রাজশাহীতে ঝরছে আমের গুটি, ফলন কমার শঙ্কা

চলতি বছরে রাজশাহী একাধিকবার তাপপ্রবাহের কবলে পড়লেও গত তিন সপ্তাহ ধরে টানা চলছে মাঝারি দাবদাহ। এই অব্যাহত দাবদাহ, প্রচণ্ড খরা ও পোকার উপদ্রবে রাজশাহীতে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। অথচ গত বছর ‘অফইয়ার’ থাকায় রাজশাহী অঞ্চলের জেলাগুলোতে আমের ফলন ভালো হয়নি। ফলে ‘অনইয়ার’ বিবেচনায় চলতি মৌসুমে বাম্পার ফলন হওয়ায় এ অঞ্চলের আমবাগানগুলো ব্যাপকভাবে মুকুলিত ও আমের গুটি দৃশ্যমান হওয়ায় লাভের আশায় বুক বেধছেন চাষি ও বাগানিরা। এখন পর্যন্ত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় বাগানগুলোর গাছে গাছে পাতার ফাঁকে ফাঁকে দুলছে আমের গুটিও। তবে যত্ন করেও আমের গুটি ছরে পড়ার খুব একটা সমাধান না পেয়ে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কায় এ অঞ্চলের চাষিরা।
জানা গেছে, এরই মধ্যে তাপপ্রবাহে বেশির ভাগ আমগাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গুটি ঝরে পড়েছে। এই অবস্থা আর ১০ দিন টানা চললে রাজশাহীর আমের মুকুল অনুযায়ী এবার ফলন অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন বাগান মালিকরা। তবে কৃষি বিভাগ ও ফল গবেষকরা বলছেন, কিছু গুটি আম ঝরে গেলেও বাকিগুলো টিকিয়ে রাখলে সংকট হবে না। মাঝে তিন দিনে মাত্র ১৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আবার কোথাও হয়নি। পাশাপাশি বাতাসের আর্দ্রতা কমেছে। মাটি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। ফলে আমের গুটি শুকিয়ে যাচ্ছে। তাই দাবদাহ ও খরায় আমের গুটি ঝরে পড়া রোধে গাছের গোড়ায় রাতে অথবা খুব ভোরে পানির সেচ দিতে হবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, এরই মধ্যে অনেক বাগানের অন্তত ৫০ শতাংশ গুটি ঝরে গেছে। আম রক্ষায় অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ ছিটিয়েও কাজ হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ ছিটাতে হচ্ছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ- এই তিন জেলায় ৯৮ হাজার ২৫৭ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। এছাড়া নাটোর পাবনা, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় আরও ৫ হাজার ৪৭৮ হেক্টর জমি আম চাষের আওতায় আছে। সবচেয়ে বেশি ৩৮ হাজার ৬০৮ হেক্টর আমবাগান রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। রাজশাহী অঞ্চলের এই পরিমাণ বাগান থেকে চলতি মৌসুমে সাড়ে ১১ লাখ টন আম উৎপন্ন হবে বলে কৃষি বিভাগের আশা। এই পরিমাণ আমের বাজারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। তবে চলতি বছর শুধু রাজশাহী জেলায় ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। এটি গত বছরের চেয়ে ২৪ হেক্টর বেশি। চলতি বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৬০ হাজার ১৬৫ টন ধরা হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কাজনক হারে আমের গুটি ঝরে পড়ায় লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা আম চাষিদের।
রাজশাহীর আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, ‘অনইয়ার’ বিবেচনায় চলতি মৌসুমে বাগানে গাছে গাছে প্রচুর মুকুল এসেছে। সেই মুকুল থাকলে অনেক আম হতো। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে ও তাপপ্রবাহে অনেক বাগানে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ গুটি ঝরে গেছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, গত ১৯ মার্চ রাত ২টা থেকে পরের দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজশাহীতে মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর আগে ৪ মার্চ এক মিলিমিটার এবং পরদিন তিন মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এরপর আর বৃষ্টিপাত হয়নি। এর মধ্যে রোদের তীব্রতা বেড়েছে। ফলে আমের গুটি পুড়ে বা ডগা মরে তা ঝরে যাচ্ছে।ফলে আমগাছে পানি ও কীটনাশক দিয়েও গুটি রক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রতি বছরই আমের কিছু গুটি ঝরে যায়। কিন্তু চলতি মৌসুমে দাবদাহে অনেক বাগানে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ আমের গুটি ঝরে গেছে। এতে ব্যাপক লোকসানের শঙ্কা জেগেছে।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিহারিপাড়া গ্রামের আসিফ ইকবালের ৩০ বিঘার বাগানে দেশি-বিদেশি ৭২ জাতের আমগাছ রয়েছে। তিনি বলেন, বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হপার পোকা ও আচা পোকা বাগানে আমের ক্ষতি করেছে। এ ছাড়া, আম ছিদ্রকারী পোকা উড়ে এসে হুল ফুটিয়ে চলে যাচ্ছে। সেজন্য কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। আবার অতিরিক্ত খরার কারণে গাছে থাকা অবস্থাতেও আমের বোঁটা শুকিয়ে কুঁচকে যাচ্ছে। যারা পরিমিত সেচ ও সঠিক মাত্রায় কীটনাশক স্প্রে করতে পারছেন তাদের গাছে আম এখনো ভালোই আছে। কিন্তু যারা করতে পারছেন না তাদের আম খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বাঘা উপজেলার আমচাষি সাজেদুর রহমান বলেন, ‘প্রচণ্ড দাবদাহে আম শুকিয়ে কালো রং ধারণ করছে। এ ছাড়া, পোকা ছিদ্র করায় আম শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। এতে আমের ফলন নিয়ে শঙ্কায় আছি।’
এক বছরে রাজশাহী বোর্ডে ঝরেছে ১৮ হাজার ৯৪৯ পরীক্ষার্থী
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম জানান, ২২ মার্চ থেকে রাজশাহী অঞ্চলে বয়ে চলেছে তাপপ্রবাহ। রাজশাহী অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা ২৮-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটাকে স্বাভাবিক ধরা হয়। ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। একইভাবে ৩৮-৪০ ডিগ্রিকে মাঝারি ও ৪০-৪২ ডিগ্রিকে তীব্র তাপদাহ এবং ৪২ এর উপরে গেলে সেটাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে। মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রের্কড করা হয়েছে ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এসময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৪৭ শতাংশ। এর আগে, গত ২৮ মার্চ রাজশাহীতে ৩৯ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ১ এপ্রিল রাজশাহী অঞ্চলে ৩৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল। কয়েকদিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে তাপপ্রবাহ আরও তীব্র হবে। সেক্ষেত্রে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করতে পারে। এতে প্রকৃতি ও জনজীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে তাপপ্রবাহ চলছে। বৃষ্টিও নেই। এ কারণে গুটি ঝরে যাচ্ছে। তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় আমগাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। তাহলে গুটি ঝরা কিছুটা হলেও রোধ হবে।’
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) শারমিন সুলতানা বলেন, ‘রাজশাহীতে বৃষ্টির অভাবে ও প্রচণ্ড খরার কারণে আমের মুকুল ঝরে পড়ছে। খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় খুবই সতর্কতার সঙ্গে গাছ পরিচর্যা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গাছের গোড়ায় অল্প পরিমাণ পানি ও পরবর্তীতে ইউরিয়া ও পটাশ সার দিতে হবে। এ ছাড়া, আমের গুটি রক্ষায় বরিক অ্যাসিডও স্প্রে করতে হবে। আমের মৌসুমে গাছে যে পরিমাণ মুকুল আসে তা শতভাগ থাকবে না এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে এই বছর মুকুল কিছুটা কম এসেছে। তবুও এখন পর্যন্ত গাছে যে পরিমাণ মুকুল বা গুটি আছে সেগুলো বড় হলে আমের সংকট হবে না।