মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন বদলে দিচ্ছে বিশ্বের জলধারা: ঝুকিতে নদী তীরের মানুষের জীবন

মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে বিশ্বের জলধারাগুলোকে বদলে দিচ্ছে। এ সংকটের প্রভাব কেবল নদীর ওপর পড়ছে না; নদী তীরের মানুষের জীবনে ডেকে আনছে দুর্দশা। যারা এসব নদীর পানি পান করেন, জমিতে সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন বা পণ্য পরিবহনে নদীই যাদের ভরসা, তাদের জীবনকেও পাল্টে দিচ্ছে চরম আবহাওয়া। মানবসৃষ্ট জলবায়ুর এই বিরুপ প্রভাবের চিত্র সিএনএন তাদের এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে।
টানা বৃষ্টিহীন দিন আর অবিরাম তীব্র তাপদাহে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক নদীর প্রাণ যায় যায় অবস্থা। বিরূপ আবহাওয়ায় নদীগুলোর প্রস্থ এবং গভীরতা কমে গেছে। পানি কমে নদীর তলদেশ জেগে ওঠার ঘটনা এখন খুব সাধারণ দৃশ্য। কিছু নদী আবার এতটাই শুকিয়েছে যে, নৌযান চলাচলেরও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যা মানব জীবনে ভবিষ্যত বিপদের শংকার পূর্াভাস হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
নদীর মাঝখানে বৈঠা ছাড়া নৌকায় আটকা পড়ার মানে হল, আপনি কঠিন বিপদে পড়েছেন। তবে এই গ্রীষ্মে উত্তর গোলার্ধের কোনো কোনো নদীতে তেমনটা হলে বৈঠা কাজে নাও লাগতে পারে।
স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছয়টি বড় নদীর এখনকার এবং আগের ছবি বিশ্লেষণ করে সিএনএন দেখিয়েছে, মানুষের কর্মফলে কীভাবে মারা যাচ্ছে বহু সভ্যতার জন্ম দেওয়া এসব জলধারা।
কলোরাডো
যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলে ইতিহাসের রেকর্ড খরার কারণে কলোরাডো নদীর তীর শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে। খরা কমার লক্ষণও খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। মূলত বড় দুটি জলাধারের মাধ্যমে এ নদীর অববাহিকা রক্ষার পাশাপাশি নদীর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে লেইক মিড জলাধারে পানির স্তর কমে ডোবার মত দশা হয়েছে।

২০০০ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদী। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি/সিএনএন

২০২২ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর অবস্থা। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি/সিএনএন
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, বাঁধ দিয়ে পানি সরবরাহের জন্য পানির স্তর যতটুকু উপরে দরকার ততটুকুও নেই। লেইক মিডের পানি ২০০০ সালে পর থেকেই কমছিল। কিন্তু ২০২০ সালে পর থেকে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে অত্যন্ত দ্রুত।

২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লেইক মিড জলাধার। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি/সিএনএন

২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লেইক মিড জলাধার। ছবি: নাসা আর্থ অবজারভেটরি/সিএনএন
গত বছর এ লেইক এতটাই শুকিয়েছে যে, এর তলদেশে একটি ব্যারেলে একজনের লাশও পাওয়া গেছে, যাকে কয়েক দশক আগে হত্যা করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাতটি রাজ্যের চার কোটি মানুষ এবং মেক্সিকো সুপেয় পানি, কৃষি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে এই নদীর ওপর নির্ভরশীল।
ইয়াংজি
এশিয়ার দীর্ঘতম ইয়াংজি নদী শুকিয়ে যাচ্ছে এবং কিছু এলাকায় এর তলদেশ জেগে উঠছে। চীন নয় বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী খরার সতর্কতা ঘোষণা করেছে। দেশটিতে যে তাপপ্রবাহ চলছে তা ছয় দশকের ইতিহাসে দীর্ঘতম।

২০২১ সালে অগাস্টে ইয়াংজি নদী। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন

২০২২ সালে অগাস্টে ইয়াংজি নদী। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন
ইয়াংজি নদী শুকিয়ে যাওয়ার প্রভাব হয়েছে ব্যাপক। ৮ কোটি ৪০ লাখ মানুষের প্রদেশ চীনের সিচুয়ানে বিদ্যুতের ৮০ শতাংশই এই নদীভিত্তিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও কমে গেছে। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ সব কারখানা কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখতে বলেছে। রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া বলছে, সাধারণত যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হত ওই এলাকায়, তার অর্ধেক বৃষ্টি হয়েছে সিচুয়ানে। কিছু জলাধার সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে।
রাইন
সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা থেকে শুরু হয়েছে রাইন নদী। জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়ে তা পড়েছে উত্তর সাগরে। এই নদী ইউরোপের পণ্য পরিবহনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ, কিন্তু এই মুহূর্তে তা চিন্তা করাও যেন একটি দুঃস্বপ্ন।

২০২১ সালে রাইন নদী। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন

২০২২ সালে রাইন নদী। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন
নদীর তলদেশ অনেক জায়গায় পানির স্তরের উপড়ে উঠে গেছে। এ অবস্থায় জাহাজ চলাচল করলে একাধিকবার আটকে যেতে হবে। নদীর পুরো পথ জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের গভীরতা। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুটের পশ্চিমে কাউবে পানির স্তর ৩২ সেন্টিমিটার (১২ দশমিক ৬ ইঞ্চি) পর্যন্ত নেমে গেছে।
পো
ইতালির ওপর দিয়ে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে পড়েছে পো নদী। আল্পসের শীতকালীন তুষারপাত এবং বসন্তে ভারি বৃষ্টিপাত খাড়া ঢাল বেয়ে এ নদীতে পড়ে ব্যাপক স্রোত তৈরি হয়। ফলে নদীর চারপাশে বিধ্বংসী বন্যা দেখা যায়।

২০২১ সালে ইতালির পো নদীর চিত্র। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন

২০২২ সালে আরও শুকিয়ে গেছে পো নদী। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন
কিন্তু পো নদীর চেহারা এখন অন্যরকম। উত্তর ইতালিতে শীত কমে যাওয়ায় তুষার থেকে সামান্য পানি আসছে এবং গ্রীষ্ম ও বসন্তে আরও শুষ্ক আবহাওয়া সাত দশকের মধ্যে রেকর্ড খরা নিয়ে এসেছে। ফলে নদীর পানি এতটাই কমে গেছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি বোমা জেগে উঠেছে নদীর মধ্যে। একটি বড় সমস্যা হল, লাখ লাখ মানুষ কৃষিকাজের জন্য পো নদীর ওপর নির্ভরশীল। ইতালির প্রায় ৩০ শতাংশ খাদ্য পো নদীর অববাহিকায় উৎদিত হয়। এ দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত রপ্তানি পণ্যের একটি পারমেসান পনির ওই এলাকাতেই তৈরি হয়।
লোয়া
লোয়া নদী ফ্রান্সে আঙুর চাষের একটি উপত্যকাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যেখান থেকে বিশ্বের সবচে বিখ্যাত মদ তৈরি হয়। নদীটি প্রায় ৬০০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত এবং ফ্রান্সের শেষ প্রমত্তা নদী হিসাবে মনে করা হয়। উপত্যকা জুড়ে জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করে চলেছে এটি। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা একে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছে।

২০২১ সালে ফ্রান্সের লোয়া নদী। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন

২০২২ সালে আরও সংকুচিত হয়েছে লোয়া নদী। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন
এই নদীর কিছু অংশ ইতোমধ্যে গভীরতা হারিয়েছে। তবে আবহাওয়া ও নদীর উৎসে তুষার গলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর স্তর ও প্রবাহ দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে। কিছু অংশ বৃষ্টির অভাবে এবং প্রচণ্ড গরমে এতটাই শুকিয়ে গেছে যে, মানুষ পায়ে হেঁটে পার হতে পারে।
ফরাসি শহর সাউমুর থেকে স্যাটেলাইট চিত্রে লোয়া নদীতে পানির চেয়ে বেশি নদীর তলদেশ দেখা গেছে। নদীর পাশে উপত্যকাগুলো বেশিরভাগই শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেছে; এক বছর আগেও সেগুলো প্রাণবন্ত ও সবুজ দেখাত আকাশ থেকে।
কর্তৃপক্ষ বাঁধ থেকে পানি ছেড়ে লোয়াকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, এর একটি বড় উদ্দেশ্য হল এ নদীর তীরে থাকা চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যথেষ্ট পানির ব্যবস্থা করা।
দানিউব
দানিউব পশ্চিম ইউরোপের দীর্ঘতম নদী এবং ১০টি দেশের ভেতর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের একটি জলপথ। রোমানিয়া, সার্বিয়া ও বুলগেরিয়াতে শ্রমিকরা নদীটি ড্রেজিং করছে, যাতে জাহাজগুলো এখনও চলাচল করতে পারে।

২০২১ সালে পশ্চিম ইউরোপের দীর্ঘতম দানিয়ুব নদী। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন

২০২২ সালে দানিয়ুব নদীর চিত্র। ছবি: ইউ, কোপারনিকাস সেন্টিনেল-২ ইমাজেরি/সিএনএন
ইউরোপের অন্যান্য নদীর মত ভয়ানক অবস্থার মধ্যে নেই এ নদী। তবে হাঙ্গেরির মত দেশগুলো পর্যটনের জন্য দানিয়ুবের উপর এতটাই নির্ভরশীল, যে তার প্রভাবও ইতোমধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে।
হাঙ্গেরিগামী অনেক জাহাজ নদীর কিছু অংশে আটকে যাচ্ছে। যে জাহাজগুলো চলাচল করছে, তারাও স্বাভাবিক রুটে থামতে পারছে না, কারণ নদীর পানির স্তুর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক বন্দর বন্ধ হয়ে গেছে। দেশটির পর্যটন বোর্ড বলছে, এখন কোনো কার্গো ছাড়া গড়ে ১ হাজার ৬০০ টনের জাহাজই কেবল হাঙ্গেরিয়ার উপকূলে চলাচল করতে পারে।