বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫, ০৫:৫৫ অপরাহ্ন

সরকারবিরোধী স্লোগান ও পিছমোড়া হাতকড়ায় মানবাধিকার

রিপোর্টার / ০ বার
আপডেট : বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫

আসামিদের পিছমোড়া করে হাতকড়া পরালে তারা সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে পারবেন না- এমন এক বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এমন বক্তব্য কখনোই গ্রহণযোগ্য বা সমর্থনযোগ্য নয়।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী ঠিক এমন কথাই বলেছেন। পিছমোড়া করে হাতকড়া পরানোর পক্ষে তার দেখানো এমন যুক্তির সমালোচনা করেছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা মনে করেন, এমন কিছু আইনজীবীর কারণেই বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

ঢাকার এজলাসে কয়েকদিন ধরেই হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আটক পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং নেতাদের পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা নিয়ে কথা উঠছে। বুধবার তার জবাব দিয়েছেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি বলেছেন, ‘তারা যাতে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতে না পারে তাই তাদের হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হয়েছে।’

গত ৫ আগস্টের পর আনিসুল হক, সালমান এফ রহমানসহ সাবেক বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, মেয়রদের এক হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হতো। তবে গত দুই সপ্তাহ ধরে আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, শাহজাহান খান, জুনায়েদ আহমেদ পলকসহ বেশ কয়েকজনকে দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে হাজতখানা থেকে আদালতে নেয়া হচ্ছে। বুধবারও তাদের একইভাবে আদালতে তোলা হয়।

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘ইদানীং সালমান, আনিসুলসহ বেশ কয়েকজন আসামিকে দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলার বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। মূলত কয়েকজন আসামি হাজতখানা থেকে আদালতে তোলার সময় হাত উঁচু করে চিৎকার করে সরকারবিরোধী বক্তব্য দিতে চান। তারা যাতে হাত উঁচু করে এ ধরনের কথা-বার্তা না বলতে পারেন, সেজন্য তাদের হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হচ্ছে।’

পিপি ওমর ফারুক ফারুকীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে। তিনি আগের বক্তব্যে অনড় থেকেই ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘হ্যাঁ তারা তো স্লোগান দেয়। পলক তো সেদিনও স্লোগান দিলো। তারা আবার পুলিশকে ধাক্কা দেয়। তাই তাদের পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে আনা হয়। তা না হলে তারা যেকোনো ধরনের অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।’

হাত দিয়ে তো স্লোগান দেয় না, তাদের মুখ তো খোলা থাকে, আগামীতে হাত পিছমোড়া করে হাতকড়ায় বাঁধা অবস্থায়ও তো তারা স্লোগান দিতে পারেন- এ বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘তাদের তো হেলমেট পরানো হয়। ফলে মুখের সামনে তো সাদা গ্লাস দিয়ে ঢাকা থাকে। হাত পিছনে বাঁধা থাকলে তো আর হাত উঁচু করে স্লোগান দিতে পারবে না। আবার তাদের এভাবে আনা-নেয়া করার সময় তারা চাইলেও কিছু করতে পারে না। তারপরও তারা যে কথা বলে তা বেআইনি।’

এভাবে হাতকড়া পরানো মানবাধিকারবিরোধী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরা ভয়ঙ্কর আসামি। এরা দেশে হত্যা, নির্যাতন চালিয়েছে। ভয়ঙ্কর আসামিদের এভাবে হাতকড়া পরানো যায়। তাদের তো কোনো নির্যাতন করা হচ্ছে না, ডান্ডাবেড়ি পরানো হচ্ছে না। তাদের পা দিয়ে তো রক্ত ঝরছে না। তাদের সময়তো ডান্ডাবেড়ি পরানো হতো, নির্যাতন করা হতো। এখন আইনের শাসন আছে।’

৫ আগস্টের পর আটক হবার পর এই আসামিরা আদালত এলাকাতেই একাধিকবার হামলার শিকার হন। ডিমও ছোঁড়া হয় তাদের লক্ষ্য করে। তাদের মামলা পরিচালনা করতে আসা আইনজীবীরাও নিরাপত্তা পাননি। তাদের ওপরও চালানো হয় হামলা। এখন এই আসামিদের মামলা পরিচালনায় আইনজীবীরা তেমন এগিয়ে আসছেন না।

গত অক্টোবরে ব্যারিস্টার সায়েদুল ইসলাম সুমনের আইনজীবী হিসাবে আদালতে মামলা পরিচালনা করতে যাওয়ায় অ্যাডভোকেট মোরশেদ হোসেন শাহীনের ওপর আদালত এলাকায় হামলা হয়। হামলা হয় তার চেম্বারেও। তিনি এখন আওয়ামী লীগের আটক প্রায় সব মন্ত্রী, এমপি, নেতা, পুলিশ কর্মকর্তাদের মামলা পরিচালনা করছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘শাহজাহান খানকে পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে আদলতে তোলার পর তিনি অনুমতি নিয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এটা তার অপমান। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি।’

হামলার পর আইনজীবীর বিরুদ্ধেই হত্যাচেষ্টা মামলা

অ্যাডভোকেট মোরশেদ হোসেন শাহীন আদালত প্রাঙ্গণে তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে আরো বলেন, ‘আসলে প্রথম দিকে তো আমি ছাড়া কেউই তাদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে সাহস করেননি। এখন আরো দু-একজন মামলা পরিচালনা করছেন। তবে অধিকাংশ মামলাই আমার কাছে। আমার ওপর হামলা হয়েছে৷ চেম্বারে হামলা হয়েছে। আমার সহকারীর ওপর হামলা হয়েছে। আরো একজন আইনজীবীর ওপর হামলা হয়েছে। মামলা পরিচালনা শুরুর পর আমার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। আমিসহ মোট ১৪০ জন আইনজীবী কোতোয়ালী থানার ওই মামলার আসামি।’

তার অভিযোগ, ‘এখনো আমাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। আমার ওপর হামলার কোনো বিচার পাইনি।’ তবে তিনি জানান, এখন আর আগের মতো আইনজীবী ও আসামিদের ওপর হামলা হচ্ছে না। পরক্ষণেই অবশ্য তার মুখে শোনা যায় শঙ্কার কথা, ‘তবুও ভয়ে থাকি কখন আবার হামলা হয়। কারণ, এখনো তো মব জাস্টিস চলছে।’

‘আদালতের যে স্বাধীনতা সেটা তারা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে’

আসামিদের সরকারবিরোধী স্লোগান দেওয়া থেকে বিরত রাখার যুক্তিতে পিছমোড়া করে তাদের হাতকড়া পরানোর প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আসামিদের পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা মানবাধিকারের লঙ্ঘন। আর যে আইনজীবী আদালতে বলেন যে, তাদের পিছমোড়া করে হাতকড়া না পরালে তারা শ্লোগান দেবে, তারা আহাম্মকি সাবমিশন করছেন। তারা তো পুলিশের কাস্টডিতে আছেন। তারাই দেখবেন। আর তারা শ্লোগান দিলেই কি সরকারের কিছু হয়ে যাবে?’ তিনি মনে করেন, ‘এইসব আইনজীবীর কারণে আদালত কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে , সেটা প্রশ্ন। ঢাকা কোর্টের যে পরিস্থিতি, তাতে বলা যায়, আদালতের যে স্বধীনতা সেটা তারা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। যা হচ্ছে তা তাদের নির্দেশেই হচ্ছে বলে মানুষ মনে করে।’

অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ আরো বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আছে আসামিদের হাড়কড়া পরানো যাবে না যদি বড় ধরনের সস্ত্রাসী না হয়। আর এখানে এখন পিছমোড়া করে হাতকড়া পরানো হচ্ছে। শুরুতে আসামি , আসামির আইনজীবীর ওপর হামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আদালত নিতেও পারবে না। সরকারও না। কিছু আইনজীবীই এখন সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। তারাই বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে।’

আদালতে ভয়ের পরিবেশ

আসামিদের মুখের স্লোগান রুখতে পিছমোড়া করে তাদের হাতকড়া পরানোর বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বন্দির নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই নিরাপত্তা তার আইনগত ও মানবাধিকার। তিনি স্লোগান দেবেন তাই তার বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। আর হেলমেট মাথায় দেয়া হয় যদি কথা বলা বন্ধের উদ্দেশ্যে তাহলে কি কথা বলা তারা বন্ধ করে দেবে? মনে রাখতে হবে, সবার জন্যই তাহলে এই পরিস্থিতি হতে পারে। অতীতের স্বৈরাচারের ব্যবস্থা তো এখন আমরা দেখতে চাই না।’

তার কথা, ‘আসলে একটি ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। আইনজীবীদের ওপর হামলা, আসামির ওপর হামলা সেটাই প্রমাণ করে। আগের সরকারের সময় ভয়ঙ্কর অবস্থা ছিল। সেইরকম অবস্থা তো ফিরে আসা কাম্য নয়। সরকারের অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বাংলাদেশে আইনজীবীদের ওপর হামলা এখনো বন্ধ হয়নি৷ কোথাও কোথাও গণহামলারও শিকার হচ্ছেন আইনজীবীরা। গত ১০ মার্চ এক ধর্ষণ মামলার আসামির আইনজীবীর ওপর হামলা চালানো হয়৷ এর প্রতিবাদ করতে গেলে আরো কয়েকজন আইজীবীর ওপর হামলা চালায় ‘ছাত্র’ পরিচয়ে আসা ব্যক্তিরা৷ ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে আসামির আইনজীবীর ওপর চড়াও হন হামলাকারীরা৷ হামলার শিকার আইনজীবীদের বক্তব্য- তারাও ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি চান, কিন্তু আইনজীবীর ওপর ‘মবজাস্টিস’ বা গণহামলা সমর্থনযোগ্য নয়, কারণ, আইনজীবী নিয়োগ ও আত্মপক্ষ সমর্থন আসামির আইনগত অধিকার।

নূর খান বলেন, একজন আইনজীবী যে-কোনো মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারেন। কারণ, এটা বিচার প্রক্রিয়ার অংশ। আইনজীবীর ওপর হামলা মানে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর