প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসন্ন দশকগুলোতে, বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে, হাজার হাজার মানুষ বন্যা, দাবদাহ ও খরার কারণে পানির অভাবে ভুগতে পারে। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া বিশ্বের নতুন নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। এ ধরনের দুর্যোগ ঝুঁকি কমিয়ে আরতে রাষ্ট্রগুলোর উচিত এখনই এবং দ্রুত ও ব্যাপক মাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন ও অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমানো।
আইপিসিসি বলছে, ফসলহানি আরও ব্যাপক মাত্রা নিতে পারে, যার ফলে আফ্রিকা ও এশিয়ার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষুধা ও পুষ্টিহীনতার হুমকি আরও বেড়ে যেতে পারে। পরিবেশের ব্যাপক রদবদলে খাপ খাওয়াতে না পেরে মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে পরতে পারে, যা একটি বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হবে।
ক্যারিবীয় অঞ্চলের ছোট্ট দেশ গ্রেনাডার পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী সিমন স্টিল বলেন, এই প্রতিবেদনটি আতঙ্কজনক; এ সম্পর্কে অন্যভাবে কিছু বলা সম্ভব না। আমরা আরও সক্রিয় পদক্ষেপ দেখতে চাই এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অর্থায়নের সুযোগ আরও বাড়ানো দরকার। এই সংকটের মাত্রার বিচারে ছোটখাটো পদক্ষেপে কিছুই হবে না। জ্বালানি পেতে মানবজাতি কয়লা, তেল ও গ্যাস পুড়িয়ে এবং গাছ কেটে উনিশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অনেক নেতাই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পবিপ্লব-পূর্ব দশার তুলনায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার অঙ্গীকার জানিয়েছেন। ভয়ঙ্কর মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এই সীমা বেঁধে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই লক্ষ্য পূরণে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশগুলোর উচিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা। বর্তমানে দেশগুলো যে গতিতে চলছে তাতে এই শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, অভিযোজনের জন্য মানবজাতি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করলে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে হুমকির মুখে থাকা উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার সামর্থ্য অনেক দেশেরই থাকবে না। উত্তর আমেরিকার কিছু অংশসহ বিশ্বের অনেক অংশেই প্রাণিসম্পদ ও মাঠের কর্মীরা অতিরিক্ত গরমে কষ্ট পেতে পারেন, যার কারণে চাষাবাদও দিন দিন কঠিন হয়ে পড়বে।
এ প্রতিবেদনের একজন লেখক রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্টের ক্লাইমেট সেন্টারের পরিচালক বলেন, তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করলে আমরা অনেক কিছুই আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। প্রতিবেদনে জানানো হয়, দরিদ্র দেশগুলো ধনী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ধনী দেশগুলোর তুলনায় খরা, বন্যা ও ঝড়ে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোতে ১৫ গুন বেশি মানুষ মারা গেছে, যাদের মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ার লোকজনও রয়েছে।
১৯৫ দেশের সরকারের অনুমোদন পাওয়া এই প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট করা হয়েছে যে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমার চেয়ে ভগ্নাংশ পরিমাণ তামপাত্রা বাড়লেও প্রকৃতি ও মানবজাতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি সৃষ্টির গতি বেড়ে যাবে। এই শতকের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে বিশ্বের ৮ শতাংশ ফসলি জমি ‘ব্যবহার অযোগ্য’ হয়ে উঠতে পারে। প্রবাল প্রাচীর উপকূলীয় এলাকাকে ঝড়ের কবল থেকে সুরক্ষা দেয়। সামুদ্রিক দাবদাহের কারণে তার ক্ষয় বেড়ে যেতে পারে। তাতে বিশ্বের ৭০ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ উপকূলীয় বন্যার কবলে পড়তে পারে। তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, সেক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে দাবানল এক-তৃতীয়াংশের বেশি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খরার কারণে বিশ্বের ৮০ থেকে ৩০০ কোটি মানুষ তীব্র পানি সঙ্কটে পড়তে পারে, যার মধ্যে দক্ষিণ ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশের বেশি জনগোষ্ঠী রয়েছে। অনেক অঞ্চলেই হয়ত শষ্য উৎপাদন ও মাছ চাষ কমতে শুরু করবে। আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে এই শতকের শেষ নাগাদ চরম আবহাওয়া দেখা দেওয়ার আশঙ্কা পাঁচগুণ বেড়ে যেতে পারে। বিশ্বজুড়ে ২৯ শতাংশ গাছ ও প্রাণি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারে।প্রতিবেদনে বিশ্বনেতাদের আরও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কৌশল অবলম্বনের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ক্লার্ক ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক এডওয়ার্ড আর কার বলেন, আমরা যদি এখনই সক্রিয় হই, তাহলে আমাদের সামনে অনেকগুলো বিকল্প থাকবে। কিন্তু এখন থেকে ১০ বছর পর এই বিকল্পের সংখ্যা অনেক অনেক কমে আসবে। আর ৩০ বছর পরে কি হবে-আমার জানা নেই।