মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় গণমাধ্যমের সংস্কার জরুরি

দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে গণমাধ্যমের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’। সোমবার (১০ মার্চ) গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য আর্টিকেল ১৯ এর অ্যাডভোকেসির অংশ হিসেবে, আমরা ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ মিডিয়া রিফর্ম কমিশনের কাছে প্রয়োজনীয় আইনি ও নীতিগত সংস্কারের জন্য সুপারিশ প্রেরণ করেছি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, অবাধ, স্বাধীন ও নিরাপদ গণমাধ্যম পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং দেশের গণমাধ্যমের সার্বিক পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে আর্টিকেল ১৯ স্বাগত জানায়।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি বৈচিত্র্যময় হলেও সাংবাদিকদের জন্য আইনি সুরক্ষার অনুপস্থিতি, গণমাধ্যমগুলোর মালিকানায় রাজনৈতিক প্রভাব, এবং উচ্চমাত্রার সেল্ফ সেন্সরশিপের কারণে তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আর্টিকেল ১৯ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তি (ICCPR) অনুযায়ী দমনমূলক আইনগুলো পর্যালোচনা ও সংশোধন করার আহ্বান জানাচ্ছে।
এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে– ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮, যা মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহিতা, সার্বভৌমত্ব বিরোধী ও শালীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ বা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা প্রদান করে।
– বাংলাদেশ টেলিভিশন অথরিটি অ্যাক্ট ২০০১; এটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে টেলিভিশন সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণে কঠোর ক্ষমতা প্রদান করে;
– টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট ১৮৮৫ এবং ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট ১৯৩৩, যা তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ক্ষমতা প্রদান করে;
– অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩, এটি সাংবাদিকদের উপর বিশেষ করে যারা জনস্বার্থে কাজ করছেন তাদের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করে।
– সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট ১৯৬৩;
– রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট ২০০৯;
– সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০২৩, যা অনলাইন কার্যকলাপের উপর নজরদারি করে এবং অনলাইনে কী ধরনের তথ্য ও মতামত প্রকাশ করা যাবে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে;
– প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস (ডিক্লারেশন অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট ১৯৭৩;
– দন্ডবিধি ১৮৬০, যা মানহানি, আদালতের অবমাননা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শালীনতা এবং জনসাধারণের নৈতিকতার বিষয়গুলো তুলে ধরে;
– তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) আইন ২০০৬, যা জাতীয় অখণ্ডতা, জনশৃঙ্খলা এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের মত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য;
– ড্রাফট ডাটা প্রটেকশন আইন ২০২৫;
– খসড়া জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নীতিমালা ২০২৪; এই আইনটি পাস হলে অতিরিক্ত নজরদারি, কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ ও অ্যালগরিদমিক পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি হবে। এতে করে ভিন্নমত এবং স্বাধীন সাংবাদিকতাকে দমন করার প্রবণতা তৈরি হবে;
– পোস্ট অফিস অ্যাক্ট ১৮৬৯;
– ফরেন রিলেশনস অ্যাক্ট ১৯৩২;
– স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট ১৯৭৪;
– প্রোহিবিশন অব ইনডিসেন্ট অ্যাডভার্টাইজমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৬৩;
– দেওয়ানি কার্যবিধি ১৯০৮;
– কন্টেম্পট অব কোর্ট অ্যাক্ট ২০১৩;
– প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪
আমাদের অন্য সুপারিশসমূহ হলো
১. নারী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন ১৩২৫ অনুযায়ী বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারকে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
২. তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা: সরকারকে অবশ্যই ইন্টারনেট বন্ধ, কনটেন্ট ব্লকিং বা ফিল্টারিং এর মত কাজগুলো বর্জন করে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে যাতে করে নাগরিকদের ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতা এবং তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার সুরক্ষিত থাকে।
৩. সাংবাদিকদের যথাযথ বেতন এবং সুবিধা নিশ্চিত করা: অপর্যাপ্ত বেতন কাঠামো এবং পর্যাপ্ত সুবিধার অভাবে সাংবাদিকদের পেশাগত মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাংবাদিকদের দায়িত্বশীলভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে একটি ন্যায্য বেতন কাঠামো, নিরাপদ কাজের পরিবেশ, অবসরকালীন সুবিধা এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মিডিয়া মালিকদের সাথে সমন্বয় করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের জন্য অপরিহার্য।
৪. সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং আইনি সহায়তা প্রদান: সাংবাদিকরা যেন স্বাধীনভাবে এবং নির্ভয়ে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে সেই লক্ষ্যে সরকারকে সাংবাদিকদের উপর হামলা এবং হুমকির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি মিথ্যা এবং হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আর্টিকেল ১৯ বাংলাদেশ সরকারকে এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করার এবং গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও মানবাধিকারকে সমুন্নত করে এমন একটি মিডিয়া পরিবেশ গড়ে তোলার আহ্বায়ন জানায়।