শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ০৭:৩৯ পূর্বাহ্ন

তেড়ে কামড়ায় না ‘রাসেলস ভাইপার’, আতঙ্ক না ছড়ানোর আহ্বান

ভয়েস বাংলা প্রতিবেদক / ৩ বার
আপডেট : শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪

রাজশাহীর গোদাগাড়ি এলাকায় এখন মাঠভর্তি পাকা ফসল। কিন্তু কৃষকের মনে আতঙ্ক। একদিকে বৃষ্টি, আরেক দিকে মুখে মুখে ‘রাসেলস ভাইপারের’ (চন্দ্রবোড়া সাপ) কথা শোনা যাচ্ছে। পাশের কয়েকটি গ্রামের বসতভিটাতেও নাকি গাদা গাদা দেখা যাচ্ছে। কাঁকন হাটের এক কৃষককে জিজ্ঞেস করা হয়—দেখেছেন নাকি রাসেলস ভাইপার সাপ? জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি দেখিনি, কিন্তু আমার ভায়রা ভাই দেখেছে। সেই ভায়রা ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সাপটা একটু অন্যরকম দেখতে। এই সাপকে আমরা ‘চন্দ্রবোড়া’ বলি। কিন্তু আমি শিওর না। এলাকার লোক মেরে ফেলার পরে আমি শুনেছি।
গণমাধ্যমের বরাতে রাসেলস ভাইপার এখন পরিচিত নাম। এটা একটা প্রায় বিলুপ্ত বিষধর সাপ, যা হঠাৎই বংশবিস্তার শুরু করেছে বলে নিত্যদিনের খবরে জানা যাচ্ছে। কিন্তু প্রাণিবিজ্ঞানীরা বলছেন, আগে নিশ্চিত করে জানুন আসলেই রাসেলস ভাইপার এভাবে ধেয়ে আসছে চারপাশে, নাকি কানে কানে শুনে শুনে ছড়িয়ে পড়ছে। এলাকাভিত্তিক খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একদিকে আতঙ্কে মাঠে যেতে ভয় পাচ্ছেন কৃষক, আরেকদিকে যেখানে সাপ দেখা যাচ্ছে, তার জাত না জেনেই মেরে ফেলা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে সতর্ক থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলছেন প্রাণিবিজ্ঞানীরা। তবে, ইতোমধ্যে কৃষকদের ভয় দূর করতে হাঁটু পর্যন্ত বুট পরার পরামর্শ দেওয়া থেকে শুরু করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
এদিকে পরিবেশবাদীরা বলছেন, সাপের অ্যান্টিভেনম যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মৃত্যু ঠেকানো যাবে। এই সাপ বিষধর কিন্তু তেড়ে এসে কাউকে কামড়ায় না। সতর্ক থাকলে সাপও বাঁচবে, মানুষও বাঁচবে। না বুঝে সব সাপ মেরে ফেললে বাস্তুসংস্থানের ওপর চাপ পড়বে। সেটা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বলছে, সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসার জন্য যে সাপে কামড়াবে—তার অ্যান্টিভেনম দরকার হবে। সেটাই সবচেয়ে কার্যকর হয়। ভারতে যেসব সাপ থেকে ভেনম সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোর মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে। সুতরাং, সেই সাপ থেকে প্রস্তুত অ্যান্টিভেনম (ভারতীয়) এই সাপের কামড়ের চিকিৎসায় শতভাগ কাজ করবে না।
এই সাপ নিয়ে আতঙ্ক না ছড়িয়ে করণীয় কী জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, এটা বিষধর সাপ হলেও এরা সাধারণত কৃষি জমিতে ইঁদুর, ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ অন্যান্য প্রাণী খেয়ে থাকে। না চিনে ভীতি থেকে যেনতেন সাপ মেরে ফেললে খাদ্য-শিকলে প্রভাব পড়বে। সাধারণত সব সাপ ইঁদুর খায় না, এরা খায়। ইঁদুর বেড়ে গেলে সেটা জীবনযাত্রাকে কী পরিমাণ ব্যাহত করবে, তার ধারণাও আমাদের নেই। ফলে গণমাধ্যমে আতঙ্ক না ছড়িয়ে, এই সময়ে সচেতনতামূলক কথাবার্তা যেন বলা হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমত, চেনানো দরকার সাপটা দেখতে কেমন। এটার সঙ্গে অজগর, স্যান্ডবোয়ারের মিল আছে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই গায়ের গোল গোল রিংয়ের ভিন্নতা চোখে পড়বে। রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার গায়ে চাকা গোল গোল চিহ্নগুলো আলাদা আলাদা। অজগরের চাকা গোল, গোলগুলো নেটের মতো, একটার সঙ্গে আরেকটা লাগানো। চিনে রাখুন, ভয়ের কিছু নেই্। এই সাপ দৌড়ে তাড়া করে না, বাসায় এসে কামড়াবে না। আর কর্তৃপক্ষের জায়গা থেকে বৈজ্ঞানিক সার্ভে করা যেতে পারে। আসলে কী পরিমাণ বেড়েছে। আমাদের এখানে সাপ ধরার ব্যবস্থা আছে। এই সাপের চাহিদা পৃথিবীর অন্য অনেক দেশে আছে। সেগুলোতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এদের ‘ভেনম’ খুব দামি। সেটাও আমরা বিবেচনায় নিয়ে ভেনম রিসার্চ সেন্টারকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা নিতে পারি।
এই সাপ কি হঠাৎই বেড়ে গেলো প্রশ্নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নঈম গওহার ওয়ারা বলেন, ২০০০ সালের আগে তেমন একটা দেখা যেতো না। এটা বন্যার মাধ্যমে ভারত থেকে এসে থাকতে পারে। এই মুহূর্তে সাপের পরিমাণ নির্ধারণ ও অ্যান্টিভেনম নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এমনিতে সাপ দেখলেই আমাদের এখানে পিটিয়ে মেরে ফেলার চল আছে। সেটাতো বাস্তুসংস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বেজি, গুইসাপ দেখলেই উল্লাসে মেরে ফেলেছি, সেই বেজি সাপ খেয়ে সহায়তা করতো। এসব আমাদের পাঠ্যসূচিতে আছে, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে এটাকে আমরা কেউ মনে রাখি না।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বল্প সংখ্যক রাসেলস ভাইপার সবসময়ই ছিল। কিন্তু বংশবিস্তারের মতো পরিবেশ ও পর্যাপ্ত খাদ্য বেড়ে যাওয়ায়, পদ্মা অববাহিকার মাধ্যমে সেই বেল্ট ধরে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর জন্য একই জমিতে বছরে তিন ফসল উৎপাদনও অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
‘অ্যান্টিভেনম আছে কিন্তু পুরোপুরি কাজ করছে না কেন’, প্রশ্নে ভেনম রিসার্চ সেন্টার প্রকল্পের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, এটা পলিভ্যালেন্ট। রাসেলস ভাইপারসহ চার ধরনের সাপ থেকে বিষ নিয়ে অ্যান্টিভেনম বানানো হয়। রাসেলস ভাইপারের যে ভেনম নেওয়া হয় তা ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের। ভারতের পশ্চিম, দক্ষিণ, পূর্ব অঞ্চলের ভেনম কম্পিজিশন আলাদা আলাদা। রাসেলস ভাইপার যে টক্সিন তৈরি করে, সেই জিনগুলোতে মিল থাকলে একটার সঙ্গে আরেকটা কাজ করে, কিন্তু পুরোপুরি নাও করতে পারে। এই সাপে কামড়ালে শরীরের সিস্টেমে প্রভাব পড়ে। শরীরের রক্ত জমাট বাঁধা বা রক্ত তরল করার যে প্রক্রিয়া, সেটা নষ্ট হয়ে যায়। এটা কিডনি আক্রমণ ও লোকাল টিস্যু নষ্ট করে এবং হার্টের কার্যকারিতা কমায় বলে পরিস্থিতি সামলানো কষ্ট হয়ে যায়। এরপরেও এই সাপ মেরে ফেলা সমাধান না। তাহলে মানুষ না খেয়ে মরবে। কারণ, এই সাপ মারলে ইঁদুরের উপদ্রব বাড়বে এবং কৃষক ধান ঘরে তুলতে পারবেন না। সবদিকে ব্যালেন্স রাখতে হবে। এজন্য গণমাধ্যমের উচিত আতঙ্ক না ছড়িয়ে বরং সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার দিকে মনোযোগী হওয়া।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর