‘অল আর ফিনিশড’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ঘাতকরা ঢুকেছিল সপরিবারে তাঁকে হত্যা করতে। একে একে পরিচয় জেনে কাছে থেকে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করা হয়। হত্যার পরে কালো পোশাক পরা ঘাতক দলের সদস্যরা বাসার সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। শেষ সময়ে ডিএসপি নূরুল ইসলাম এবং পিএ কাম রিসিপশনিস্ট মহিতুল ইসলামও আহত হন। হত্যার পর সব শান্ত হলে বাসার সামনে একটা ট্যাংক আসে। ট্যাংক থেকে কয়েকজন আর্মি নেমে ভেতরের আর্মিদের লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে ভেতরে কে আছে? উত্তরে ভেতরের আর্মিরা বলে, ‘অল আর ফিনিশড’।
এই জবানবন্দি আবদুর রহমান শেখের (রমা)। ১৯৬৯ সালে কাজের লোক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসেন তিনি। রমা সেই রাতে প্রত্যক্ষ করেছেন বীভৎসতা। তিনি সময় নিশ্চিত করে জবানবন্দিতে বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর ৫টায় বঙ্গবন্ধু নিহত হন। ওই দিন, অর্থাৎ ঘটনার দিন রাতে আমি এবং সেলিম দোতলায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের সামনে বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলাম। আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে হঠাৎ বেগম মুজিব দরজা খুলে বাইরে আসেন এবং বলেন যে সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে।
রমার কাছে থেকে জানা যায়, বাসার তিন তলায় শেখ কামাল এবং তার স্ত্রী সুলতানা ঘুমিয়ে ছিলেন। শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী এবং বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের ছিলেন দোতলায়। দোতলাতেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর স্ত্রী এবং শেখ রাসেল ঘুমিয়ে ছিলেন। নিচতলায় পিএ মহিতুল ইসলামসহ অন্য কর্মচারীরা ছিল।
আবদুর রহমান শেখ রমার ভাষ্য—‘বেগম মুজিবের কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি লেকের পাড়ে গিয়ে দেখি, কিছু আর্মি গুলি করতে করতে আমাদের বাড়ির দিকে আসিতেছে। তখন আমি আবার বাসায় ঢুকি এবং দেখি পিএ কাম রিসিপশন রুমে বঙ্গবন্ধু কথা বলিতেছেন। আমি পিছনের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় এসে দেখি বেগম মুজিব দোতলায় ছোটাছুটি করছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে তিনতলায় যাই এবং আমাদের বাসা আর্মিরা আক্রমণ করেছে বলে কামাল ভাইকে উঠাই। দোতলায় গিয়ে একইভাবে আমাদের বাসা আর্মিরা আক্রমণ করেছে বলে জামাল ভাইকে উঠাই।’
বঙ্গবন্ধুকে গুলি করার ঘটনা বর্ণনা করেন রমা। তিনি জানান, একসময় প্রচণ্ড গোলাগুলি বন্ধ হলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বাইরে এলেই আর্মিরা তাঁর বেডরুমের সামনে চারপাশে তাঁকে ঘিরে ফেলে। আমি আর্মিদের পিছনে ছিলাম। আর্মিদের লক্ষ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ তারা বঙ্গবন্ধুকে তখন সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সিঁড়ির ২/৩ ধাপ নামার পর নিচের দিক থেকে অনেক আর্মি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন।
রমাই বেগম মুজিবকে জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকেরা মেরে ফেলেছে। তিনি বলেন, ‘‘সবাই বাথরুমে আশ্রয় নিয়েছে। শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা, শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী, শেখ রাসেল, বেগম মুজিব ও বঙ্গবন্ধুর ভাই নাসের এবং আমি। শেখ নাসের তখন গুলিবিদ্ধ। আর্মিরা আবারও দোতলায় এসে দরজা পিটাতে থাকলে বেগম মুজিব দরজা খুলিতে যান এবং বলেন, ‘মরলে সবাই একই সাথে মরবো।’ বেগম মুজিব সে সময় বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখতে পান। এর পরপরই ওই ঘরে আশ্রয় নেওয়া প্রত্যেককে মেরে ফেলা হয়।
এবার আর্মিরা নাসের, রাসেল ও রমাকে নিচতলায় এনে লাইনে দাঁড় করায়। নিচে নাসেরকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কে?’ তিনি শেখ নাসের বলে পরিচয় দিলে তাঁকে নিচতলায় বাথরুমে নিয়ে যায়। একটু পরেই গুলির শব্দ। সে সময় শেখ রাসেল ‘মার কাছে যাবো’ বলে কান্না করে উঠলে একজন আর্মি তাহাকে বললো, ‘চলো, তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই।’ এই বলে তাহাকে দোতলায় নিয়ে যায়। একটু পরেই কয়েকটি গুলির শব্দ ও আর্তচিৎকার শুনতে পাই।’’
সেই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব এবং তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়৷ দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সেদিনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে তাঁর দুই পুত্রবধূ, ছোট ভাই, বোনের ছেলেমেয়ে ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং তাঁর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তাসহ নিহত হন ২৬ জন।