রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৪:১৭ পূর্বাহ্ন

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর বাংলায় ভাষণ : করোনা মোকাবিলায় অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান

ভয়েসবাংলা ডেস্ক / ৩৪০ বার
আপডেট : শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অতীতের যেকোনও সময়ের চেয়ে এখন আমাদের অনেক বেশি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈশ্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সব ধরনের মতভেদ ভুলে গিয়ে আমাদের অবশ্যই ‘অভিন্ন মানবজাতি’ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে; সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবার জন্য আবারও এক সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়ে তুলতে হবে। করোনাভাইরাসকে অভিন্ন শত্রু উল্লেখ করে তা মোকাবিলায় ছয়টি প্রস্তাব তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত পৌনে বারোটায় বাংলায় ভাষণ প্রদানকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন ।

আধা ঘণ্টাব্যাপী চলা এ ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, এই মহামারিও এমন একটি সঙ্কট যেখান থেকে বহু মানুষের টিকে থাকার অনুপ্রেরণামূলক এবং উদারতার উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখজনক হলেও এই মহামারি আরও বেশ কিছুদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, কোভিডমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিকার সার্বজনীন ও সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। গত বছর এ মহতী অধিবেশনে আমি কোভিড-১৯ টিকাকে ‘বৈশ্বিক সম্পদ’ হিসেবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। বিশ্বনেতাদের অনেকে তখন এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেছিলেন। কিন্তু সে আবেদনে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। বরং আমরা ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে টিকা বৈষম্য বাড়তে দেখেছি। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, এ যাবত উৎপাদিত টিকার ৮৪ শতাংশ উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের কাছে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, নিম্ন আয়ের দেশগুলো ১ শতাংশেরও কম টিকা পেয়েছে।

টিকা বৈষম্য দূর করার তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষকে টিকা থেকে দূরে রেখে কখনোই টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা পুরোপুরি নিরাপদও থাকতে পারবো না। সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত ও সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে প্রযুক্তি হস্তান্তর টিকার সমতা নিশ্চিত করার একটি উপায় হতে পারে। প্রযুক্তি সহায়তা ও মেধাস্বত্ত্বে ছাড় পেলে বাংলাদেশও ব্যাপক পরিমাণে টিকা তৈরি করতে সক্ষম।

 শেখ হাসিনা বলেন, এ মহামারি জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অধিকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক ‘ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’র ওয়ার্কিং গ্রুপ-১ এর প্রতিবেদনে আমাদের এ গ্রহের ভবিষ্যতের এক ভয়াল চিত্র ফুটে ওঠেছে। তিনি বলেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। ধনী অথবা দরিদ্র – কোন দেশই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে নিরাপদ নয়। তাই আমি ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, নিঃসরণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং টেকসই অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ও প্রযুক্তির অবাধ হস্তান্তরের আহ্বান জানাচ্ছি।

সরকার প্রধান বলেন, মহামারির প্রকোপে শিক্ষাব্যবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে আংশিক বা পুরোপুরি বিদ্যালয় বন্ধের কারণে বিশ্বের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোর লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর দূরশিক্ষণে অংশগ্রহণের সক্ষমতা ও প্রযুক্তি না থাকায় ভর্তি, স্বাক্ষরতার হার ইত্যাদি অর্জনগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল সরঞ্জামাদি ও সেবা, ইন্টারনেটের সুযোগ-সুবিধার সহজলভ্যতা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে। এ জন্য আমরা জাতিসংঘকে অংশীদারিত্ব ও প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনা মহামারির নজিরবিহীন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে রয়েছি। তবে, এ মহামারি অনেক দেশের উত্তরণের আকাঙ্ক্ষাকে বিপন্ন করেছে। স্বল্পোন্নত দেশের টেকসই উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আমরা প্রণোদনাভিত্তিক উত্তরণ কাঠামো প্রণয়নে আরও সহায়তা আশা করি। মহামারিকালে প্রবাসীরা অপরিহার্য কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি সেবাখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরাও সম্মুখসারির যোদ্ধা। তবুও তাঁদের অনেকে চাকরিচ্যুতি, বেতন কর্তন, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সামাজিক সেবার সহজলভ্যতার অভাব ও বাধ্যতামূলক প্রত্যাবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংকটকালে অভিবাসীগ্রহণকারী দেশগুলোকে অভিবাসীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার এবং তাঁদের কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং কল্যাণকে নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান করছি।

রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার পঞ্চম বছরে পড়লো। কিন্তু এখন পর্যন্ত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের একজনকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা ও অব্যাহত সহযোগিতা আশা করি। মিয়ানমারকে অবশ্যই তার নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করতে সদা প্রস্তুত। তিনি বলেন, বাংলাদেশে তাদের সাময়িক অবস্থানকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখতে কিছু সংখ্যক বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিককে আমরা ‘ভাষানচর’-এ স্থানান্তর করেছি। আশ্রয় শিবিরে কোভিড-১৯ মহামারির বিস্তাররোধে টিকালাভের যোগ্য সকলকে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি মিয়ানমারে, সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে নিরাপদ, টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই গঠনমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আসিয়ানের নেতারা বাস্তুচ্যূত মিয়ানমার নাগরিক ইস্যুতে গৃহীত প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করবেন বলে আশা প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়িদের জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে গৃহীত সকল কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করতে হবে।

সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। তৃণমূল পর্যায় থেকে আমাদের শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া, এ মহামারি মোকাবিলায় আমাদের সময়োচিত, সমন্বিত ও বহুমুখী উদ্যোগ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য রক্ষা করতে শুরুতে আমাদের বেশ কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। তিনি বলেন, অতি দরিদ্র, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন, বিদেশ-ফেরত প্রবাসী ও অসহায় নারীদের মতো সমাজের দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর জন্যে পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। গত বছর মহামারির প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে আমরা প্রায় ৪ কোটি মানুষকে নগদ অর্থসহ অন্যান্য সহায়তা দিয়েছি। সময়োচিত পদক্ষেপ ও আমাদের জনগণের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতার কারণে ২০২০ সালেও আমরা ৫ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।

বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার স্বপ্ন দেখে বলে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আফগানিস্তানের বিনির্মাণ এবং ভবিষ্যতের গতিপথ নির্ধারণ দেশটির জনগণের ওপরই নির্ভর করে। তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য দেশটির জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করে যেতে বাংলাদেশ প্রস্তুত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে শান্তি। ‘শান্তির সংস্কৃতি’ প্রস্তাবনার প্রধান প্রবক্তা হিসেবে আমরা শান্তিময় সমাজ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস উগ্রবাদের করাল থাবায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই আমরা সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ বজায় রেখেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শীর্ষস্থানীয় শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বৈশ্বিক শান্তিরক্ষায় অবদানের জন্য আজ আমরা গর্ববোধ করি। মহামারির নজিরবিহীন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বজুড়ে কঠিনতম পরিবেশে নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বজায় রাখতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের আলোকে আমরা সর্বদা সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের অবিচল সমর্থক। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, পারমাণবিক ও অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সম্পূর্ণ নির্মূলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এই প্রত্যয় থেকেই আমরা ‘পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি’ অনুস্বাক্ষর করেছি। এ বছরের শুরুতে চুক্তিটি কার্যকর হয়েছে। তিনি বলেন, করোনা মহামারি জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর বৈশ্বিক উদ্যোগের ঘাটতির বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। একইসঙ্গে এটি বৈশ্বিক সংহতি ও সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপরেও আলোকপাত করেছে। সার্বজনীন বিষয়গুলোতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নতুন নতুন অংশীদারিত্ব ও সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে ‌ওঠে বিভিন্ন অঞ্চলের সদস্য দেশগুলো এই জাতিসংঘের মঞ্চ থেকেই তা শুরু করতে পারে। তবেই আমরা সহনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অর্থবহ সহযোগিতা অর্জন করতে পারবো।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর