জাতিসংঘ মহাসচিবের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠক

জাতিসংঘ মহাচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বৈঠক করেছেন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। বৈঠকে সরকারের একাধিক উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। উপদেষ্টারা জাতিসংঘ মহাসচিবকে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে ব্রিফ করেন। পরে রাজনৈতিক দলের নেতারা কথা বলেন। এ বৈঠকেও দ্রুত জাতীয় নির্বাচনে পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা।
শনিবার (১৫ সার্চ) দুপুরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএনপিসহ সাতটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরাও।
বিএনপি ছাড়া অন্য যে দলগুলো বৈঠকে অংশ নেয় সেগুলো হলো— জামায়াতে ইসলামী, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
বৈঠকে ছিলেন অন্তবর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মুনির হায়দার। এ ছাড়া জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আলী রীয়াজ, ড. ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাতিসংঘের উদ্যোগে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করা হয়েছিল। এখানে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা ছিলেন। সংস্কার কমিশনের প্রধানরা ছিলেন। মূলত এখানে যে সংস্কারের ব্যাপারগুলো, যেগুলো নিয়ে কমিশনগুলো করা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবকে অবহিত করা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমরাও আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। সংস্কার তো অবশ্যই করতে হবে। আমরা সংস্কারের কথা আগেই বলেছি, সেই সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু সংস্কারটা যত দ্রুত করা যায়।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের প্রথম দাবি ছিল নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার। আমরা বলেছি, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনি সংস্কারগুলো শেষ করতে হবে। এরপর সংসদ গঠনের মাধ্যমে বাকি সংস্কারগুলো করা যাবে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া— এটাই আমরা বলে এসেছি।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপিসহ সাতটি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ছবি: পিআইডি
সংস্কারের বিষয়ে কোনো সময়ের কথা বলেছেন কি না— এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, টাইম ফ্রেম নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটা তো আমাদের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘ মহাসচিব কী বলেছেন— জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, উনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আপনারা বসে সংস্কার কী করবেন, ঠিক করেন। নির্বাচন যা হবে, বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী হবে। বাংলাদেশে যেন একটা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে এটা তিনি আশা করেছেন।
বৈঠকের পর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা সংস্কারের ব্যাপারে কথা বলেছি। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বলেছি। টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে কথা বলেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের অধিকাংশ বক্তব্য সমর্থন করে বলেছেন, বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের কাজে আমাদের সহযোগিতা করবেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে তিনি আশাবাদী।
নবগঠিত এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, মৌলিক সংস্কারের ভিত্তি এই সরকারের সময়েই তৈরি করতে হবে এবং সব রাজনৈতিক দল মিলে ঐকমত্য পোষণ করতে হবে জুলাই সনদে সইয়ের মাধ্যমে। জনগণের কাছে আমাদের সংস্কারের যে কমিটমেন্ট, সংস্কারের যে ধারাবাহিকতা, সেটা বাস্তবায়নের জন্য জুলাই সনদের দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলেছি।
নাহিদ হোসেন আরও বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে একটি সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সেখানেই আলোকপাত করা হয়েছে। সংস্কার কমিশনের প্রধানরা তাদের নিজ নিজ প্রতিবেদনে সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছিলেন। রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা তাদের দলীয় অবস্থান সংস্কার বিষয়ে তুলে ধরেছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষে আমাদের সংস্কার বিষয়ে যে অবস্থান, আমরা মনে করি, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে, বিচার ও সংস্কার জনগণের কাছে তাদের অন্যতম কমিটমেন্ট।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ছবি: পিআইডি
সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে কোনো আলোচনা করেছেন কি না— জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম বলেন, এখানে বিস্তারিত আলাপের সুযোগ ছিল না। আমরা সংস্কার বিষয়ে ওভারঅল আলোচনা করেছি। গণপরিষদের মাধ্যমেই সংস্কার করতে হবে, অন্যথায় সংসদের সংবিধান সংস্কার টেকসই হবে না, বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেও এটাই দেখতে পাই। সেই জায়গা থেকে আমরা গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলেছি। সামনের যে জাতীয় নির্বাচন সেটা একই সঙ্গে আইনপরিষদ ও গণপরিষদ নির্বাচন হোক। পাশাপাশি আমরা বিচারের বিষয়টা বলেছি।
নাহিদ জানান, বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও সরকার, তারা যেন নিজেরাই সমঝোতায় আসে, ঐকমত্যে আসে। গণতন্ত্রের মূল চেতনা মাথায় রেখেই যেন আমরা একসঙ্গে কাজ করি, সেটাই তিনি তার জায়গা থেকে বলেছেন।
এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, এবি পার্টির পক্ষ থেকে আমরা কয়েকটি জিনিস বলেছি। আমরা বলেছি, জাতিসংঘের তিনটি প্রতিষ্ঠানে শেখ হাসিনার তিনজন আত্মীয় কাজ করছেন। আমি জাতিসংঘের মহাসচিবকে বলেছি, জাতিসংঘ যেহেতু ইনসাফ চায়, ইনসাফটা যেন শুরু হয় জাতিসংঘের নিজের অফিস থেকে।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় শেখ হাসিনার মেয়ে কাজ করছেন। ইউএনডিপিতে শেখ রেহানার ছেলে ববি কাজ করছেন। ববির স্ত্রী কাজ করছে মাইগ্রেশন অরগানাইজেশনে। আমরা বলেছি এই নিয়োগগুলোকে পুনর্বিবেচনা করার জন্য।
বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশনের অস্থায়ী কার্যালয় খোলা যায় কি না, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য জাতিসংঘ যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেটা যেন আরও বেগবান করা হয়— এসব বিষয়েও জাতিসংঘ মহাসচিবকে বলেছেন এবি পার্টির নেতারা।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস, ইউএনএইচসিআরের আবাসিক প্রতিনিধি সুম্বুল রিজভী, আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টার টুমো পুটিআইনেন, ডব্লিউএফপির আবাসিক প্রতিনিধি ডমিনিকো স্কেলপেনি, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার, ডব্লিউএইচওরর আবাসিক প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা, ইউএনওপিএসের আবাসিক প্রতিনিধি সুধীর মুরলীধরন, আইওএমের মিশন প্রধান ল্যানস বনেউ, ইউনেস্কোর প্রধান নির্বাহী পরিচালক ও ইউনিসেফের আবাসিক প্রতিনিধি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।