শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৮:০৯ অপরাহ্ন

গণতন্ত্র বিপন্নকারী অশুভ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে রূখতে হবে: সংসদে রাষ্ট্রপতি

ভয়েস বাংলা রিপোর্ট / ১৩ বার
আপডেট : শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে দলমত নির্বিশেষ দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আসুন, সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে প্রিয় মাতৃভূমি থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং যেকোনো উগ্রবাদ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড হতে দূরে থেকে কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনে শামিল হই। গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলে এমন যেকোনো অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রূখে দাঁড়াতে হবে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ক্ষমতায় যাওয়া বা পরিবর্তন আনার একমাত্র উপায় নির্বাচন। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও হিংসার রাজনীতি কখনো দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। বরং তা রাজনৈতিক পরিবেশকে তমসাচ্ছন্ন করে তোলে। সংঘাত ভুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে এসে গণতন্ত্রকে বিকশিত হতে আমাদের সকলের সহায়তা করা উচিত। রাজনীতি থেকে হিংসা-হানাহানি অবসানের মাধ্যমে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মহান সংবিধানের আলোকে বাংলাদেশের জনগণ নিরপেক্ষভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ ও বেগবান করবে- এটাই সকলের প্রত্যাশা।

স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুক্রবার (৭ এপ্রিল) জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তি, সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে শুরু হওয়া বিশেষ অধিবেশনে স্মারক বক্তৃতায় রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি আত্মমর্যাদাশীল, দেশপ্রেমিক জাতি হিসেবে আমাদের রয়েছে একটি অনন্য পরিচয়। সে পরিচয়কে আমাদের ঐকান্তিকতা, সততা ও কর্মনিষ্ঠা দিয়ে সমুন্নত রাখতে হবে। দেশের উন্নয়নে আমাদের চিন্তা, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমাদের মধ্যে সুগভীর ঐক্য থাকবে জাতীয় স্বার্থ ও দেশপ্রেমের প্রশ্নে। হিংসা-বিভেদ নয়, স্বার্থের সংঘাত নয়- আমাদের সামনে রয়েছে আজ দেশ গড়ার কাজ। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমরা গড়ে দিয়ে যাব একটি সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ- এই হোক আমাদের সকলের অঙ্গীকার।

জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীতে শুক্রবার ( ৭ এপ্রিল)  বিশেষ অধিবেশনটি ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদসহ সরকার ও বিরোধী দলের অধিকাংশ সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। মহান জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্তির দিনকে স্মরণীয় রাখতে ভিভিআইপি গ্যালারীতে সস্ত্রীক নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, দেশের বুদ্ধিজীবীগণ, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকগণ, সামরিক- বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিকেল তিনটায় সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। এর একটু পরেই বিউগলে রাষ্ট্রপতির আগম ধ্বনী বাজানো হয়। স্যুটকোর্ট পরিহিত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সংসদ অধিবেশনে প্রবেশ করা মাত্রই অক্রেস্ট্রায় জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়, সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানান। পরপর জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. আবদুল হামিদ তার শেষ ভাষণ দেন।

প্রায় পৌণে এক ঘণ্টার দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করলে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা তুমুল টেবিল চাপিড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। বক্তব্য শেষে রাষ্ট্রপতি অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করলে স্পীকার বিশেষ অধিবেশনের অবশিষ্ট কার্যাদি সম্পন্ন করেন।

রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেন, জাতীয় বীর, সাহসী সূর্যসন্তানেরা ল্কষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব এই দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা। গণতন্ত্র চর্চার প্রাণকেন্দ্র জাতীয় সংসদ। সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের সকল বিভাগের জবাবদিহীতার ক্ষেত্রে আদর্শ স্থাপনের গুরু-দায়িত্ব বর্তায় এ মহান সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্য’র ওপর। কেবল গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিতরাই সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব এবং জনগণের কাছে জবাবদিহীতা নিশ্চিত করতে পারে। এ বিষয়ে সরকারি ও বিরোধী উভয়পক্ষের সংসদ সদস্যগণই জাতির কাছে দায়বদ্ধ। এই উপলব্ধি থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, ব্যক্তিগত এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াসে সংসদ সদস্যদের গঠনমূলক, কার্যকর ও সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ফসলই হচ্ছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও আমাদের এই জাতীয় সংসদ। তাই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে এই সংসদকে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা দলমত নির্বিশেষে আমাদের সকরের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয় উল্লেখ করে রাষ্ট্রপ্রধান আরও বলেন, গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানিযোগ্য কোনো পণ্য বা সেবা নয়। মনে চাইলে কোনো দেশ থেকে পরিমাণমত গণতন্ত্র আমদানি বা রপ্তানি করলাম, বিষয়টি এমন নয়। চর্চার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র বিকশিত ও শক্তিশালী হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংসদের কার্যবাহে সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যেগুলো পড়লে বুঝা যায় সংসদকে কিভাবে প্রাণবন্ত ও কার্যকর করতে হয়। তিনি বলেন, পরমতসহিষ্ণুতা, বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া এবং অন্যকে কিভাবে সনম্মান দেয়া যায় এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় নজির রেখে গেছেন। আমাদের সৌভাগ্য আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিশ্বমানের কিংবদন্তি নেতা পেয়েছিলাম। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাকে ধরে রাখতে পারিনি। বঙ্গবন্ধু আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর নীতি-আদর্শ আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। তার দেখানো পথেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আরও বলেন, মহান জাতীয় সংসদের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। সময়ের এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা সকল সময় মসৃণ ছিঠল না। গণতন্ত্রের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা যখনই বাধাগ্রস্ত হয়েছে তখনই এর একটি প্রভাব পড়েছে জাতীয় সংসদের উপর। বিগত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। গত ১৪ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেক হাসিনার বলিষ্ঠ ও সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার সকল যোগ্যতা অর্জন করেছে। তারই নেতৃত্বে দেশের গণতন্ত্র আজ নিরাপদ ও সুরক্ষিত। বর্তমানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কোনো গোষ্ঠী বা অসাংবিধানিক শক্তির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সর্বোচ্চ এ প্রতিষ্ঠান জনগণের আশা ও আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে জনমত ও প্রত্যাশাকে ধারণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীলতা এবং দৈনন্দিন নাগরিক জীবনের জরুরি ও জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে, এটাই জনগণ আশা করে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, সমাজের সকল স্তরের নাগরিক, বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল, সংগঠনের চাওয়া-পাওয়া ও স্বার্থকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমন্বয়সাধন করতে হয় জাতীয় সংসদকে। সংসদ সদস্যগণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তারা অনেক আশা নিয়ে আপনাদের নির্বাচিত করেছেন যাতে তাদের কথা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা আপনারা সংসদে তুলে ধরেন। এটা আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্য এবং নীতি-আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো ভিন্নতা থাকতে পারে না। তাই আপনাদের প্রতি আমার আকুল আহ্বান- সংসদকে কার্যকর করতে ঐক্যবদ্ধ হোন।

রাষ্ট্রপ্রধান তার ভাষণে আরও বলেন, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একসঙ্গে চলে। দেশে গণতন্ত্র অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন ও অগ্রগতি এগিয়ে যায়। আবার গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নয়নকে স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত করতে হবে, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রহীন অবস্থায় যে উন্নয়ন হয় তা কখনো সার্বজনীন হতে পারে না। সে উন্নয়ন হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেই মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি বলেন, মাত্র সাড়ে তিন বছরে শূণ্য থেকে দেশকে একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু শহীদ না হলে দেশ অনেক আগেই উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতো। ’৭৫-এর পর উন্নয়ন ও গণতন্ত্র অনেকদিন অবরুদ্ধ ছিল। ফলে দেশ অনেক পিছিয়ে পড়ে। গত দেশ দশকে সরকার ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার ফলে দেশ উন্নতি ও অগ্রগতির পথে দ্রæত এগিয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের দায়িত্ব উন্নয়নের এই ধারাকে এগিয়ে নেয়া।

জাতির পিতার সান্নিধ্য পাওয়া প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচিত আইন প্রণেতা রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, যার পিঠে একবার বঙ্গবন্ধুর হাত পড়েছে বা স্নেহের ছোঁয়া লেগেছে তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু আমাকে মনোনয়ন না দিয়ে নিভৃত হাওরের আবদুর হামিদ হয়তোবা বিভৃতেই থেকে যেত। তাই রাষ্ট্রপতি হিসেবে নয়, বঙ্গবন্ধুর একজন আদর্শের সৈনিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেই আমি বেশি গর্ববোধ করি। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ডেপুটি স্পীকার হিসেবে মনোনয়ন না দিলে হয়তোবা কিশোরগঞ্জকে ঘিরেই আমরা রাজনীতি আবর্তিত হতো। বঙ্গবন্ধুর হাতে হয়েছিল আমার রাজনীতির হাতেখড়ি ও প্রথম উত্থান। আর ’৯৬তে দ্বিতীয় উত্থান ঘটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে এবং তারই উদ্যোগে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর