মা দিবসের ইতিহাস: ভালোবাসা আর আন্দোলনের গল্প

‘মা’ শব্দটি এমন এক অনুভব, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে আদর, স্নেহ, ত্যাগ আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার গভীরতা। এই শব্দের মধ্যে আছে এমন এক টান, যা ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা সময়ের সীমানা মানে না। ঠিক এই কারণেই পৃথিবীর নানা দেশে ‘মা দিবস’ পালন করা হয় অত্যন্ত শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সঙ্গে। কিন্তু অনেকেই জানেন না, এই মা দিবস শুরু হয়েছিল শুধু ভালোবাসা দেখানোর জন্য নয়, বরং সমাজে পরিবর্তনের ডাক হিসেবেও। আজ আমরা জানব এই মা দিবসের পিছনের ইতিহাস, তার সূচনা, কিভাবে এটি ছড়িয়ে পড়ল গোটা পৃথিবীতে, আর কী বলছেন এ নিয়ে ইতিহাসবিদরা।
মা দিবসের ধারণা যে একেবারে নতুন কিছু নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন সভ্যতার মধ্যেই। গ্রিক ও রোমানরা পালন করত ‘মাতৃদেবী’দের সম্মান জানানোর উৎসব। গ্রিকরা রেয়া নামে এক দেবীর পূজা করত, যাকে মনে করা হতো দেবতাদের জননী। রোমানরাও “Hilaria” নামে একটি উৎসব পালন করত মার্চ মাসে, যা ছিল মাতৃত্বকে সম্মান জানানোর রীতি। তবে আধুনিক মা দিবসের সূচনা এসব পৌরাণিক উৎসব থেকে নয়, বরং এক নারীর ব্যক্তিগত কষ্ট, ভালোবাসা আর সামাজিক উদ্যোগ থেকেই।
এই নারীর নাম আনা জার্ভিস। তিনি ছিলেন আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা। ১৯০৫ সালে তাঁর মা অ্যান রিভস জার্ভিস মারা যান। অ্যান ছিলেন একজন সমাজকর্মী। তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছিলেন গৃহযুদ্ধের সময় আহত সৈনিকদের সেবা করা, এবং নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য কাজ করে। তাঁর ইচ্ছা ছিল, মায়েদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য একটি দিন থাকুক। আনা এই ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে উদ্যোগ নেন।
১৯০৮ সালে আনা জার্ভিস প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার গ্রাফটনে একটি চার্চে মা দিবস পালনের আয়োজন করেন। সেদিন ৪৭০ জন মানুষ উপস্থিত ছিলেন। আনা সাদা কার্নেশন ফুল বিলিয়ে দেন, যেটি ছিল তাঁর মায়ের প্রিয় ফুল এবং এখনো অনেক দেশে মা দিবসে কার্নেশন ফুল দেওয়ার প্রথা রয়েছে। এরপর আনা শুরু করেন ব্যাপক আন্দোলন। চিঠি লিখতে থাকেন রাজনৈতিক নেতাদের, বিভিন্ন গির্জা, ব্যবসায়ী আর নারীদের সংগঠনের কাছে। তার এই আন্দোলনের ফল মেলে ১৯১৪ সালে, যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ঘোষণা করেন, মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার হবে ‘মা দিবস’।
তবে আনার জীবনের সবচেয়ে বড় হতাশা এসেছিল তখন, যখন এই মা দিবস বাণিজ্যিক রূপ নিতে শুরু করে। গিফট কার্ড, ফুল, চকোলেট—সবকিছু দিয়ে মার্কেট মা দিবসকে ব্যবসায়িক উৎসবে পরিণত করে ফেলে। আনা জার্ভিস এ নিয়ে এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে তিনি একসময় আদালতে গিয়ে মা দিবস বাতিল করার মামলা পর্যন্ত করেন। তিনি বলেন, “আমি কখনো চাইনি মা দিবস হোক একটি লাভের দিন। এটা হোক ভালোবাসা প্রকাশের দিন, একান্ত অনুভবের জায়গা।” এই বক্তব্যের ভিত্তিতে মার্কিন ইতিহাসবিদ ড. ক্যাথলিন হাওয়ার্ড বলেন, “আনা জার্ভিস নিজেই তার সৃষ্টি করা দিবসের ভিকটিম হয়ে গিয়েছিলেন। তার ভাবনা ছিল বিশুদ্ধ, কিন্তু সমাজ সেটাকে বাণিজ্যে পরিণত করে।”
এখানেই প্রশ্ন আসে, আনার আগে কি কেউ মায়ের সম্মানে কোনো দিবস পালনের কথা ভেবেছিলেন না? আসলে এরও ইতিহাস রয়েছে। আনার মায়েরই সমসাময়িক ছিলেন জুলিয়া ওয়ার্ড হাও নামে এক সমাজকর্মী, যিনি ‘মাদারস পিস ডে’ নামে একটি আন্দোলন শুরু করেছিলেন ১৮৭০ সালে। তিনি আমেরিকান গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা দিতে চেয়েছিলেন মায়েদের সম্মিলিত কণ্ঠে। তাঁর মতে, “মা যদি সন্তান জন্ম দিতে পারে, তাহলে তারই অধিকার আছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর।” হাওয়ের এই ভাবনা রাজনৈতিক ও মানবিক ছিল। কিন্তু সেটি তখনকার সমাজে তেমন সাড়া ফেলেনি। ইতিহাসবিদ টমাস অ্যান্ডারসনের মতে, “হাওয়ের বক্তব্য ছিল সময়ের থেকে এগিয়ে, তাই সেই সময় তা জনমানসে পৌঁছায়নি।”
তবে আনা জার্ভিসের প্রচার এবং পরিশ্রম এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, মা দিবস ধীরে ধীরে আমেরিকা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে কানাডা, ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে। এখন প্রায় ৫০টির বেশি দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালন করা হয় মা দিবস। যদিও কিছু দেশে এই দিনটি আলাদা। যেমন, যুক্তরাজ্যে ‘মাদারিং সানডে’ পালিত হয় লেন্টের চতুর্থ রবিবার। আবার আরব বিশ্বে মা দিবস পালিত হয় ২১ মার্চ, যা বসন্তের সূচনার দিনও।
এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ওরেগনের কালচারাল অ্যানথ্রোপলজিস্ট ড. মেলিসা হ্যানিং। তিনি বলেন, “মা দিবসের ধারণাটি সংস্কৃতির ভিন্নতা অনুযায়ী বদলায়। কিন্তু মূল ভাবনা একটাই—মাতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা।” তিনি আরও বলেন, “যখন মা দিবসটি সমাজকে নারীর অবদান সম্পর্কে ভাবায়, তখন তা প্রকৃত অর্থে সফল হয়। কিন্তু যখন তা শুধুই দোকানের ডিসকাউন্ট অফারে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন মূল বার্তা হারিয়ে যায়।”
আধুনিক সময়ে অনেকেই মা দিবসকে কেন্দ্র করে নানা আলোচনা করেন। কেউ বলেন, বছরে একদিন মাকে স্মরণ করার মধ্যে কোনো অর্থ নেই—প্রতিদিনই হওয়া উচিত মা দিবস। আবার কেউ বলেন, এই একটি দিন অন্তত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কতটা ঋণী সেই নারীর কাছে, যিনি আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন। মনোবিজ্ঞানী ড. অ্যাঞ্জেলা ব্রুকস বলেন, “আজকের ব্যস্ত জীবনে আমরা অনেক সময় মা-বাবাকে অবহেলা করি। মা দিবস যেন আমাদের সেই ভুল বুঝিয়ে দেয়, এবং অন্তত একদিন হলেও আমরা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারি।”
সোশ্যাল মিডিয়া, মোবাইল ফোন, গিফট কার্ড—এসব হয়তো মা দিবসকে এখন আধুনিক করেছে, কিন্তু এর পেছনের গল্পটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভালোবাসা আর ত্যাগের গুরুত্ব। মা দিবস কেবল একটি দিবস নয়, এটি একটি বার্তা—ভালোবাসার মানুষকে জানাও, যে তুমি তাকে ভালোবাসো। যে মা সারাজীবন নিঃস্বার্থভাবে তোমার পাশে থেকেছেন, তাকে অন্তত একদিন বলে দাও—‘তুমি আছো বলেই আমি আছি।’