জিয়া হত্যার চার-পাঁচদিন আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে ছিলেন মুচকুন্দ দুবে

ভারতের বর্ষীয়ান কূটনীতিবিদ মুচকুন্দ দুবে ৯০ বছর বয়সে বুধবার (২৬ জুন) দিল্লির ফোর্টিস হাসপাতালে প্রয়াত হয়েছেন। ভারতের এই সাবেক পররাষ্ট্র সচিব দীর্ঘদিন ঢাকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, দিল্লিতেও বহুদিন তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। সর্বোপরি আমৃত্যু দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্কের সুতো তিনি কখনও ছিঁড়তে দেননি।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব (১৯৯০-৯১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও জাতিসংঘে তিনি দেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন। অবসরের পর দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ)।পরে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের (সিএসডি) প্রেসিডেন্টও ছিলেন টানা পাঁচ মেয়াদে। তবে বাংলাদেশ তথা ভারতের আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের বিষয়ে তার যে প্রজ্ঞা ও গবেষণা ছিল, সেটা বোধহয় তার আর সব পরিচয়কেই ছাপিয়ে গেছে।
মুচকুন্দ দুবের জন্ম ১৯৩৩ সালে ভারতের দেওঘরের কাছে যশিডিতে, যখন ওই অঞ্চলটি সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত ছিল (এখন ঝাড়খণ্ড রাজ্যে)। কিন্তু যেহেতু যশিডিতে বিপুল সংখ্যক বাঙালির বসবাস ও যাতায়াত ছিল, তাই ছোটবেলা থেকেই হিন্দির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে একবার কথা প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন, দেওঘরে ‘সাধনা ঔষাধলয় ঢাকা’র ওষুধের দোকানের বাংলা সাইনবোর্ড দেখেই বাংলা অক্ষরের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। পরে তিনি নিজের উৎসাহে বাংলা লিখতে ও পড়তে শেখেন।
শুধু তাই নয়, মাতৃভাষা বাংলা না-হওয়া সত্ত্বেও তিনি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি মূল বাংলা থেকে অনুবাদ করেছেন। ঢাকায় যখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন, ভারতীয় হাইকমিশনে প্রায়ই লালন গীতি শোনাতে আসতেন ফরিদা পারভীন– সেই থেকে মুচকুন্দ দুবে লালনের গানেরও প্রেমে পড়েন। পরে জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি লালন সাঁই-য়ের বহু গানও বাংলা থেকে হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন, সেই সৃষ্টি গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, কূটনীতিক জীবনের প্রথম পর্বে যখন তেহরানে তার পোস্টিং হয়েছিল। তখন ইরানে গিয়ে তিনি ফারসি ভাষাও শিখেছিলেন এবং রুমি-হাফিজ-খৈয়ামের সৃষ্টি তার পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছিল। আবার ঢাকায় থাকাকালীন কবি শামসুর রহমানের সঙ্গে তার নিবিড় বন্ধুত্ব হয়। ঢাকার কুট্টি ভাষায় লেখা কবির ‘এই মাতোয়ালা রাইতে’র মতো কবিতাও তিনি হিন্দিতে অনুবাদ করেন। বাদ যায়নি কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতাও!
এহেন সাহিত্যপ্রেমী ও মানবদরদী মানুষটি কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতেও একটি যুগের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন। বিশেষত শীতল যুদ্ধের পর্ব এবং ‘নিরস্ত্রীকরণে’র (ডিসআর্মামেন্ট) ক্ষেত্রে তাকে ভারতের প্রায় ‘শেষ কথা’ বলে মানা হতো। তিনি যখন দেশের পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন, তখন বেশ অনেকটা সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আই কে গুজরাল, আর তাদের সম্পর্কেও ছিল অসাধারণ।
পরে আই কে গুজরালের প্রবর্তিত যে পররাষ্ট্রনীতি ‘গুজরাল ডকট্রিন’ নামে পরিচিতি পেয়েছে, তারও অন্যতম প্রধান রূপকার ছিলেন মুচকুন্দ দুবে। এই গুজরাল ডকট্রিনের মূল কথাটাই ছিল ভারতকে আঞ্চলিক ছোট প্রতিবেশীদের ভাবনাচিন্তা ও উদ্বেগকে মর্যাদা দিতে হবে এবং বৃহৎ শক্তি হিসেবে অনেক বেশি উদারতা ও সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে।
বছর পাঁচেক আগে মুচকুন্দ দুবের এই প্রতিবেদককে বলা একটি ছোট্ট অথচ স্মরণীয় সত্যি ঘটনার কথা উল্লেখ করব। বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী সেন্টিমেন্ট বাড়ছে কি না, সে বিষয়ে কথা বলতে বলতে তিনি এটির কথা বলেন। সেটা ১৯৮১ সালের ঘটনা। আমি তখন ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার, আর চট্টগ্রামেও আমাদের মিশন ছিল। সেখানে কাজকর্ম সব ঠিকঠাক চলছে কি না তা দেখার জন্য রাষ্ট্রদূতকে সেখানে মাঝে মাঝে রুটিন ভিজিটে যেতে হত। তো মে মাসের শেষ দিকে আমি ওরকমই একটা সফরে চট্টগ্রামে যাই। তখন শহরে ভালো হোটেল ছিল কি না মনে নেই, তবে বরাবরই কিন্তু ওরকম ট্যুরে গেলে আমার থাকার ব্যবস্থা হত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে। রুম নম্বার টু-তে ছিলাম, যদ্দূর মনে পড়ে।
কাজকর্ম সেরে ঠিকমতো ঢাকায়ও ফিরে আসি। আর ফিরে আসার ঠিক চার-পাঁচদিনের মাথাতেই খবর এলো, রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ওই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে। আর তিনি ছিলেন ঠিক সেই ঘরেই, যেখানে তার আগের সপ্তাহেই আমি থেকে এসেছি। এখন ভাবুন, আজকের দিনে এই ঘটনা ঘটলে কী কী হতে পারত!
হাজারটা কনস্পিরেসি থিওরি তো সঙ্গে সঙ্গে বাজারে চালু হয়ে যেত। জিয়া হত্যার ষড়যন্ত্র করতেই কি ভারতীয় রাষ্ট্রদূত চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন? সার্কিট হাউজে তিনি কি নিজে ‘রেকি’ করতে গিয়েছিলেন? এইরকম নিশ্চয় অজস্র– ভাবতেও ভয় হয়! তখন সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। কোনও খবরের কাগজ বা রেডিওতেও এ খবর বেরোয়নি যে মুচকুন্দ দুবে তার কদিন আগেই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ঘুরে গেছেন। তাই সে যাত্রা ওসব অপবাদ থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম’, হাসতে হাসতে সে দিন এই কাহিনী শুনিয়েছিলেন বর্ষীয়ান কূটনীতিবিদ।
মৃত্যুকালে মুচকুন্দ দুবে রেখে গেছেন তার স্ত্রী বাসন্তী দেবী ও দুই কন্যাকে। আজ বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) সন্ধ্যায় দিল্লির লোধি রোড ক্রিমেটোরিয়ামে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। -রঞ্জন বসু,বাংলা ট্রিবিউন, দিল্লি