সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:৪৬ পূর্বাহ্ন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: খুলনায় আমন চাষ ব্যাহত

ভয়েসবাংলা প্রতিবেদক / ২৩৯ বার
আপডেট : শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আষাঢ়-শ্রাবণ চলে গেছে। ভাদ্রও শেষের পথে। এই সময়েও পর্যাপ্ত বৃষ্টির দেখা নেই। এতে খুলনায় রোপা আমন চাষাবাদে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আমন চাষাবাদের ভরা মৌসুমে কৃষকরা ধানের চারা রোপণ করতে পারছেন না। ফলে আমন চাষ দেড় মাস পিছিয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টির কারণে আমনের পাশাপাশি শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদনেও ভাটা পড়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট আম্পান ও ইয়াসসহ বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি খুলনার কৃষকরা। চলতি বছরের মে মাসে বোরোর ন্যায্যমূল্য পাননি। অমাবস্যার জোয়ারের ধাক্কায় কয়রা উপজেলার বেদকাশীতে কৃষি অর্থনীতিতে বড় ক্ষতি হয়েছে। জুন মাস থেকে অনাবৃষ্টির কারণে আমন, পাট ও শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বর্ষা মৌসূমে ৯৩ হাজার ১৭০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু ১৫ ভাদ্র পর্যন্ত মাত্র ১৬ হাজার ৪৫৫ হেক্টর জমিতে আবাদ করা সম্ভব হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ১৭ শতাংশ। কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি না হওয়ায় আবাদ দেড়মাস পিছিয়েছে। খুলনা জেলায় তিন হাজার ৬৩০ হেক্টর জমিতে আউশ, এক হাজার ৩১৬ হেক্টর জমিতে পাট, ৩৫ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো, ২৭৩ হেক্টর জমিতে তরমুজ, ২৯৫ হেক্টর জমিতে শিম, আট হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে শীতকালীন শাক-সবজির আবাদ হয়েছে। অধিকাংশ ফসলে সেচ দিতে হচ্ছে।

Khulna-2

সেচ দিয়ে চাষাবাদে হিমশিম খাচ্ছে কৃষক

জানা গেছে, ২০২১ সালের জুনের ৩৮৮ দশমিক ৮৯ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৫০৬ মিলিমিটার ও আগস্টে ২১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এ বছরের জুনে ৯৪ দশমিক ৩৬ মিলিমিটার, জুলাইয়ে ৯১ দশমিক ২৭ মিলিমিটার এবং ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ১৬১ দশমিক ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া গ্রামের চাষি আবু হানিফ মোড়ল বলেন, ঘেরের আইলের পাশে দশ বিঘা জমিতে শিম আবাদ করেছি। কলসে করে বয়ে এনে পানি দিয়ে আবাদ বাঁচাতে হচ্ছে। পানির অভাবে খর্ণিয়া ইউনিয়নের অর্ধেকের বেশি জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। ভদ্রা নদীর পানি দিয়ে টিপনা, বামনদিয়া, পাঁচপোতা পাথুরিয়া, গোনালী, খর্ণিয়া ও ভদ্রদিয়া গ্রামের চাষিরা আমনের আবাদ করছে। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। ডুমুরিয়া সদরের কৃষক আবদুল মোবিন বলেন, ‘সেই যুবক বয়স থেকে চাষ করে আসছি। কৃষক হিসেবেই ৫০ বছর বছর পার করলাম। কিন্তু এবারের মতো কম বৃষ্টি আগে দেখিনি।

পাইকগাছার কৃষক আলম সরদার বলেন, গত বর্ষায় কম বৃষ্টি হলেও শরতে বৃষ্টি ছিল প্রচুর। খুলনায় আগে বৃষ্টির কারণে বিল-মাঠ ডুবে থাকতো। জলাবদ্ধতা দূর করতে বিভিন্ন স্থানের বাঁধ কাটতে হয়েছে। এখন বর্ষাকালেও খাল-বিল শুকিয়ে থাকছে। সেচ দেওয়ার মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না।পাইকগাছা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি না হওয়ায় আমন রোপণের অগ্রগতি কম। রোপণের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। এ পর্যন্ত ৪০ শতাংশ জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। সাড়ে চারশ’ একর জমির উৎপাদিত পাট নদীর জোয়ারের পানিতে, আবার অন্য কোথাও গর্ত করে পলিথিন বিছিয়ে মাটি চাপা দিয়ে পচানো হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহায়তায় সেচ দিতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

দাকোপ উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, অনাবৃষ্টির কারণে আমনের বীজতলা এবার তৈরিতে দেরি হয়েছে। আমন আবাদ দেড় মাস পিছিয়ে গেছে। তার কর্মস্থল পানখালী ইউনিয়নে তরমুজ ও সবজির উৎপাদন কমে গেছে।

khulna-4

অনাবৃষ্টির কারণে আমন, পাট ও শীতকালীন শাক-সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে

খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেরেদ আজাদ বলেন, শুধু আষাঢ়-শ্রাবণই নয়, ভাদ্র মাসেরও ১৩ দিন পার হতে যাচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় বৃষ্টির দেখা নেই। প্রতি ৩-৪ বছর পর এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়। এর আগে ২০১৯ সালে এমন পরিস্থিতি হয়েছিল। আর এবারও সেই একই পরিস্থিতি হলো। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে হালকা বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই মাসেই একটি মৌসুমি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। সেটা হলে খুলনা অঞ্চলে বৃষ্টি হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, ফুলতলা, তেরখাদা, রূপসা, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, দিঘলিয়া ও দাকোপ উপজেলায় নদী থেকে পানি উত্তোলন করে আমন আবাদ করা হচ্ছে। পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার নদীর পানি এখনও নোনা। এ কারণে এই দুই উপজেলায় নদীর পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে বীজতলা একশ’ শতাংশ সম্পন্ন হলেও আমন উৎপাদন কম হবে।

পানি নেই মাঠে, নষ্ট হচ্ছে বীজতলা

ভাদ্র ও আশ্বিন মিলে শরৎকাল। শরতের শেষে রোদের তেজে কৃষকের মাঠে চাষের ব্যস্ততা। কিন্তু কৃষকের মুখে হাসি নেই। আছে শুধু হতাশা। যেখানে প্রতিদিন বৃষ্টি পড়ার কথা, মাঠ সেখানে পানি শূন্য। বৃষ্টি না থাকা এবং মাঠে পানি শূন্যতায় কৃষকের মুখে এখন হতাশার ছাপ। অনেক কৃষকের মতে ‘এ যেন মরুভূমি’।

বাংলা দিনপঞ্জির হিসাবে শ্রাবণ বিদায় নিয়ে ভাদ্রের মাঝামাঝি। কিন্তু এই ভরা বর্ষাতেও স্বাভাবিক বৃষ্টির দেখা নেই দক্ষিণাঞ্চলের  কৃষি ও মৎস্যের ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত বরগুনা  জেলায়। এতে কৃষকেরা আমন ধান চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। পানির অভাবে অনেক কৃষকের বীজতলা নষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের পানি আর বৃষ্টির পানি পাওয়ার কারণে বিকল্প সেচ ব্যবস্থা না থাকায় এখন বিপাকে তারা।

উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার কাকচিড়া, কালমেঘা, নাচনাপাড়া, সদর পাথরঘাটাসহ বেশকটি ইউনিয়নের মাঠজুড়ে পানি শূন্য রয়েছে। প্রান্তিক চাষিরা এখন দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কৃষকদের মতে জোয়ার-ভাটার দক্ষিণাঞ্চল এখন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।

পানি নেই মাঠে, নষ্ট হচ্ছে বীজতলা 

কথা হয় নাচনাপাড়া ইউনিয়নের সিংড়াবুনিয়া গ্রামের ৭০ বছরের আ. মালেকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এখন কোলায় (মাঠ) কোনো পানি নাই, বৃষ্টিও নাই। কেমনে যে বীজ রুমু…আল্লায় জানে। এহন মনে হয় যেন মরুভূমি’। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ধান আর অইবে না। গত বছর ২ একর জমিতে যে ধান পাইছি এবার মনে হয় অর্ধেকও ওটবেনা’। বাদুরতলা গ্রামের হাফিজুর রহমান বলেন, পানি না থাকায় ৬৬ শতক জমি চাষযোগ্য করে তুলতে এখনো পারিনি। ধানের চারায় এখন পচন ধরেছে।  রুহিতা গ্রামের সৌরভ মিয়া বলেন, ধানের বীজ এখন পুড়ে যাচ্ছে।  ক্ষেতে বৃষ্টি বা পানি না থাকায় এখন রোপণ করতে পারছি না।

পাথরঘাটা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শিশির কুমার বড়াল বলেন, অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বৃষ্টির মৌসুমে না থাকা আর শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি হওয়া এটা তো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। আমি মনে করি ভাদ্র মাসে এসেও যেখানে বৃষ্টি থাকার কথা সেখানে খড়া এটাও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। তিনি বলেন, গত বছর অতি বৃষ্টির কারণে কিন্তু পাথরঘাটার অনেক বীজতলা নষ্ট হয়েছে যার ফলে ফলনও অনেক কম হয়েছে।  এ বছর আমন চাষে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৯শ হেক্টর।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর