মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৪৬ পূর্বাহ্ন

দাউদ হায়দার ও রাষ্ট্রের অক্ষমতা

রিপোর্টার / ১ বার
আপডেট : সোমবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫

দেশ মানে কেবল ভৌগোলিক সীমারেখা নয়, দেশ মানে একজন মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর নির্ভরযোগ্য ঠিকানা। কিন্তু যখন রাষ্ট্র নিজেই সেই ঠিকানায় নিষিদ্ধের সীলমোহর আঁটে তখন প্রশ্ন জাগে— মানবিকতা কি নিঃশেষ হয়ে গেছে?

দাউদ হায়দার। একজন কবি, যার ভাষা ছিল প্রশ্নের, যার শব্দে ছিল সন্ধানের স্পর্ধা। ৫১ বছর ধরে তিনি নিজ জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত। এই নির্বাসন কি কেবল রাষ্ট্রযন্ত্রের? নাকি আমাদেরও দায় আছে এতে?

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল নাজুক। মাত্র তিন বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মাটিতে তখনো রক্তের গন্ধ শুকায়নি, দুর্ভিক্ষের ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল।

এই কঠিন সময়ের মধ্যে দাউদ হায়দার লিখেছিলেন এমন এক কবিতা, যেখানে তিনি ঈশ্বরকে ‘কল্পিত’ বলেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অতুলনীয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল অস্তিত্ববাদী এক বেদনা।

এই উচ্চারণ ধর্মান্ধদের মনে আগুন ধরায়। রাষ্ট্র আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। দেশের ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ধর্মানুভূতিকে আঘাত করার অভিযোগ ছিল যেন মৃত্যুদণ্ডের সমান। সুতরাং, রক্ষা করতেই হোক বা চাপের কাছে নত হয়েই হোক, সরকার দাউদ হায়দারকে একটি বিশেষ বিমানে চড়িয়ে নির্বাসনে পাঠায়।

কিন্তু সময় গড়াল। দেশ দৃঢ় হলো। সরকার বদল হলো। সমাজ বদলালো। তবু কবি ফিরতে পারলেন তবু রাষ্ট্র তার নিজের ঘরদোরের সামনে কাঁটাতারের বেড়া তুলে রাখল।

আমরা কি সত্যি ভুলে গেছি? নাকি ইচ্ছা করেই মনে রাখতে চাই না যে একজন কবি শুধু স্বাধীনতা চেয়েছিলেন চিন্তায়, বিশ্বাসে, উচ্চারণে? নাকি এখনো আমরা ভয় পেয়ে যাই কটি প্রশ্নোচ্চারণের সামনে?

রাষ্ট্র যদি আত্মবিশ্বাসী হতো, যদি নাগরিকের বাকস্বাধীনতাকে সম্মান করত, তবে দাউদ হায়দার আজ নিজের জন্মভূমিতে, নিজ মাটিতে শ্বাস নিতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। আর হয়নি বলেই আজও তার অস্তিত্ব আমাদের কাছে এক অস্বস্তিকর স্মৃতি হয়ে আছে।

বিশ্ব এগিয়েছে। বিজ্ঞান মঙ্গলের মাটি ছুঁয়েছে, শিল্প সাহিত্যে বহু ধর্মবিষয়ক প্রশ্ন নির্ভয়ে উচ্চারিত হয়েছে। অথচ আমরা এখনো অন্ধত্বের ফ্রেমে আটকে আছি। এখনো মনে করি— শক্তি মানে নিঃশর্ত আনুগত্য আদায়, প্রশ্নহীন বিশ্বাস, নির্বিবাদে চলা।

আমরা এখনো মনে করি— ভিন্নমত মানেই বিশ্বাসঘাতকতা। অথচ প্রকৃত স্বাধীনতা মানে তো প্রশ্ন করার সাহস, উত্তর খোঁজার অধিকার।

দাউদ হায়দার কোনো অপরাধী ছিলেন না। তিনি বন্দুক হাতে তুলে নেননি, রাষ্ট্রদ্রোহ করেননি। তিনি শুধু শব্দের মাধ্যমে, চিন্তার মাধ্যমে স্বাধীনতার আরেকটি রূপ দাবি করেছিলেন। সেই দাবির অপরাধে পাঁচ দশক ধরে তাকে রাষ্ট্রচ্যুত করে রাখা হয়েছে।

আজ যখন দাউদ হায়দারের জীবন শেষ, তখন কি রাষ্ট্র তার এই অসমাপ্ত অন্যায় সংশোধন করবে? এখন কি আমরা একটু সাহস দেখাব? নাকি আরও একবার প্রমাণ করব— আমাদের দেশ এখনো কেবল মাটি ও সীমান্তের নাম, হৃদয়ের নাম নয়?

একজন কবির নির্বাসন মানে কেবল তার ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্য নয়, বরং গোটা জাতির আত্মিক দৈন্যের দলিল। এই দলিলের ভার বহন করে যাচ্ছে পুরো সমাজ। দাউদ হায়দারের নির্বাসিত জীবন হয়ে থাকবে আমাদের জাতির অন্তহীন কলঙ্ক।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর