বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৮ পূর্বাহ্ন

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে বাংলাদেশের অর্জন কতটুকু: বিবিসি

রিপোর্টার / ২ বার
আপডেট : রবিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৫

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীনে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফরে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, এবং সম্পর্ক ‌‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে।

প্রধান উপদেষ্টার এই সফরে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার বৈঠকে হয়। সেখানেই সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে বিবৃতিতে জানানো হয়। একই সাথে শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কর্মসূচিরও প্রশংসা করেছেন বলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে গত বছরের জুলাই মাসে চীন সফর করেছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের প্রথম চীন সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বা অর্জন কী সেটি নিয়ে চলছে নানা হিসাবনিকাশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অধ্যাপক ইউনূস যখন চীন সফর করছেন তখন বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যেকার কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পালিত হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার এ সফরের মধ্য দিয়ে আগামী দিনগুলোতে চীনের সাথে বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং বোঝাপড়া কেমন হবে সেটির একটি ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অন্তর্বর্তী সরকারকে চীনের সমর্থন, আরও গভীর হবে ২ দেশের সম্পর্ক

বিশ্লেষকেরা এ সফরকে একটি সফল সফর বলে মনে করছেন। তারা বলছেন, দ্বিপাক্ষিক সফরে দুই দেশ যৌথ বিবৃতি দিয়েছে, চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে – এটি সফরের প্রত্যাসিত দিক।

এছাড়া, অন্য সময় স্থায়ী সরকারের সাথে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়, সে ভাষাই ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিকেও গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। অধ্যাপক ইউনূসের এ সফরে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ, নদী ব্যবস্থাপনা এবং রোহিঙ্গা সংকটের মতো বিষয়গুলো আলোচনায় এসেছে।

তবে, বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনায় চীনের পরামর্শ চাওয়া কিংবা অতীতের মতো এক চীন নীতিতে বাংলাদেশের সমর্থনের বিষয়গুলো নিয়ে নানা বিশ্লেষণও চলছে।

বাণিজ্য-অর্থনীতি ও বিনিয়োগ

গণঅভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এমন এক সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন যখন দেশের অর্থনীতি নানামুখী চাপে রয়েছে। ফলে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়া অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য। সে জায়গা থেকে এই সফর নিয়ে শুরুতেই আলোচনা ছিল।

এই সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়েছে। এছাড়া সাহিত্য ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে আটটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ।

অর্থনৈতিক বিবেচনায় সফরের সময় হওয়া চুক্তিসমূহকে বাংলাদেশের অর্জন হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ চীন অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিকাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সাহাবুল হক।

অধ্যাপক হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এ সফরে চীনের কাছ থেকে ২১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও ঋণের যে প্রস্তাব পাওয়া গেছে, যেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিকে আরো তরান্বিত করবে।’

চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক

আলোচনায় মোংলা বন্দরের উন্নয়নে কাজ করার কথা বলেছে চীন। যদিও আগে থেকেই চীন ও ভারত আলাদাভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ছিল। নতুন করে পুরো কাজ এখন চীন করতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘ছাড়াও দুইটা স্পেশাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে কিছু বিনিয়োগ আসবে হয়তো। এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা ভালো ও ইতিবাচক দিক যদি তা বাস্তবায়ন করা যায়।’

স্বাস্থ্য সেবায় নতুন গন্তব্য

গত অগাস্টে পট পরিবর্তনের আগে অনেক বাংলাদেশি স্বাস্থ্য সেবার জন্য ভারতে যাতায়াত করতেন। কিন্তু তার পর থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতের চিকিৎসাসহ সব ধরনের ভিসা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চীন এই সুযোগে এগিয়ে এসেছে।

শনিবার চীনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে জানায়, চীন এরই মধ্যে কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ করেছে।

চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। এর ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষ সহজে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কুনমিংয়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে পারবেন, বলে বিবৃতিতে বলা হয়।

এর বাইরে, বিশ্লেষকরা বলছেন, অধ্যাপক ইউনূসের এ সফরে নতুন যা হয়েছে তার মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা খাতে বেশ কিছু বিষয় এসেছে, যা আগে কখনো এত বিস্তারিতভাবে আলোচনায় আসেনি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বলেন, ‘ঢাকায় কিছু হাসপাতাল গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। চীন রোবটিক ফিজিও থেরাপির কথা বলেছে। কার্ডিও ভাস্কুলার সার্জারি এবং ভেহিকেল সাপ্লাই দেয়ার কথা বলেছে। যেটা হয়তো বিশাল কিছু না, তবে স্বাস্থ্য খাতে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক সাহায্য করবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন থেকে চীনের কুনমিংকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এটা নতুন মাত্রা তৈরি হচ্ছে। তার মানে এই না যে মানুষ ভারত যাবে না।’

তিস্তা ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়েছে, শত শত বিস্তৃত নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টার সফরের পর বাংলাদেশ ও চীনের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনঃসংস্কার প্রকল্পে চীনা কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণকে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়েছে।

সফরে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নদী শাসন ড্রেজিংসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ২০২১ সালে চীন তিস্তা নদীর ওপর এক সমীক্ষা চালিয়েছিল।

অধ্যাপক সাহাবুল হক জানিয়েছেন, ‘তখন ভারতের আপত্তিতে সেটা থেমে গিয়েছিল। পরে এখন অধ্যাপক ইউনূস তাদেরকে (চীনকে) অনুরোধ করেছেন আবার কাজ শুরুর জন্য।’ এদিকে, সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বলেন, তিস্তা ইস্যুতে চীনের সাথে একটা এমওইউ আগে থেকেই ছিল।

‘সেটা নবায়নের বিষয়ও ছিল। এবারে সফরে খুব সুনির্দিষ্টভাবে চীনকে তেমন কোনো সুযোগ করে দেয়া হয়নি। দিলে হয়তো চীন খুশি হতো, তবে সেটি কৌশলগত কারণেই সম্ভবত দেয়া হয়নি। যেটি আমার দৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হয়েছে।’

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আশা

এ বছরই বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হতে যাচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে একটি মাইলফলক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এই সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চীনকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রায় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পরে বিভিন্ন সময় আরও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে এর আগে শেখ হাসিনার সরকার উদ্যোগ নিলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি।

মুন্সি ফয়েজ বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুও গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়েছে এই সফরে। কিন্তু নতুন উদ্যোগের লক্ষণ আমরা আপাতত দেখতে পারছি না। তবে এর মধ্যে দিয়ে নিশ্চয়ই আরও আলাপ আলোচনা হবে। এর ফলে যদি নতুন কিছু হয় সেটা দেখার জন্য আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের সাথে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক চীনের। মিয়ানমারে চীনের বহু প্রকল্প রয়েছে। সেক্ষেত্রে চীনকে রাজি করানো গেলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটের একটা সমাধান সম্ভব।

অধ্যাপক সাহাবুল হক মনে করেন, যেহেতু চীনের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো, ফলে চীন যদি চায় মিয়ানমার সরকারকে রাজি করিয়ে তারা একটা উদ্যোগ নিতে পারে। ‘চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছেন দুই পক্ষকে নিয়েই তারা এ উদ্যোগ নেবে। চীন উদ্যোগ নিলে সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব,’ যোগ করেন তিনি।

তাইওয়ান ইস্যু

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর মধ্যে বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দুই দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

যেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, ‘এক চীন’ নীতির প্রতি সমর্থনের কথা ব্যক্ত করে তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান মূলত দক্ষিণ চীন সমূদ্রের একটি দ্বীপ। কিন্তু, তাইওয়ান কি চীনের অংশ, না চীন থেকে আলাদা- এ নিয়ে পক্ষভেদে সংশয় দেখা যায়।

চীনের পক্ষ থেকে যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ব্যাপারে নিজেদের অঙ্গীকারের কথা। অন্তর্বর্তী সরকারের পথচলায় সমর্থনের কথাও ব্যক্ত করা হয় এতে।

বাংলাদেশ বরাবরই এক চীন নীতিতে অবস্থান করে আসছে। ফলে বিজ্ঞপ্তিতে এর প্রতিফলন অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ। ‘এই বাক্যটি হয়তো চীনের আগ্রহে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হোক বা না হোক, এটি কোনো পার্থক্য তৈরি করে না,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমদ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর