শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:২৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তনে প্রক্রিয়া মানা হয়নি: ইউনেসকো

রিপোর্টার / ৪ বার
আপডেট : শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

বাংলা নববর্ষ বরণে পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত শোভাযাত্রার নাম এ বছর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ থেকে পালটে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ করা হয়েছে। ইউনেসকোর অধরা সংস্কৃতির তালিকায় ছিল এই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। কিন্তু এ ধরনের কোনো ঐতিহ্যের পরিবর্তনে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকলেও বাংলাদেশ মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি বলে জানিয়েছে ইউনেসকো।

শোভাযাত্রা উদযাপন কমিটির প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ বলেছেন, সরকার নাম পরিবর্তনের জন্য ইউনেসকোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কি না, সেটি তার জানা নেই।

আজহারুল ইসলাম শেখ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ এর মূল যে স্পিরিট (চেতনা), আমাদের সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য, ইউনেসকোর যে মূল চেতনা, কোথাও নামের ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয় না। ইউনেসকোর ইনস্ক্রিপশনে যেভাবে বলা আছে, তাতে নাম পরিবর্তনে কোথাও কোনো বাধা নেই।

বদলে গেল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রার’ নাম

তবে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ডয়েচে ভেলেকে জানিয়েছেন, এ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া রয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।

ইউনেস্কোর এক মুখপাত্র বলেন, ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গতিশীল ও জীবন্ত প্রকৃতি স্বীকার করে, এমন পরিবর্তনের জন্য একটি স্পষ্ট পদ্ধতি রাখা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ২৪টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত কনভেনশনের গভর্নিং বডির কালচারাল হেরিটেজ কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হয়।’

ইউনেসকোর মুখপাত্র জানিয়েছেন, ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ইউনোসকোর কাছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জমা দেওয়া হয়নি।

মঙ্গল শোভাযাত্রা: বদলে গেল নাম, বদলাবে কি বার্তা?

২০১৬ সালে ‘পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে ইউনেসকোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশ। বাংলা একাডেমির তৎকালীন ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের পরিচালক শাহিদা খাতুন এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি জানান, একবারে এই স্বীকৃতি আসেনি। বরং তৃতীয় বার আবেদন করার পর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এই স্বীকৃতি পেয়েছিল।

শাহিদা খাতুন বলেন, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই স্বীকৃতি এসেছে। আমরা আড়াই বছর ধরে ফাইল রেডি করেছি। আমরা কেবল ফাইল দিয়েছি আর হয়ে গেছে, এমনটা নয়। অনেক যাচাই-বাছাই হয়েছে। আমরা কেন হলো, কীভাবে হলো, কেন আমরা করতে যাচ্ছি— এসব বিষয়ে ১২১ জন আর্টিস্টের মতামত নিয়েছি। এটি মঙ্গল বা আনন্দের বিষয় নয়, বিষয় ছিল সম্প্রীতির বাংলাদেশ। এটি কিন্তু কোনো ইজম (মতাদর্শ) বা কোনো ধর্মের বিষয় নয়।

ইউনেসকোর কাছে আবেদনের আগেও বেশ কয়েকবার নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল— এমন তথ্যও জানিয়েছেন শাহিদা খাতুন। তিনি বলেন, আমরা টাইটেলটা অনেকবার বদলেছিলাম। প্রথমে আমরা দিয়েছিলাম পহেলা বৈশাখ। কিন্তু পহেলা বৈশাখ অনেক বড় একটা ব্যাপার। এর মধ্যে অনেক জাতিগোষ্ঠী জড়িত। এ জন্য উনারা (ইউনেসকো) আমাদের পরামর্শ দিয়েছিল, এটা না দিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু যেন দেওয়া হয়।

বর্ষবরণের শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল

উদযাপন পরিষদের প্রধান অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ অবশ্য নাম পরিবর্তনের বিষয়ে এর আগে বলেছিলেন, ১৯৯০ সালে যখন আনন্দ শোভাযাত্রা নাম পরিবর্তন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, সেটি রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছিল। এখন নাম পুনরুদ্ধার করে আওয়ামীমুক্ত করা হলো৷।

তবে শাহিদা খাতুন জানিয়েছেন, ইউনেসকোর কাছে নাম প্রস্তাবের সময় সবার মতামত নিয়েই করা হয়েছিল। ‘আমাদের হাত দিয়ে যেটা প্রসব হয়েছে, সেটার প্রতি একটা মমত্ব তো থাকেই। তখন কিন্তু শুধু আমরা না, আমাদের সঙ্গে এই অঙ্গনে কাজ করা অনেক সুধীজন ছিলেন, দলমত নির্বিশেষে আমরা এটা করেছি।’

নাম পরিবর্তনে ইউনেসকোর স্বীকৃতিতে প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন অধ্যাপক মো. আজহারুল ইসলাম শেখ। তিনি বলেন, ইউনেসকোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়— কালচারাল ডাইভারসিফিকেশন (সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য), ডায়লগ (সংলাপ) ও র‌্যালির বিউটিফিকেশন বা ভিজিবিলিটি (সৌন্দর্য বা দৃশ্যমানতা)। এগুলো ঠিক থাকলে ইউনেসকোর কোনো বাধা থাকবে না বলে মনে করেন চারুকলার এই শিক্ষক।

বর্ষবরণের আনন্দ শোভাযাত্রায় ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’

তবে এ বিষয়ে ডিডাব্লিউকে দেওয়া বিবৃতিতে অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষায় করা কনভেনশনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণের কথা উল্লেখ করেছে ইউনেসকো। এই নীতিমালায় ১২টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ‘পারস্পরিক সম্মান’, ঐতিহ্য রক্ষায় বিভিন্ন অংশীদারের মধ্যে ‘স্বচ্ছ সহযোগিতা, সংলাপ, আলোচনা, পরামর্শ।’

সংস্থাটি বলছে, এই নীতিমালায় জোর দেওয়া হয়েছে ‘অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গতিশীলতা এবং জীবন্ত প্রকৃতিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্মান করা’র ওপর। পাশাপাশি অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা এটি অনুশীলনকারী সম্প্রদায়ের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে— এমন যেকোনো পদক্ষেপের ও পরোক্ষ, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি, সম্ভাব্য ও সুনির্দিষ্ট প্রভাব সাবধানতার সঙ্গে মূল্যায়ন করা উচিত।

নাম পরিবর্তনের ফলে ইউনেসকোর স্বীকৃতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, এ বিষয়ে ইউনেসকোর বিবৃতিতে কিছু বলা হয়নি।

এখন পর্যন্ত ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় ১৫০টি দেশের ৭৮৮টি ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত রয়েছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের পাঁচটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ২০০৮ সালে বাউল গান, ২০১৩ সালে জামদানি শিল্প, ২০১৬ সালে পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, ২০১৭ সালে সিলেটের শীতল পাটি এবং ২০২৩ সালে ঢাকার রিকশা চিত্র এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

তরমুজের মোটিফ দিয়ে শোভাযাত্রায় ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি

এখন পর্যন্ত এ তালিকা থেকে কোনো ঐতিহ্যকে একেবারে বাদ দিয়ে দেওয়ার উদাহরণ নেই। তবে কোনো ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়লে সেটিকে ‘জরুরি সুরক্ষার দাবিদার অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ নামের আরেকটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

গত বছর অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় ইন্দোনেশিয়ার রেওং পোনোরোগো পারফর্মিং আর্টকে এই তালিকায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারের কারণে সম্প্রদায়ের অনেকে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য পালনে বিমুখ হওয়ায় বোতসোয়ানার বাকালাংগা সম্প্রদায়ের ওসানা ঐতিহ্যকেও এই তালিকায় সরিয়ে আনা হয়েছে।

ইউনেসকোর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে একাধিকবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও সংস্কৃতি সচিব মো. মফিদুর রহমানের মোবাইল নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেননি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর