শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৭:৪৩ অপরাহ্ন

রমজানের পবিত্রতা রক্ষার নামে ‌‘মোরাল পুলিশিং’ করছেন কারা?

রিপোর্টার / ০ বার
আপডেট : শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫

এবছর রমজানে দিনের বেলায় খাবারের দোকান খোলা রেখে এবং খাবার খেতে গিয়ে অনেকেই হামলা ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানান আলোচনা-সমালোচনা হতে দেখা যাচ্ছে।

সবশেষ গত বুধবার লক্ষ্মীপুরের একটি ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যেখানে দিনের বেলায় রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ায় বৃদ্ধসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করাতে দেখা গেছে।

এর আগে, নোয়াখালীর হাতিয়াতেও একদল ব্যক্তিকে পুলিশের মতো বাঁশি বাজাতে বাজাতে গিয়ে খাবারের দোকান বন্ধ করতে এবং হুমকি-ধামকি দিতে দেখা যায়। রমজানের ‘পবিত্রতা রক্ষার’ নামে চালানো এসব কর্মকাণ্ডে হোটেল মালিকসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

‘তারা কারা? তারা কি প্রশাসনের লোক যে, এভাবে গিয়ে দোকানপাট বন্ধ করছে, মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে? বেআইনিভাবে এরকম মোরাল পুলিশিং করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে, সেটা জানা দরকার,’ ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মানবাধিকার সংস্থা ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনে’র প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান।

এ ধরনের বেশকিছু ঘটনার সঙ্গে ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘উস্কানি’ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। যদিও দলগুলো সেটা অস্বীকার করছে।

এদিকে, ইসলামও এধরনের কোনো কাজ সমর্থন করে না বলে জানিয়েছেন ইসলামী গবেষক ও পণ্ডিতেরা। ‘কোরআন-হাদিসের ভুল ব্যাখা করে কেউ কেউ এগুলো করছে, কিন্তু ইসলাম এসব কাজকে একেবারেই সমর্থন করে না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ শফিক আহমেদ।

তাহলে কারা, কীভাবে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে, প্রশাসনই-বা তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছে-এসব প্রশ্ন উঠছে।

ঘটনার পেছনে কারা?

বাংলাদেশে গত কয়েক মাস ধরেই মব তৈরি করে বিভিন্ন মাজার ও দরগাহে হামলা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সুফিবাদ সার্বজনীন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে’র হিসেবে গত সাত মাসে ৯০টিরও বেশি মাজার ও দরগাহে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে, যার সঙ্গে ধর্মভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সদস্যরা যুক্ত রয়েছেন বলে শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছেন ভুক্তভোগীরা।

এখন রজমান মাসে এসে বিভিন্ন এলাকায় দিনের বেলা খাবারের দোকান বন্ধ ও শাস্তি দেওয়ার যেসব ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গেও ইসলামপন্থী কিছু দল ও গোষ্ঠীর সদস্যরা জড়িত রয়েছেন বলে জানাচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

“বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই এগুলো করছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় মাদ্রাসার সংখ্যা বেশি, সেখানে এরকম ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মি. রহমান।

সম্প্রতি নোয়াখালীর হাতিয়াতে দল বেঁধে গিয়ে খাবারের দোকান বন্ধ করার যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের গায়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নামে ভেস্ট দেখা গেছে।

এছাড়া ভেস্টের পেছনের অংশে দলটির নির্বাচনি প্রতীক ‘হাতপাখা’র ছবিও ছিল। বরিশালের মুলাদি এলাকার একই ধরনের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে একদল লোককে বাজারে ঘুরে ঘুরে খাবারের দোকান বন্ধ করতে দেখা যাচ্ছে ।

তাদের গায়েও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভেস্টে পরিচয় হিসেবে ‘স্বেচ্ছাসেবক’ লেখা রয়েছে। এদিকে, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় সভা করে রোজার মাসে দিনের বেলায় খাবারের দোকান খোলা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে।

হাজী শরীয়ত উল্লাহ সমাজকল্যাণ পরিষদের ব্যানারে আয়োজিত ওই সভায় বক্তাদের এটাও বলতে শোনা যায় যে, রমজানে দিনের বেলায় খাবারের দোকান খোলা রাখা হলে তাদের নেতাকর্মীরা এসে সেগুলো বন্ধ করে দিবেন।

‘যদি আমরা দেখি যে, দিনের বেলায় সেই চায়ের আড্ডা সেই টঙের দোকানে, চায়ের দোকানে চলছে, তাহলে একমাসের জন্য সেই দোকান আমরা সিলগালা করে দিব,’ বলেন এক বক্তা।

অন্যদিকে, রোজার মাসে দিনের বেলা হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ করাসহ সব ধরনের ‘অশ্লীলতা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা’ নেওয়ার আহ্বান জানান জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির শফিকুর রহমান। গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান মি. রহমান।

এর বাইরেও অনেকে রমজান মাসে দিনের বেলায় হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধের দাবি জানিয়ে কর্মসূচি পালন করেছেন। ‘আমরা লক্ষ করছি, এ ধরনের মিছিল ও আহ্বানের পরপরই ঢাকাসহ দেশের অনেক জায়গায় খাবারের দোকানগুলো বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে,’ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’।

পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন জেড আই খান বলেছেন, ‘খাবারের দোকান বন্ধ রাখা কিংবা খাবারের মতো অতি মৌলিক বিষয়টিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ কিংবা জোরপূর্বক খাবারের দোকান বন্ধ রাখার আহ্বান অথবা অনুরোধ, কোনোটাই কাম্য নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, নারী, শিশু, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ ও দিনমজুর এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য খাবারের দোকান বন্ধ রাখাটা অনেক সময় সংকট সৃষ্টি করছে।’

বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং দলের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে অনেক সময় অতিউৎসাহী লোকজনও দোকান-রেস্তোরাঁয় ‘মোরাল পুলিশিং’ করছে বলে অভিযোগ করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

লক্ষ্মীপুরের ঘটনাটি তেমনই একটি ঘটনা বলে জানা যাচ্ছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। ‘ঘটনার পর তিনি ভুক্তভোগিদের কাছে ক্ষমতা চেয়েছেন। বলেছেন, না বুঝেই আবেগের বসে ভুল করে ফেলেছেন। আর কখনো করবেন না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল মোন্নাফ।

দলগুলো কী বলছে?

ধর্মভিত্তিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ‘মোরাল পুলিশিং’য়ের অভিযোগ উঠলেও তারা অবশ্য জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করছেন। ‘দল হিসেবে আমরা কোনোভাবেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড সমর্থন করি না। কাজেই এগুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রশ্নই উঠে না,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মদ নেছার উদ্দিন।

নোয়াখালীর হাতিয়ার ঘটনায় জড়িতদের গায়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নাম ও নির্বাচনী প্রতীক সম্বলিত ভেস্টের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অপপ্রচার চালিয়ে আমাদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য অন্যরাও এটা করতে পারে।’

তারপরও বিষয়টি নিয়ে দলীয়ভাবে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক। ‘সেখানে যদি আমাদের নেতাকর্মীদের কারো জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, আমরা সাংগঠনিকভাবে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো,’ বলেন মি. উদ্দিন।

অন্যদিকে, আমিরের বক্তব্যে এ ধরনের কাজে ‘উস্কানি’ দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। ‘এটা একটা আহ্বানমাত্র। সেখানে তো বলপ্রয়োগের কোনো কথা বলা হয়নি। কাজেই ওই বক্তব্য থেকে অন্যরা উৎসাহিত হচ্ছেন, এমন অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রিয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ।

‘মোরাল পুলিশিং’য়ের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীরা জড়িত নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

প্রশাসন কী বলছে?

রমজানে জোর করে খাবারের দোকান বন্ধ করা এবং মানুষকে হেয় করার ঘটনায় প্রশাসনকে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ‘এতে মানুষ আরও আস্থা হারাচ্ছে এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার এসব ঘটনায় প্রশাসনও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনে’র প্রধান নির্বাহী সাইদুর রহমান।

নোয়াখালীর হাতিয়াতে খাবারের দোকান বন্ধ ও হুমকি-ধামকি দেওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আসে গত মঙ্গলবার। দুই দিনে কেউ বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

‘এ ব্যাপারে আমাদের কাছে কোনো কমপ্লেন আসে নাই। কেউ কমপ্লেন করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেএম আজমল হুদা। তবে ঘটনাটি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মি. হুদা।

লক্ষ্মীপুরের ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচিত হতে দেখা যায়। এ অবস্থায় নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন।

‘ঘটনা জানার পর আমরা অভিযুক্ত ব্যবসায়ীকে থানায় ডেকে এনে তার কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। তিনি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মি. মোন্নাফ।

কিন্তু অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়েছে? ‘আমি নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভুক্তভোগীদের সঙ্গে দেখা করে উনি ক্ষমা চাওয়ায় তারা আর অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,’ বলেন মি. মোন্নাফ।

বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন যে, কেউ আইন ভঙ্গ করলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াটা আমরা একদমই সমর্থন করি না। এটা করলে অবশ্যই তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন ধর্ম উপদেষ্টা খালিদ হোসেন।

কেউ বাধা ও হামলার শিকার হলে স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর পরামর্শ দিয়েছেন মি. হোসেন।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর