দুই ‘লিও’র ডানায় উড়ছে আর্জেন্টিনা
ডাগআউটের উৎসব সেরে এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে লিওনেল স্কালোনি। কোচের দিকে এগিয়ে এলেন লিওনেল মেসি। পরস্পরকে আলিঙ্গণে বাঁধলেন। জাদুকরের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন কোচ বারবার; চোখের কোণে তার চিকচিক করছে অশ্রু।
স্কালোনির এই অশ্রুতে চাপমুক্তির আনন্দ, শুরুর শঙ্কার কালো মেঘ সরিয়ে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার স্বস্তি যেমন মিলেমিশে একাকার, ২০১৮ সালে আলবিসেলেস্তেদের হাল ধরার সময় যারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, সমালোচনার তিরে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল, তাদের জবাব দিতে পারার তৃপ্তিও তেমনি।
২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকে বিদায় নেয় হোর্হে সাম্পাওলির আর্জেন্টিনা। স্কালোনি তখন তার সহযোগী। রীতিমতো বিস্ফোরণই ঘটল দলে। বিদায়ঘণ্টা বাজল সাম্পাওলির। মেসি হাঁটা ধরলেন উল্টো পথে। এই দুঃসময়ে স্কালোনিতে আস্থা রাখল আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন। ‘অখ্যাত এবং অনভিজ্ঞ’ এক কোচের হাতে দলের হাল তুলে দেওয়ায় তুলোধুনো হতে থাকল এএফএফ। দূরত্ব বজায় রাখলেন মেসিও।
মেসির চেয়ে মাত্র ৯ বছরের বড় স্কালোনিও থাকলেন চুপচাপ। আর্জেন্টিনার হাল ধরার সময় তার সঙ্গে ছিলেন পাবলো আইমার, সাবেক এই তারকা মিডফিল্ডারই বরফ গলালেন। তাতে ২৫০ দিন পর ২০১৯ সালের ২২ মার্চ ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আকাশি নীল-সাদা জার্সিতে ফিরলেন দলের প্রাণভোমরা মেসি।
স্কালোনির সঙ্গে শুরুতে যে তার দুধে-মাছি সম্পর্ক ছিল তা নয়, সাপে-নেউলে তাও নয়। আস্থার সংকট যেন ছিল কিছুটা। তা দূর হতে থাকে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার আসরে। শুরু থেকে সবকিছুর কেন্দ্রে মেসিকে রেখে ছক কষেছেন স্কালোনি, যখনই সমালোচনার তির ধেয়ে এসেছে দলের সেরা তারকার দিকে, বর্ম হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে গেছেন তিনি।
ফলও মিলে যায় মারাকানার ফাইনালে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে ১৯৯৩ সালের পর লাতিন আমেরিকার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ফিরে পায় আর্জেন্টিনা। মেসিও পান আলবিসেলেস্তেদের হয়ে প্রথম বড় কোনো শিরোপার অনির্বচনীয় স্বাদ। দুজনের সম্পর্কের মধ্যে আস্থাহীনতার যে চোরাস্রোত ক্ষীণ ধারায় বইছিল, বন্ধ হয়ে যায় তাও।
এরপর থেকে দুই ‘লিও’র হাত ধরে আর্জেন্টিনা ছুটছে তো ছুটছেই। অশ্ববেগে ছোটা টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রথের চাকা আটকে গেল কাতার বিশ্বকাপে এসে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরে গেল আর্জেন্টিনা। মেসির গোল হয়ে গেল মূল্যহীন, স্কালোনির ছক মার খেল চরমভাবে! মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখা হয়ে গেল দুজনের।
কিন্তু ওই অতটুকুই। পরের পথচলায় আবারও দুর্বার আর্জেন্টিনা। মেক্সিকোকে ২-০ গোলে হারিয়ে মরুভূমিতে পথের দিশা পেল দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। পোল্যান্ডের বিপক্ষে একই ব্যবধানে জিতে ‘সি’ গ্রুপের সেরা আর্জেন্টিনা। তিন ম্যাচে ৬ পয়েন্ট পেলেন স্কালোনি, মেসি পেলেন দুই গোল।
নকআউট পর্বে যথারীতি উড়ছে আর্জেন্টিনা। শুরুটা অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়ে। এ ম্যাচেও গোল পেলেন মেসি, বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে নকআউট পর্বে গোল না পাওয়ার ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। এনসো ফের্নান্দেস আত্মঘাতী গোল করে বসলেন বটে, তাতে স্কালোনির ছক ভেস্তে যায়নি।
স্কালোনির কৌশল যা একটু ভন্ডুল হতে বসেছিল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে। নাহুয়েল মোলিনা ও মেসির গোলে অনায়স জয়ের পথে থাকা আর্জেন্টিনা হঠাৎ টালমাতাল ভঠ ভেহর্স্টের জোড়া গোলে। টাইব্রেকারে এমিলিয়ানো মার্তিনেস আর্জেন্টিনাকে পার করিয়ে দিল সেরা আটের বৈতরণী।
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে স্কালোনি পাননি দুই নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার মার্কোস আকুনিয়া ও গাব্রিয়েল মনতিয়েলকে। ওদিকে চোট কাটিয়ে ফেরা আনহেল দি মারিয়ার উপর শতভাগ আস্থা রাখা কঠিন। ২০১৮ বিশ্বকাপে সাম্পাওলির সহকারী হিসেবে ক্রোয়াটদের কাছে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার অতীতের চোখ রাঙানিও ছিল প্রবলভাবে। স্কালোনি সব সামলে নিলেন দারুণভাবে।
কার্ডের খাড়ায় নিষিদ্ধ আকুনিয়ার জায়গায় ফুলব্যাক হিসেবে খেলালেন নিকোলাস তাগলিয়াফিকোকে। সেরা একাদশে ঠাঁই দিলেন মিডফিল্ডার লেয়ান্দ্রো পারেদেসকে। শুরুর দিকে একটু ছন্দহীনতা ভর করল বটে, কিন্তু সময় যত গড়াল স্কালোনির ছকও শুরু করল মিলতে। মেসির স্পট কিকের গোল, হুলিয়ান আলভারেসের জোড়া গোলে ম্যাচ ঝুঁকে পড়ল আর্জেন্টিনার দিকে।
ক্রোয়েশিয়ার ডাগআউটে ছিলেন নভগোরোদে সাম্পাওলির আর্জেন্টিনাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই জ্লাতকো দালিচ। কিন্তু স্কালোনির আর্জেন্টিনাকে একটু ঝাঁকুনিও দিতে পারলেন না তিনি। হারও মানলেন সেই ৩-০ স্কোরলাইনে।
চার বছর পরে তাই লুসাইলের ক্যানভাসে ভিন্ন ছবি ফুটে ওঠে। স্কালোনি-মেসি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন নিবিড়ভাবে, যেখানে আস্থার সংকটের বাতাসের প্রবেশেরও সুযোগ থাকে না। বরং আনন্দাশ্রুতে ভেসে যাওয়ার তৃপ্তি থাকে। থাকে ৩৬ বছর ধরে বিশ্বকাপের আঙিনায় চলা আর্জেন্টিনার খরা কাটানোর দুর্নিবার ইঙ্গিতও।