এরশাদের জমা ছিল ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬ টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের তিন একাউন্টে ৩ লাখ ৮২ হাজার ৮৩১ টাকা; ৮ লাখ ৫৮ হাজার ২১ টাকা এবং ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৩২ টাকা।
দুই একাউন্টে সোনালী ব্যাংকে ১৩ লাখ ৯৭ হাজার ৯৯৫ টাকা ও ২২ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৩ টাকা; ব্র্যাক ব্যাংকে ৭৩ হাজার ৩৪৩ টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকে ২৭ হাজার ৫২৪ টাকা ছিল এরশাদের।
এর বাইরে শেয়ারে অর্থের পরিমাণ ছিল ৪৪ কোটি ১০ হাজার টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এফডিআর ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা; ডিপিএস ৯ লাখ টাকা।
ক্ষমতায় থাকার সময় কিংবা ক্ষমতা হারানোর পরও রাজকীয় চালচলনে অভ্যস্ত ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
এরশাদের ৫৫ লাখ টাকা দামের ল্যান্ড ক্রুজার জিপ, ১৮ লাখ টাকা দামের নিশান কার এবং ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের আরেকটি ল্যান্ড ক্রুজার জিপ রয়েছে।
নিজের কোনো স্বর্ণালঙ্কার না থাকলেও ৩০ হাজার টাকা দামের ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও ৩০ হাজার টাকার আসবাব ছিল তার।
ব্যবসায় মূলধন আছে ১২ লাখ ৫১ হাজার ১৫৪ টাকা; জমির বিক্রি করে রয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
এরশাদের কোনো কৃষি ও অকৃষি জমি নেই। তবে ৭৭ লাখ টাকা দামের দোকান; বারিধারায় ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকা দামের ফ্ল্যাট এবং গুলশানে ৬২ লাখ টাকা দামের আরেকটি ফ্ল্যাটের কথা হলফনামায় লেখেন তিনি।
স্ত্রীর নামে ৩৩ লাখ টামা দামের রংপুরে এবং ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দামের জমি রয়েছে ঢাকার পূর্বাচলে।
পূর্বসুত্রে পাওয়া বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট রয়েছে এরশাদের। গুলশানের দুটি ফ্ল্যাটের একটির মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা; আরেকটির দাম ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
হলফনামায় এরশাদ ঋণ দেখিয়েছেন ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৮৯ টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ১ কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৬ টাকা।
যা যা দান করেছেন
এরশাদ তার সম্পত্তির কতটুকু কাকে দান করেছেন, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য জাতীয় পার্টির নেতারাও জানাতে পারেননি; তার পরিবারের সদস্যরাও এনিয়ে মুখ খোলেননি।
জাতীয় পার্টির একজন প্রভাবশালী নেতা বলেন, পাঁচ সদস্যের একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে এরশাদ তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সেখানে লিখিতভাবে দান করেছেন।
“তবে ট্রাস্টি বোর্ডে দান করা সম্পত্তির বর্ণনা দেননি এরশাদ, সেখানে শুধু দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।”
দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা স্ত্রী রওশন ও ভাই জিএম কাদেরকে ট্রাস্টি বোর্ডে রাখেননি এরশাদ। বড় ছেলে শাদকে না রাখলেও ছোট ছেলে এরিককে বোর্ডে রেখেছেন এরশাদ। এছাড়াও বোর্ডে আছেন এরশাদের একান্ত সচিব অবসরপ্রাপ্ত মেজর খালেদ আক্তার, চাচাতো ভাই মুকুল ও তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর।
ছেলে শাদ এরশাদকে নিয়ে স্বামী এইচ এম এরশাদের শয্যাপাশে রওশন এরশাদ
শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পর গত জানুয়ারি মাসে এরশাদ তার সমস্ত সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়েছেন বলে পার্টির আরেকজন নেতা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরশাদ তার বড় ছেলে শাদ এরশাদ, ছোট ছেলে এরিক, পালিত কন্যা জেবিন ও ভাই-ভাতিজার মধ্যে সম্পদ ভাগ করে দিয়েছেন।”
এছাড়া কিছু সম্পত্তি দলের নামেও এরশাদ লিখে দিয়েছেন বলেও ওই নেতা জানান।
জার্তীয় পার্টির একজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জানান, রংপুর সদরে কোল্ড স্টোরেজ ছাড়াও রংপুরের সব সম্পত্তি তার ভাই জি এম কাদের ও এক ভাতিজাকে লিখে দিয়েছেন এরশাদ।
গুলশান-২ এর বাড়িটি অনেক আগেই স্ত্রী রওশনকে দিয়েছেন তিনি। বারিধারার ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক’ তার সাবেক স্ত্রী বিদিশা এরশাদের একমাত্র ছেলে এরিক এরশাদের নামে দেওয়া হয়েছে। পালিত ছেলে আরমানকে দিয়েছেন গুলশানের অন্য একটি ফ্ল্যাট।
ঢাকার বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির প্রধান কার্যালয় এবং রংপুরের জাতীয় পার্টি অফিস দলকে দান করেছেন।
গুলশান বনানী এলাকায় কয়েকটি মার্কেটে এরশাদের বেশ কিছু দোকান থাকলেও সেগুলো কাকে লিখে দিয়ে গেছেন সে বিষয়ে এখনও কোনো তথ্য জানা যায়নি।