শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন হাস্যকর : বিবিসিকে নাজিব তারেক

বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি এবারের আয়োজনে থাকছে না। এই শোভাযাত্রার নতুন নাম করা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে এক সংবাদ সম্মেলনে এ নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। তবে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটিকে ‘হাস্যকর’ বলে উল্লেখ করেছেন প্রথম শোভাযাত্রা আয়োজনের দায়িত্বে থাকা চারুকলার ছিয়াশি ব্যাচের শিক্ষার্থী নাজিব তারেক।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা অন পহেলা বৈশাখ’– বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনটিকে ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতির সনদে এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। এখন নাম বদলের ফলে জাতিসংঘের সংস্থার স্বীকৃতিতে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
২০১৬ সালে বাংলা বছরকে বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষাকৃত নতুন এই উৎসবটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। ততদিনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে খ্যাতি পেলেও সাড়ে তিন দশক আগে ১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরুর সময় এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হচ্ছে।
এবার পহেলা বৈশাখের এই আয়োজনে শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনকে সেই পুরনো নামে প্রত্যার্বতন হিসেবে বর্ণনা করছে আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ‘নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আমি পরিবর্তন বলতে চাই না। শুরুতে বর্ষবরণ ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। আগে যেভাবে হয়েছিলো, সেটির স্বতঃস্ফূর্ততা কতোখানি ছিল সেটা বিশ্লেষণের বিষয়। পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে এজন্য পরিবর্তন নয়, পুনরুদ্ধার বলছি আনন্দ শোভাযাত্রাকে,’ গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন চারুকলা অনুষদের ডিন।
নাম পরিবর্তনে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর ক্ষোভ
এদিকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নাম পাল্টে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ করায় বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী গোষ্ঠীর আস্ফালনের কাছে নতজানু হয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন দেশের মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য অশনিসংকেত। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি এই মঙ্গল শোভাযাত্রা যেখানে সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতির নির্বিশেষ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।’
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন প্রত্যাখান করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘ঐতিহ্যবাহী বাংলা নববর্ষ বরণের শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন ‘ফ্যাসিস্ট সাম্প্রদায়িক মবের কাছে’ অন্তবর্তীকালীন সরকারের ‘অসহায় আত্মসমর্পণ’। ঐতিহাসিকভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের বিশাল কর্মযজ্ঞ শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রয়াসে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকলেও এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের বাদ দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় চারুকলার শিক্ষকদের মধ্যে।’
‘সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ন্যূনতম সুযোগটুকু তারা রাখেননি। মোটিফ তৈরি বিষয়ক নানাবিধ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত তারা শিক্ষার্থীদের মতের বিপরীতে গিয়ে গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে গণরোষের মুখে পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।’
বদলে গেল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নাম
নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটিকে ‘হাস্যকর’
চারুকলার ছিয়াশি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা প্রথম শোভাযাত্রা আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন। তাদের সঙ্গে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ছিলেন সাতাশি ব্যাচের নাজিব তারেক। নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটিকে ‘হাস্যকর’ বলছেন মি. তারেক।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘একটি নাম যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে যার পরিচিতি ঘটেছে এখন সেই নামটা পরিবর্তনের প্রয়োজন কেন পড়লো?’
আন্তর্জাতিকভাবে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। ‘জাতিসংঘের কাছে এটা মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে পরিচিত। এখন মনে হতে পারে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে আর কিছু নেই, এটা হারিয়ে গেছে,’ যোগ করেন নাজিব তারেক। তার মতে, এর ফলে ‘ক্রেডিবিলিটি’ (বিশ্বাসযোগ্যতা) হারানোর শঙ্কা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন জায়গার বাঙালিরা পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে আয়োজন করে থাকেন। ‘ইউনেস্কা স্বীকৃত একটা জিনিস, যেটা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, সেটা তার উৎপত্তিস্থলেই পরিবর্তিত ও ভিন্ন নামে উদযাপিত হয়, এটা নেতিবাচক ধারণা দেয়,’ বলছিলেন প্রথম শোভাযাত্রার অন্যতম আয়োজক নাজিব তারেক।
আওয়ামী লীগের সময়ে রাষ্ট্রের সবকিছুকে ‘আওয়ামীকরণ’ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে থাকেন বিরোধীরা। মঙ্গল শোভাযাত্রাকেও একই মাপকাঠিতে দেখেন অনেকে। তবে নাজিব তারেকের দাবি, বিগত বছরগুলোতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কড়াকড়িসহ নানান বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে সংকুচিত হয়েছে। তাই এই শোভাযাত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনুষঙ্গ হিসেবে দেখতে নারাজ তিনি।
‘অমঙ্গল বলতে আমরা স্বাধীনতা বিরোধী বা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বুঝিয়ে ছিলাম। তাদের বিরুদ্ধে মঙ্গলের বার্তা দেওয়াকে কোনো অবস্থায়ই খারিজ করার সুযোগ নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. তারেক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বর্ষবরণের প্রথম শোভাযাত্রার অন্যতম আয়োজক নাজিব তারেক মনে করেন, এখন বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশ হওয়া শোভাযাত্রার নাম বদলের বিষয়টি জাতিসংঘের সংস্থাটির কাছে নেতিবাচক বার্তা দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে এই নাম পরিবর্তন নিয়ে সমালোচনা ও নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন অনেকে। এসবের মধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির বিষয়টিও ঘুরে ফিরে আসছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রা: বদলে গেল নাম, বদলাবে কি বার্তা?
ইউনেস্কোর স্বীকৃতির সনদ
ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পর মঙ্গল শোভাযাত্রা নতুন মাত্রা পেলেও, আয়োজনটি যে সবসময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল তা নয়। এই আয়োজন নিয়ে আগে থেকেই তাদের আপত্তি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল ও সংগঠন। তাদের দৃষ্টিতে, এই শোভাযাত্রাটি হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে এসেছে।
প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখের আগে আগে এই বিতর্কটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এবারও কোনো কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ‘মঙ্গল’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি তোলে। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, বাইরের কোনো চাপে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।