বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২৩ অপরাহ্ন

পাহাড় অশান্তের নেপথ্যে ছিল গুজব

রিপোর্টার / ৯ বার
আপডেট : শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

চার দিন ধরে অশান্ত দেশের পাহাড়ি অঞ্চল। গত বুধবার ভোরে চোর সন্দেহে খাগড়াছড়িতে মামুন (৩০) নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। উত্তাপের শুরু সেখান থেকে। তারপর থেকে খাগড়াছড়িসহপার্তব্য বাকি দুই জেলা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ি-বাঙালি মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। তবে প্রথম দিকে বাস্তব ঘটনা যতটা ছিল, তার চেয়ে বেশি মাত্রায় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে প্রচুর গুজব ছড়িয়েছে, যা পরিস্থিতিকে অবনতির দিকে টেনে নিয়েছে।
ফেসবুকে গুজব, অপতথ্য ও ভুল ছবি ছড়ানোর পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতাও বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গমাটিতে চারজনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই ‍দুই জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে প্রশাসনকে।
ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, মামুনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করলেও বৃহস্পতিবার তা সংঘাতে রূপ নেয়। ওই হত্যার ঘটনায় সেদিন বিকেলে দিঘীনালার কলেজ গেইট এলাকা থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। দিঘীনালা ডিগ্রি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আয়োজিত মিছিলটি উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে লারমা স্কোয়ারে যেতে চাইলে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়। এসময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলিও করা হয়। তখন লারমা স্কোয়ার সংলগ্ন দোকানপাটে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশসহ স্থানীয়রা মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এই ঘটনাটির পর সন্ধ্যা হতেই ছড়াতে থাকে গুজব। ছড়াতে থাকে আতঙ্ক ও উত্তেজনা। রাত বাড়তেই নানা গুজবে সয়লাব হয় ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অন্যান্য প্ল্যাটফর্মগুলো। কতিপয় ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে উসকানিমূলক ছবি ও পোস্ট দিয়ে এলাকাবাসীকে উত্তেজিত করা হতে থাকে। এমনও চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে উত্তেজিত তরুণরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। ফলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় পাহাড়ের বাসিন্দাদের।
এই রাতের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) শুক্রবার বলেছে, খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় একজন মুমূর্ষ রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। এক সময় ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের ওপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। ওই গোলাগুলির ঘটনায় তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়।
একই ঘটনার ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল জনসাধারণ কয়েকজন যুবকের মোটরসাইকেল থামিয়ে তাদের ওপর হামলা ও লাঠিপেটা করে। সেই সঙ্গে উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে ফায়ার ব্রিগেডের অফিসে ভাঙচুর করে।
‘যার যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে’
খাগড়াছড়ির পরিস্থিতির বিষয়ে দীঘিনালা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. আল আমিন বলেন, দীঘিনালায় দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলায় আহত হয়েছে ছয়জন। অথচ ফেসবুকে গুজব ছড়াচ্ছে পাঁচজন মারা গেছে। শুধু লারমা স্কোয়ার সংলগ্ন এলাকায় পাহাড়ি ও বাঙালির ১০৫টি ছোট-বড় দোকান পুড়েছে। অথচ বলা হচ্ছে দীঘিনালায় গ্রামে গ্রামে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এসব গুজবে মানুষ বেশি আতঙ্কিত। যার যেভাবে ইচ্ছা, সেভাবে গুজব ছড়াচ্ছে। শুধু ঘটনাকেন্দ্রিক থাকলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না।
জেলার মিলনপুর এলাকার বাসিন্দা অর্ণব চাকমা বলেন, ‘আমাদের এলাকার পরিবেশ ভালো আছে, কিন্তু নানাভাবে ছড়ানো হয় যে রাতে হামলা হতে পারে। আমরা সারারাত জেগে ছিলাম। সবাই আতঙ্কে রাত কাটিয়েছি। একজনকে পিটিয়ে মেরেছে। তার বিচার চাইতে পারে, কিন্তু সেটি তো সাম্প্রদায়িক ইস্যু হতে পারে না।
অন্যদিকে খাগড়াছড়ির ঘটনা উত্তেজনা ছড়ায় রাঙামাটিতেও। সেই উত্তেজনার ধারাবাহিকতায় শুক্রবার সেখানে সংঘর্ষও হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকালে পাহাড়ি ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাঙ্গামাটি শহরের বনরূপা এসে বেশ কয়েকটি গাড়ি ও দোকানে হামলা চালায়। খবর পেয়ে বাঙালি ও ব্যবসায়ীরা প্রতিরোধের চেষ্টা করলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে একজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে উভয়পক্ষের ৫৩ জন।
‘পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র’
এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে ইস্যু তৈরি করে পাহাড়কে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র দেখছেন অনেকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আসাদ উল্লাহ বলেন, পাহাড় নিয়ে বহু বছর ধরে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলে আসছে। সশস্ত্র সংগঠনগুলো সাম্প্রদায়িক সংকট তৈরি করে পাহাড়কে অস্থির রাখতে চায়। এসব ঘটনা ঘটিয়ে তারা বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে জুমল্যান্ড করার স্বপ্ন দেখছে। এখানে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। এখনই এসব বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
পার্বত্যাঞ্চলজুড়ে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে কাজ করছে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, আমাদের সবাইকে সচেতন থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। কেউ যেন গুজবে কান না দেয়। বর্তমানে জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। শান্তি-সম্প্রীতি রক্ষায় প্রত্যেককে সংযতভাবে চলার আহ্বান জানাই।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর