নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার সংকট এবং ভোটারদের মাঝে নির্বাচন বিমুখতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদরা। সরকার পরিচালনায় থাকা দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা জরুরি উল্লেখ করে তারা বলেন, সমঝোতা করা সম্ভব হলে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে। না হলে তাদের জন্য কাজ করা বড় কঠিন হবে।
রবিবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে শিক্ষাবিদ এসব কথা বলেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে নির্বাচন ভবনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। ইসির পক্ষ থেকে সংলাপে ৩০ জন শিক্ষাবিদকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তাদের অর্ধেকের বেশি অংশ নেননি। এ বিষয়ে সিইসি বলেছেন, অনেকে হয়তো ব্যক্তিগত কাজের জন্য আসতে পারেননি। তবে যারা এসেছেন তারা কার্যকর পরামর্শ দিয়েছেন। অংশগ্রহণ বাড়াতে আগামীতে বেশিসংখ্যক ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানাবেন বলে সিইসি জানান।
এদিকে ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আব্দুল মান্নান চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক আখতার হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনকে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের কাজের মাধ্যমে আস্থা অর্জন করতে হবে। এজন্য সামনে যেসব নির্বাচন আসবে সেগুলো স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক হতে হবে। ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ইসিকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। ক্ষমতাসীন দল আর প্রশাসনকে এক করা যাবে না। নির্বাচনের সময় প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার ক্ষমতা ইসিকে আইনেই দেওয়া আছে। তিনি বলেন, ভারতে নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এখানে সুষ্ঠু করা সম্ভব নয় কেন? প্রয়োজনে একাধিক দিনে ভোট গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, একটি বড় রাজনৈতিক দল প্রায় সবকিছুতে ‘না’ বলছে। নির্বাচন কমিশনকে তাদের জন্য ‘স্পেস’ করে দিতে হবে। বারবার তাদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য নিয়াজ মোহাম্মদ খান বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার সংকট আছে। ভোটারদের মাঝে নির্বাচন বিমুখতা তৈরি হয়েছে। বর্তমান কমিশন একটি ক্রান্তিকালে দায়িত্ব নিয়েছে। ভোটারদের নির্বাচনবিমুখতা দূর করতে কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ এবং অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, দায়িত্ব শেষে নির্বাচন কমিশন যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারে যে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে তাহলেই হবে। তিনি বলেন, এক কোটি ভোটার দেশের বাইরে থাকেন। তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিলে খুব ভাল হয়। ভোটের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা নির্যাতনের শিকার হন। তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনে মানুষ ভোগান্তি দূর করতে উদ্যোগী হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতার বলেন, ইসি গঠন প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ। আপনারা যে তালিকা থেকে এসেছেন তা প্রকাশ করা প্রয়োজন ছিল। জানার অধিকার আছে সেখানে কোন দশ জনের নাম আছে। লুকোচুরি, ছলচাতুরি, দুরভিসন্ধিমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে বলার কারণ আছে। তিনি বলেন, সমঝোতা জরুরি ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে। এটা যদি কার্যকর করা যায় তাহলে ইসি পারবে। এই প্রস্তাব উপেক্ষিত হলে বড় কঠিন হবে।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করা উচিত হয়নি—মন্তব্য করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সবার সম্মতিতে গঠন করা হয়েছিল। বাতিল করা হয় এককভাবে। চরম ভুল করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় কিছু ভুল-ত্রুটি দেখা দিয়েছিল, সেটা সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল। এখন যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচন করা যাচ্ছে না সেটা একাধিকবার দেখা গেছে। তাই হয়তো সিইসি সমঝোতার কথা বলেছেন। সমঝোতার বিষয়টিতে সরকারের কোর্টে বল থাকে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন করা টাফ অ্যান্ড টাফ হবে। কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে যে নির্বাচনগুলো হয়েছিল সেগুলো মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। ইসিকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনাদের তিনজন আমলা। আপনারা সরকারের সুবিধাভোগী। আপনারা কীভাবে সরকারের বিরাগভাজন হবেন। এখানে চক্ষুলজ্জারও বিষয় আছে। আমরা সেভাবে দেখব।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহিয়া আখতার বলেন, ইভিএম একটিতেও ব্যবহার করবেন না। কারণ ইভিএম একটা হাইটেক মেশিন। ভোটারদের বেশিরভাগ প্রযুক্তি অসচেতন, অল্প শিক্ষিত। এটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। হ্যাক প্রুভনেস প্রমাণ করুন। কাগজের ব্যবস্থা করুন। ভারতে ইভিএম নিয়ে অনেক জায়গায় কেস চলছে। আমেরিকায় ২৪টা অঙ্গরাজ্য ইভিএম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশ। যদি ইভিএমে ভোট করতে চান রেফারেন্ডাম করবেন। মানুষ চাইলে ইভিএমে ভোট করবেন। মানুষকে নির্যাতন করার অধিকার আমরা ইসিকে দিতে চাই না। তিনি বলেন, দলীয় সরকার রেখে কিছুতেই ভাল নির্বাচন করা সম্ভব নয়। যদি সমঝোতা হয় তাহলে অনেক কিছু করা সম্ভব। বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায় ভাল নির্বাচন সম্ভব নয়। যদি নির্বাচন কমিশন বুঝতে পারে যে তারা কিছুই করতে পারছে না তাহলে তারা পদত্যাগ করতে পারে।