মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:৩৯ পূর্বাহ্ন

প্রবীণ রাজনীতিক রনো আর নেই

ভয়েস বাংলা প্রতিবেদক / ৩৩ বার
আপডেট : রবিবার, ১২ মে, ২০২৪

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) উপদেষ্টা ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার আকবর খান রনো আর নেই। শনিবার রাত ২টা ৫ মিনিটে রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি একমাত্র মেয়ে রানা সুলতানাসহ বিপুলসংখ্যক আত্মীয়-স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভাকাক্সক্ষী রেখে গেছেন।
তাঁর মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বিরোধী দলের নেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা শোকজ্ঞাপন করেছেন। সোমবার সকাল ১০টায় হায়দার আকবর খান রনোর মরদেহ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কার্যালয় মুক্তিভবনে নেওয়া হবে। সেখানে পার্টির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। বেলা ১১টায় হায়দার খান রনোর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। জাতির পক্ষ থেকে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। দুপুর দেড়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। সোমবার সারাদেশে পার্টি কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন, দলীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও শোক দিবসের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে।
প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং লেখক হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইং থেকে পাঠানো বার্তায় এ শোক জানানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী শোকবার্তায় হায়দার আকবর খান রনোর আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন এবং গুণগ্রাহীদের প্রতি সমবেদনা জানান।
ওবায়দুল কাদেরের শোক ॥ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) উপদেষ্টা, মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং লেখক হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এক শোক বিবৃতিতে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, গুণগ্রাহীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
জাতীয় পার্টি ॥ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এমপি। এক শোকবার্তায় প্রয়াতের বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করেছেন। একইসঙ্গে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান তিনি।
শোকবার্তায় বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। গণমানুষের দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিলেন আজীবন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহসাই পূরণ হওয়ার নয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির উপদেষ্টা হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে একইভাবে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও জাতীয় পার্টি মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু এমপি।
জাসদ ॥ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার দেশের বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা, সংগ্রামী জননেতা, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, লেখক কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার-স্বজন-সহযোদ্ধাদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েছেন।
সিপিবি ॥ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) অন্যতম উপদেষ্টা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে সিপিবি। শনিবার সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ শোক জানানো হয়।
হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে দেশ একজন দেশপ্রেমিক, আজীবন সংগ্রামী, দেশের মানুষের শোষণ মুক্তির সংগ্রামের প্রিয় মানুষকে হারাল।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কমরেড রনো ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ, এ দেশে অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবিচল ছিলেন। জেল-জুলুম নির্যাতন উপেক্ষা করে তিনি তার সংগ্রামী জীবন অব্যাহত রেখেছিলেন। একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি অসংখ্য লেখনী রেখে গেছেন, যা নতুন প্রজন্মের জন্য সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে থাকবে। তিনি জীবনের শুরুতে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন।
ছাত্র আন্দোলন শেষে শ্রমিকের লড়াইয়ে শামিল হন তিনি। এ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি আন্দোলনকেও ত্বরান্বিত করেছেন। বিবৃতিতে তার শোকসন্তপ্ত পরিবার পরিজনের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলা হয়, তার কর্মযজ্ঞকে সামনে রেখে আগামী দিনে দেশে সমাজতন্ত্র তথা ‘মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ’ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বেগবান করার মধ্য দিয়ে তাকে প্রতি মুহূর্তে আমরা স্মরণ করব।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে ক্রনিক ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হায়দার আকবর খান রনো যান্ত্রিক অক্সিজেন সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কয়েক দিন ধরে তাকে অধিক অক্সিজেন সহায়তা দেওয়া হচ্ছিল। খাবার গ্রহণ করতে না পারায় তিনি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। এসব অসুস্থতাসহ তীব্র শ্বাসতন্ত্রীয় অসুখ (টাইপ-২ রেসপিরেটরি ফেইল্যুর) নিয়ে গত ৬ মে সন্ধ্যায় হাসপাতালে ভর্তি হন।
১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট অবিভক্ত ভারতের কলকাতায় হাতেম আলী খান ও কানিজ ফাতেমা মোহসিনার সংসারে জন্ম হায়দার আকবর খান রনোর। তার একমাত্র ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক প্রয়াত হায়দার আনোয়ার খান জুনো। ১৯৫৮ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মেধা তালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিক পাসের পর নটরডেম কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন রনো। তবে কারান্তরীণ থাকায় তিনি স্নাতক শেষ করতে পারেননি। এরপর জেলখানার বসেই পরীক্ষা দিয়ে এলএলবি ডিগ্রি পান। পরবর্তীতে হাইকোর্টের সনদ পেলেও এটিকে পেশা হিসেবে নেননি।
রাজনৈতিক অঙ্গন ॥ ১৯৬১ সালে হায়দার আকবর খান রনো তদানীন্তন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে শীর্ষ পর্যায়ে ভূমিকা রাখেন। ওই সময় ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তদানীন্তন সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।
শিক্ষা জীবন শেষে শ্রমিক আন্দোলনে যোগদান করেন এবং টঙ্গী অঞ্চলে শ্রমিক বস্তিতে বাস করে গড়ে তোলেন এক নতুন ধারার সংগ্রামী শ্রমিক আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবে উঠে আসেন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন হায়দার আকবর খান রনো।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। ওই সময় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে ১৪টি আধামুক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। এই সংগঠনের প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই অঞ্চলগুলোতে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন শতাধিক।
স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম রূপকার ছিলেন এই নেতা। ২০১০ সালে মতো ভিন্নতার কারণে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে হায়দার আকবর খান সিপিবিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে তাকে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। এরপর তিনি সিপিবির উপদেষ্টা হন। রাজনৈতিক কারণে চারবার কারাবরণ করেছেন তিনি, সাতবার হুলিয়ার কারণে তাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছে। আইয়ুব আমল ও এরশাদ আমলে বারবার তার বাসায় সেনাবাহিনী ও পুলিশ হানা দিয়েছে।
সাহিত্যকর্ম ॥ বাংলা সাহিত্য ও বিশ্ব সাহিত্যে এবং একই সঙ্গে পদার্থবিদ্যার সর্বাধুনিক তত্ত্বসমূহ সম্পর্কেও তার একাধিক বই রয়েছে। এ ছাড়া ক্লাসিক্যাল মার্কসবাদী সাহিত্য পাঠ করেছেন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাত্ত্বিক অবদান রেখেছেন। মাঠের রাজনীতি ছাড়াও তিনি মার্কসবাদ, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, সাহিত্য ও বিজ্ঞান (পদার্থবিদ্যা) সংক্রান্ত বিষয়ে বই ও অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেছেন।
২০২২ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। মাত্র ২৪ বছর বয়সে ‘সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা’ নামে প্রথম বই লেখেন তিনি। এটি ছিল পাকিস্তান আমলে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদ সংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক প্রথম তাত্ত্বিক গ্রন্থ। বামপন্থি এই নেতার এই পর্যন্ত ২৫টি বই প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ (২০০৫ সালে বর্ষসেরা বই হিসেবে প্রথম আলোর পুরস্কার লাভ করে), ‘ফরাসি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, ‘পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা’, ‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর’, ‘মার্কসবাদের প্রথম পাঠ’, ‘মার্কসীয় অর্থনীতি’, ‘গ্রাম শহরের গরিব মানুষ জোট বাঁধো’, ‘মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম’, ‘কোয়ান্টাম জগৎ- কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন’ (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত), ‘রবীন্দ্রনাথ শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে’, ‘মানুষের কবি রবীন্দ্রনাথ’ (বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত), ‘বাংলা সাহিত্যে প্রগতির ধারা’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খ-), ‘পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খ-), ‘স্তালিন প্রসঙ্গে’ (পুস্তিকা), ‘অক্টোবর বিপ্লবের তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট’ (পুস্তিকা)। একইসঙ্গে ‘মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিরা’ এবং ‘নারী ও নারীমুক্তি’ নামে দুটি বই সম্পাদনা করেছেন তিনি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর