জনসংখ্যা সাথে সাথে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়া এবং দ্রুত বরফ গলতে থাকায় ঘন ঘন বড় ধরনের বন্যার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যে পরিমাণ মানুষের গৃহহীন হওয়ার শঙ্কার কথা বলা হচ্ছে, তার অর্ধেকই জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে। আর জনসংখ্যার বাড়ার কারণেও বাকি মানুষ ঘরহারা হবে বলে সম্প্রতি জেনেভাভিত্তিক ‘ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার’- আইডিএমসির গবেষক জাস্টিন জিনেত্তি জানিয়েছেন।
আইডিএমসির হেড অব ডেটা অ্যান্ড অ্যানালাইসিস জিনেত্তি বলেছেন, পূর্বাভাসে ঝুঁকির যে চিত্রটি এসেছে, সেটিকে আংশিক বলা যেতে পারে। কিন্তু বন্যার কারণে স্থানচ্যুত অর্ধেকের বেশি মানুষই আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে, যে পরিস্থিতিকে তিনি বর্ণনা করেছেন ‘ভয়াবহ’ হিসেবে।বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধির হার এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার যে পরিকল্পনা, বিভিন্ন দেশের সরকার যদি তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়, তাহলে বন্যার কারণে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বছরে দুই কোটিতে আটকে রাখা যেতে পারে। তিনি বলেন, জলবায়ুর কারণে স্থানচ্যুতি বিশ্বের জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আমাদের জন্য ভবিষ্যতে আবহাওয়ার আরও চরম অবস্থা বিরাজ করছে। সুতরাং ভবিষ্যৎ ঝুঁকির গুরুত্ব বোঝাটা আমাদের জন্য জরুরি- কেন এটা হচ্ছে, আমাদের কি করা উচিত।তিনি ঝড়ের কারণে কত মানুষ ঘরহারা হতে পারে, সে ব্যাপারেও একটি আভাস দেওয়ার জন্য আইডিএমসির গবেষণার ক্ষেত্র আরও বাড়ানো হবে বলে জানান।আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং দাবানলের কারণে গত এক দশকে প্রতিবছর দুই কোটির বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে। জলবায়ু হুমকি মোকাবেলায় বিশ্বনেতারা দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সমস্যা আরও প্রকট আকার নেবে বলে জনিয়েছে সংস্থাটি।
বন্যার কারণে মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়া ঠেকাতে ভালো কিছু উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন আইডিএমসির গবেষক জিনেত্তি। এর মধ্যে রয়েছে নগরায়নের এমন পরিকল্পনা, যেখানে নদীসংলগ্ন বন্যাপ্রবণ এলাকায় বসতি স্থাপনকে নিরূৎসাহিত করা হবে এবং ঝুঁকিতে থাকা মানুষজনকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে আরও বিনিয়োগ করা।এক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবেলায় দক্ষিণ এয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ এবং চীনের উদাহরণ টেনেছেন জাস্টিন জিনেত্তি। এসব দেশ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় ঝুঁকির মুখে থাকা তাদের লাখ লাখ নাগরিককে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার যে সক্ষমতা অর্জন করেছে, সে ধরনের পদক্ষেপ আফ্রিকার দেশগুলোতেও নেওয়া উচিত বলে তিনি মত দিয়েছেন।জিনেত্তি বলেন, শুধু যে দরিদ্র দেশগুলোই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশকিছু ধনী দেশেও বন্যাপ্রবণ এলাকায় এখনও স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারি অর্থেও এ কাজ করা হয়। এই ধরনের বিনিয়োগ শুধু নষ্টই হয় না, (মানুষের) স্থানচ্যুতির কারণও হয়। এই প্রবণতা বন্ধ করা উচিত।
ধীর অগ্রগতি
প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্থানচ্যুতি, মরুকরণ, সমুদ্রপষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ জালবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ২০১৩ সালে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠিত হয়। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় ওয়ারশ ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম ফর লস অ্যান্ড ড্যামেজ (ডব্লিউআইএম) নামের এই কমিটির তৎপরতায় জলবায়ুর কারণে স্থানচ্যুতদের বিষয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি এ প্রবণতা কমাতে বিভিন্ন দেশের সরকারকে নীতিমালা তৈরিতে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নশীল কিছু দেশ এবং জলবায়ুকর্মীদের ভাষ্য, সবকিছু চলছে ধীরগতিতে, যার ফলে মানুষ তাদের ঘরবাড়ি, জমিজমা হারাচ্ছে। অথচ এক্ষেত্রে তাদের যে ধরনের সহায়তা পাওয়ার কথা, তা মিলছে না।
ডব্লিউআইএমে সেনেগালের সাবেক প্রতিনিধি ইদি নিয়াং মাদ্রিদ সম্মেলনের আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, জলোচ্ছ্বাস এবং নদী ভাঙনের কারণে তার দেশের উপকূলীয় এলাকার মানুষজন যখন মধ্যাঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়, তখন জীবন ধারনের জন্য মাছ ধরারও সুযোগ তাদের হয় না। এছাড়া খরার কারণে প্রতিবেশি মৌরিতানিয়া এবং মালি থেকে বিপুল সংখ্যক গবাদিপশুকে সেনেগালের উত্তর সীমান্তের গোচারণ ভূমিতে আনা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি তার দেশের কৃষক এবং অধিবাসীদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িযেছে। তবে সঙ্কটের গভীরতাপ ভালোভাবে বুঝতে এবং অভিবাসীদের একটি নীতিমালার মধ্যে আনতে তার সরকার কাজ করছে জানিয়ে ইদি নিয়াং বলেন, সাগরে বিলীন হওয়া থেকে বেশকিছু উপকূলীয় গ্রামকে রক্ষা করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জলবায়ুর চাপ মোকাবেলায় এখনও অনেক দেশ, অনেক মানুষ ডব্লিউআইএমের সুবিধার আওতায় আসতে পারেনি বলে জানিয়েছেন অ্যাকশনএইড ইন্টারন্যাশনালের বিশেষজ্ঞ হারজিৎ সিং। আমরা এখনই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে আছি। এ অবস্থার মধ্যেই এখন আমাদের কাজ করতে হবে।