প্লাস্টিকের আবর্জনায় পাখিদের ঘরবসতি; মারাত্মক হুমকিতে বিশ্বের জীববৈচিত্র্য

অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশেই প্লাস্টিকের আবর্জনার ফাঁদে আটকা পড়ছে পাখিরা।ব্যবহারের পর প্রতিদিন মানুষের ফেলে দেওয়া বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক সামগ্রী বিশ্বের জীববৈচিত্র্যকে কীভাবে মারাত্মক হুমকির দিকে ঠেলে দিয়েছে, তার কিছু নমুনা উঠে এসেছে পাখিদের নিয়ে এক গবেষণায়।
নরওয়েতে প্লাস্টিকের দড়ি এবং মাছ ধরার সরঞ্জাম দিয়ে বাসা বেঁধেছে সামুদ্রিক পাখি গ্যানেট। ছবি: সিমন পিয়ার্স/বিবিসি
বিবিসি জানিয়েছে, প্লাস্টিক বর্জ্য এবং পাখিদের উপর এর প্রভাব নিয়ে অনলাইনে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়। ‘বার্ডস অ্যান্ড ডেবরিস’ শিরোনামে চার বছর ধরে চলা এই প্রজেক্টে সাধারণ মানুষের কাছে তার এলাকার ছবি চাওয়া হয়। জমা পড়া ছবিতে গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, কেবল অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া সব মহাদেশেই প্লাস্টিকের মধ্যে বাসা বাঁধছে পাখিরা, কিংবা প্লাস্টিকের মধ্যেই বিচরণ করছে।

মাছ ধরার পট্লাস্টিকের সুতো আটকে গেছে পাখির ঠেঁটে। ছবি: জো চোয়ানিক/বিবিসি
বাসা বানাতে তারা ব্যবহার করছে প্লাস্টিকের দড়ি, প্লাস্টিকের বরশির সুতো, মাছ ধরার জালে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের বেলুন আর রিবন কিংবা ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। আসলে প্লাস্টিকের ফাঁদে আটকা পড়ছে তারা।
প্রায় এক শতাংশ ছবিতে দেখা গেছে, বিপুল পরিমাণ ফেইস মাস্ক জমেছে পাখিদের বিচরণ ক্ষেত্রে, যা কোভিড মহামারীর দুই বছরে ফেলে দিয়েছে মানুষ। পাখিরা সেগুলো দিয়ে বাসা বানাচ্ছে; মাস্কের ফিতা তাদের গলা বা মুখে আটকে আছে- এমন ছবিও জমা পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বুনোহাঁসের গলায় মাস্ক। ছবি: মেরি ক্যাপোরাল প্রিওর/বিবিসি
এ গবেষণায় যুক্ত লন্ডনের নেচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের গবেষক ড. অ্যালেক্স বন্ড বিবিসিকে বলেন, যে পাখি লম্বা আঁশের উপকরণ যেমন- সামুদ্রিক শৈবাল, ডালপালা বা নলখাগড়া দিয়ে বাসা বানায়, এখন তার বাসায় মানুষের ফেলে দেওয়া বর্জ্য পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। বন্ড ও তার সহকর্মীদের লক্ষ্য ছিল- পরিবেশে প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যাপক সমস্যার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আপনি যদি নিজেই খুঁজে দেখতে চান, তাহলে এরকম প্রচুর নমুনা আপনার আশপাশে দেখতে পাবেন। বিশাল ভৌগলিক এলাকাজুড়ে এটা এখন খুব সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছে। আমাদের কাছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাজ্য ও উত্তর আমেরিকার তথ্য আছে, এটি সত্যিই একটি বৈশ্বিক সমস্যা।

ইংল্যান্ডের সাসেক্সে একটি ভবনে তার বাঁধার প্লাস্টিকের ফিতা দিয়ে বাসা বুনেছে কবুতর। ছবি: ম্যাথিউ আইরিশ/বিবিসি
বর্জ্যের মধ্যে মহামারীর মধ্যে ফেলে দেওয়া মানুষের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) ছবি কতগুলো আছে, সেই হিসাবও করেছে গবেষক দলটি। দেখা গেছে, জমা পড়া ছবির প্রায় এক চতুর্থাংশেই কোনো না কোনো সুরক্ষা উপকরণ আছে। বন্ড বলেন, বেশিরভাগই মাস্ক। আপনি যদি সার্জিক্যাল মাস্ক তৈরি উপাদানগুলোর কথা ভাবেন, সেখানে এমন ইলাস্টিক বা রাবারের তন্তু আছে, যা পাখির পায়ে আটকে থাকতে দেখা গেছে। কিংবা সেই তন্তু বা প্লাস্টিকের টুকরো গিলে ফেলতে গিয়ে পাখি বিপদেও পড়েছে। আমরা হয়ত সাধারণভাবে‘প্লাস্টিক’ শব্দটি ব্যবহার করছি; তবে এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পলিমারও আছে, মাস্ক এর ভালো একটি উদাহরণ।

সিঙ্গাপুরে কালো বকের গলায় মানুষের ব্যবহৃত মাস্ক। ছবি: অ্যাড্রিয়ান সিলাস টে/বিবিসি
গবেষকরা বলছেন, পরিবেশে জমা হওয়া বিপুল পরিমাণ বর্জ্য অপসারণের প্রক্রিয়াগত সমস্যার দিকটিও তারা তুলে ধরতে চান। কানাডার ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির প্রধান গবেষক জাস্টিন আমেন্ডোলিয়া বিবিসিকে বলেন, বিশ্বে বিভিন্ন প্রজাতির ওপর প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রভাব যে বিপুল বিস্তৃতি পেয়েছে, তা মারাত্মক।

আমেরিকায় দোয়েলের গলায় আটকানো মাস্কের ফিতা ছাড়াচ্ছেন এক তরুণ। ছবি: জ্যাক ক্যানি/বিবিসি
২০২০ সালের এপ্রিলে কানাডার একটি গাছে মাস্কের সঙ্গে আটকে একটি পাখি ঝুলছিল, ওই দৃশ্য পরে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশের কতটা ক্ষতি করে ফেলেছে, এটা তাই দেখাচ্ছে।

বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক দিয়ে বাসা বানিয়েছে নেদাল্যান্ডসের জলচর পাখি কুট। ছবি: স্যাম এম/বিবিসি
গবেষক বন্ড বলেন, আমরা যদি শুধু বাঁশের টুথব্রাশ বা ক্যানভাস শপিং ব্যাগ ব্যবহার করতে শুরু করি, তাতে বিশ্বকে বাঁচাতে পারব না। কারণ প্লাস্টিকের উৎপাদন এখন বিরাট শিল্প আর বাণিজ্যিক বিষয়। তার মতে, এখন উপরের দিক থেকে সরকারকে যথাযথ নীতি গ্রহণ করতে হবে, আর নিচ দিক থেকে মানুষকে তা অনুসরণ করতে বাধ্য করতে হবে। যাতে মানুষ সত্যিই বুঝতে পারে যে- যথেষ্ট হয়েছে।

প্লাস্টিকের বস্তার ঝুট দিয়ে বাসা বুনছে পাখি। ছবি: ম্যালকম জলি/বিবিসি
পিএইচডি গবেষক আমেন্ডোলিয়া বলেন, প্রথমবার যারা পাখিদের ওই ছবিগুলো দেখেছেন, তারা হয়ত খানিকটা কষ্ট পাবেন, কিংবা মর্মাহত হবেন। কিন্তু মানুষকে কোভিড মহামারীর মধ্যে এই প্রাণীগুলোকে যে অপ্রয়োজনীয় ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হল, সেখান থেকেও মানুষকে শিখতে হবে।