মহান স্বাধীনতার দিন আজ

জাতীয় স্মৃতিসৌধ, স্বাধীনতা দিবসে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহিদদের প্রতি যেখানে শ্রদ্ধাবনত হবে জাতি। ফাইল ছবি
ব্রিটিশ শাসনের অবসানে মিলল পৃথক রাষ্ট্র। কিন্তু মিলল না স্বাধীনতা। ভাষা থেকে শুরু করে শিক্ষা, সংস্কৃতিচর্চা, কর্মসংস্থান— সবকিছুতেই পরাধীনতা। উলটো রাষ্ট্রীয়ভাবে নিপীড়ন-বঞ্চনা। সেই শোষণ বিক্ষুব্ধ করে তুলতে থাকে আপামর জনসাধারণকে। ক্রমেই দানা বাঁধতে থাকে ক্ষোভ। গড়ে ওঠে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে যখন পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর, এরপর সব ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঘোষণা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে পাকিস্তানিদের থেকে পৃথক হয়ে বিশ্বের বুকে জন্ম দেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
আজ সেই ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদশের অভ্যুদয়ের দিন। ৫৪ বছর পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৫ বছরে পা দেওয়ার দিন। এই দিনের ধারাবাহিকতাতেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মুক্ত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। জনযুদ্ধ শেষে অর্জিত হয় জনতার জয়।
এ বছরের গৌরবের এই দিনটি এসেছে ভিন্ন একটি প্রেক্ষাপটে। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে দেড় দশকের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের অবসানের পর স্বাধীনতা দিবস এই প্রথম। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণআন্দোলনটির পর বৈষম্যহীন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে যে যাত্রা, সেই যাত্রায় মহান স্বাধীনতা দিবস তাৎপর্যপূর্ণ বটে।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও এ দিনটি ঘিরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ সেজে উঠেছে বর্ণিল সাজে। রয়েছে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় পর্যায়ের নানা আয়োজন। বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান।
জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা, স্বাধীনতা দিবস পালন হবে যেভাবে
এ দিন প্রত্যুষে ঢাকাসহ সারা দেশে ৩১ তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। দিনটি উপলক্ষে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে এবং ঢাকা শহরে সহজে দৃশ্যমান ভবনগুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলো এরই মধ্যে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে।
স্বাধীনতা ও জাতীয় এই দিবস উপলক্ষ্যে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বৈষম্য ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও বেশি অবদান রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাই, বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াক এক নতুন বাংলাদেশ— মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে এই আমার প্রত্যাশা।
তরুণ প্রজন্মের অবদান উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বাণীতে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তরুণ প্রজন্ম আমাদের স্বাধীনতার অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণে আবারও বুকের তাজা রক্ত দিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
বাণীতে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে দেশের উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে কাজ করার শপথ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জন ছিল আমাদের আত্মমর্যাদা, অস্তিত্ব রক্ষা ও অধিকার আদায়ের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের চূড়ান্ত ধাপ। যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায়, তার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল আজকের এই দিনে। আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহিদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা দিবস ও ঈদের আগাম শুভেচ্ছা প্রধান উপদেষ্টার
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গত ১৬ বছর দেশের মানুষ এই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। স্বৈরাচারী শাসক জগদ্দল পাথরের মতো জনগণের ঘাড়ে চেপে বসে তাদের স্বাধীনতা ও মৌলিক সব অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সফল গণঅভ্যুত্থান দেশের মানুষকে স্বৈরাচারের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করতে এবং স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জনমুখী ও টেকসই উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
প্রতি বছরের মতো এবারও সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন একাত্তরের বীর শহিদদের। সারা দেশের স্মৃতিসৌধগুলোতেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে আপামর জনতা। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কুচকাওয়াজ, মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দল ও সংগঠন এসব কর্মসূচি পালন করবে।
এরই মধ্যে এই ৫৫তম মহান স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনে প্রস্তুত করা হয়েছে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধকে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, স্বাধীনতা দিবসে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্য সদস্য ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। এরপর স্মৃতিসৌধ সর্বস্তরের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এর জন্য গণপূর্ত বিভাগের পক্ষ থেকে স্মৃতিসৌধে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়েছে নতুন করে। সড়কের পাশে ফাঁকা জায়গায় পরিকল্পনা অনুযায়ী রোপণ করা হয়েছে ঘাসের চারা। স্মৃতিসৌধ চত্বর পানি দিয়ে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করা হয়েছে। রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বেদিসংলগ্ন সিঁড়িগুলো। সবুজ ঘাসের গালিচা কেটেছেঁটে নান্দনিক করে তোলা হয়েছে। ভবনের দেয়ালে ঝোলানো হয়েছে বর্ণিল আলোকবাতি।
আপামর জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের আয়োজন নির্বিঘ্ন করতে নিরাপত্তাব্যবস্থাও জোরদার করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ ঘিরে। পুলিশ জানিয়েছে, প্রায় চার হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে স্বাধীনতা দিবসে। আমিন বাজার থেকে শুরু করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়ককে ১২টি সেক্টরে ভাগ করে গোটা এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে।