‘হি ইজ স্টিল আওয়ার বেস্ট প্লেয়ার’- জালাল ইউনুসের এই বক্তব্য দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল। শুধু বিসিবির পরিচালনা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করা এই কর্তাব্যক্তি কেন হবেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের বেশিরভাগই নিঃশ্বব্দে মেনে নেবেন কথাটা। ব্যাট-বলে মোহিত করে নিজের জায়গা এতটাই শক্ত করে নিয়েছেন সাকিব আল হাসান।
আবার যদি অন্যদিক থেকে দেখা যায়, ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজে চলেছে ‘সাকিব-বচন’। বাংলাদেশের ক্রিকেটে বাঁহাতি অলরাউন্ডার এমনই প্রভাবক হয়ে উঠেছেন যে, ২২ গজের খেলাটিরও ঊর্ধ্বে চলে গেছেন সম্ভবত। বিশ্বের বেশিরভাগ সুপারস্টারকে বিতর্ক ঘিরে রেখেছে বা রাখছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সুপারস্টারের চারপাশেও বির্তকের বাতাস বইবে, স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্নটা তখনই ওঠে, যখন দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তির গায়ে কালির ছিটে লাগে! তাতেও হয়তো কিছু আসে-যায় না। হলে সাকিব ইস্যুতে বারবার মিডিয়ায় ঝড় কিংবা প্রশ্নের বানে জর্জরিত হতো না বিসিবি।
সাকিবকে যদি একটা সিনেমা ধরা হয়, তাহলে সেই সিনেমার কাহিনি আগে থেকেই বলে দেওয়া যায়। ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে সেই পুরনো বচন- ‘সাকিব ভুল বুঝতে পেরেছে। এই ভুল আর করবে না।’ কিন্তু সাকিব-নামক সিনেমায় একঘেয়েমি আসে না। তাই বারবার ফিরে আসে একই মঞ্চ, একই দৃশ্য।
যার সবশেষ সংযোজন বেটউইনার-বিতর্ক। বাংলাদেশের আইনে ও বিসিবির আইনে জুয়া বা এর সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রমের কোনও জায়গা নেই। অথচ বেটিং প্রতিষ্ঠান বেটউইনারের সঙ্গে জড়িয়ে যান সাকিব। বেটিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি না হলেও অনেকটা ‘ঘুরিয়ে খাওয়ার’ মতো করে চুক্তি হয় দুই পক্ষের। বেটউইনারের ক্রীড়াবিষয়ক সংবাদমাধ্যম বেটউইনার নিউজের পণ্যদূত হিসেবে চুক্তি করেন সাকিব। এরপর থেকেই উত্তাল দেশের ক্রিকেট।
যে সাকিবকে অধিনায়ক করে এশিয়া কাপের দল ঘোষণার কথা, সেই তিনি কিনা জড়িয়ে গেলেন বেটউইনারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। অনেক জলঘোলার পর সাকিব চুক্তি থেকে সরে এসেছেন। বিসিবিও তাকে অধিনায়ক করে ঘোষণা করেছে এশিয়া কাপের দল। ‘হ্যাপি এন্ডিং’ বলতে যা বোঝায়! মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে হওয়ায় তার নেতৃত্ব খুব দরকার ছিল। অবশ্যই সাকিবের টি-টোয়েন্টি নেতৃত্ব পাওয়া সুদিনের পূর্বাভাস। কিন্তু আশঙ্কার মেঘ জমাট বাঁধে সব বিতর্কের শেষের একই দৃশ্যপটে!
গুলশানে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের বাসায় বৈঠক হয়েছে সাকিব ও এশিয়া কাপের দল নিয়ে। তবে অধিনায়ক কিংবা দল ঘোষণা করেননি পাপন। অধিনায়কের নাম জানিয়েছেন ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস আর দল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু।
আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত এই ফরম্যাটে সাকিবকে অধিনায়ক ঘোষণার পর জালাল ইউনুস জানিয়ে গেছেন, সাকিব ভুল বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পেরেছেন তার এমনটা করা উচিত হয়নি। ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যানের বক্তব্যটা এমন, ‘এটা (সাকিব ইস্যু) নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। সাকিব তার ভুল বুঝতে পেরেছে। তার আসলে এটার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঠিক হয়নি।’
দুই বছর আগে যখন জুয়াড়ির প্রস্তাব পাওয়ার তথ্য বিসিবি বা আকসুকে না জানিয়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সাকিব, তখনও বিসিবি থেকে একই কথা শোনানো হয়েছিল। সেবার সাকিব জুয়াড়ির প্রস্তাব ‘সিরিয়াসলি’ নেননি। আর এবার বুঝতে ভুল করেছেন। সেটি সংবাদমাধ্যমে জালাল ইউনুসই শুনিয়েছেন, “সাকিব (বিসিবি) প্রেসিডেন্টের (পাপন) সামনে এবং আমাদের সামনে বলেছে যে, ওটাকে (বেটউইনার নিউজ) অনলাইন নিউজ পোর্টটাল মনে করে চুক্তি করেছে। বিষয়টি ঠিক হয়নি। তাকে বুঝিয়ে বলার পর সে বলেছে, ‘আমি সেখান থেকে সরে এসেছি। এটাই শেষ।”
কিন্তু সাকিব যে বিসিবিকে না জানিয়ে এনডোর্সমেন্ট করলেন? কোনও শাস্তি না দিয়ে সাকিবের আশ্বাসেই বিশ্বাস রাখছে বিসিবি। জালাল ইউনুসের কথায় সেটিই ফুটে ওঠে, ‘আমরা তো বলেছি সে আমাদের সেরা ক্রিকেটার, সে দেশের বাইরের কেউ না। সে যখন বলেছে যে ভুল করেছে আমরা তা মেনে নিয়েছি। পরবর্তীতে যেন এমন ভুল না করে সেটা তাকে বলা হয়েছে এবং সাকিব তা মেনেও নিয়েছে। সে আশ্বাস দিয়েছে আমাদের বোর্ড প্রেসিডেন্টের সামনে, তাই মেনে নিয়েছি। এমন কিছু হলে আসলে কমপ্রোমাইজ করা উচিত না। কিন্তু যেহেতু দলের চিন্তা করে এবং সে যেহেতু বলেছে এবার আমরা মেনে নিয়েছি। আশা করছি, পরবর্তীতে এমন কিছু আর হবে না।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৬ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন সাকিব। সবচেয়ে বেশি বিদেশি লিগে খেলার অভিজ্ঞতাও তার। এমন একজন বোর্ডের নিয়মনীতি সম্পর্কে জানবেন না, সেটা আসলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সাকিব তো সেটিই করেছেন বিসিবিকে না জানিয়ে বেটিং প্রতিষ্ঠানের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে চুক্তি করে। সাকিবের ব্যাখ্যা সরাসরি পাওয়া যায়নি। তবে বিসিবি থেকে জানানো হয়েছে, ‘মিসগাইডেড’ হয়েছেন সাকিব। জালাল ইউনুসের বক্তব্যে আরও স্পষ্ট হওয়া যায়, ‘তার (সাকিব) কাছে মনে হয়েছে এটা মিসগাইডেড।’
অর্থাৎ বেটিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে না, এমনটা বোঝানো হয়েছিল সাকিবকে। তাহলে বিসিবিকে না জানিয়ে এনডোর্সমেন্ট করা, সেখানেও কি মিসগাইডেড সাকিব? মাঠের বাইরের ইস্যুতে তো বারবারই ‘পথভ্রষ্ট’ সাকিব!