কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার উপায়

কোষ্ঠকাঠিন্য বা মলত্যাগে অসুবিধা—এই সমস্যাটি যেন আজকাল প্রায় ঘরে ঘরে দেখা যায়। আধুনিক জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক চাপ এর পেছনে বড় কারণ। অনেকেই দিনের পর দিন এই সমস্যা নিয়ে লজ্জা বা অনীহার কারণে ডাক্তার দেখান না, অথচ সহজ কিছু নিয়ম মানলেই এই সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
আমরা যদি আমাদের শরীরের ভাষা বুঝতে পারি এবং কিছু দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিবর্তন আনি, তাহলে কোষ্ঠকাঠিন্য আর কোনো অমোচনীয় সমস্যা থাকবে না। আজ আমরা জেনে নেব, কোন কোন উপায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা যায়, এবং কী বলছেন বিদেশি বিশেষজ্ঞরা।
কোষ্ঠকাঠিন্য কী?
কোষ্ঠকাঠিন্য বলতে বোঝায় এমন একটি অবস্থা, যখন একজন ব্যক্তি সপ্তাহে তিনবারের কম মলত্যাগ করেন, বা মলত্যাগে কষ্ট হয়, অথবা মল অনেক শক্ত হয়ে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে এটি সাময়িক সমস্যা হলেও, কিছু মানুষের জন্য এটি দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক হয়ে দাঁড়ায়।
যুক্তরাষ্ট্রের “ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেস” (NIDDK)-এর মতে, আমেরিকায় প্রতি বছর প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
কোষ্ঠকাঠিন্যের মূল কারণ
কোষ্ঠকাঠিন্যের পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। যেমন—
আঁশজাতীয় খাবারের ঘাটতিপানির অভাবদীর্ঘ সময় বসে থাকা বা শারীরিক পরিশ্রমের অভাবঅতিরিক্ত চা-কফি বা প্রসেসড খাবার খাওয়ামানসিক চাপ ও উদ্বেগকিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন অন্তত ২৫-৩০ গ্রাম ফাইবার গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এই পরিমাণ পান না।
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন
সবার আগে নজর দিতে হবে আমাদের প্রতিদিনের খাওয়ার অভ্যাসে। আঁশ বা ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সবচেয়ে কার্যকর একটি উপায়।
ফাইবার দুই ধরনের হয়—সলিউবল (জলীয় দ্রবণীয়) ও ইনসলিউবল (জল অদ্রবণীয়)। সলিউবল ফাইবার যেমন ওটস, আপেল, কলা, গাজর ইত্যাদিতে পাওয়া যায়। এটি মলের পরিমাণ বাড়িয়ে তা নরম করে। ইনসলিউবল ফাইবার যেমন বাদামি চাল, সবজি ও ছোলার ডালের খোসা মলকে অন্ত্রে ঠেলতে সাহায্য করে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত চিকিৎসক ও গবেষক ড. মাইকেল গ্রেগার বলেন—
“দৈনন্দিন খাদ্যে পর্যাপ্ত ফাইবার থাকলে কোষ্ঠকাঠিন্যের ওষুধ প্রয়োজন হয় না। একথা বহু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।”
পর্যাপ্ত পানি পান
শুধু ফাইবার খেলেই হবে না, তা কার্যকর করতে হলে চাই পর্যাপ্ত পানি। না হলে উল্টো ফাইবার আরও বেশি শক্ত মল তৈরি করতে পারে।
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ড. মেরি থমাস বলেন—
“প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করলে মল নরম থাকে এবং সহজে বের হয়। যারা কম পানি পান করেন, তাদের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি অনেক বেশি।”
নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম
সকালে হাঁটাহাঁটি, হালকা ব্যায়াম, যোগব্যায়াম কিংবা সাইকেল চালানো—এসব শরীরচর্চা শুধু শরীরকে সুস্থ রাখে না, পেটের পেশিও সক্রিয় রাখে। ফলে মল সহজে নড়াচড়া করে অন্ত্রে।
ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ সায়েন্স বিভাগের গবেষক ড. জুলিয়া হ্যামিল্টন বলেন—
“শরীর চললে অন্ত্রও চলে। নিয়মিত হাঁটলে মলত্যাগের প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়। এমনকি ১৫-২০ মিনিট হাঁটলেও উপকার মেলে।”
মলত্যাগের সময় নির্ধারণ
কোষ্ঠকাঠিন্যের আরেকটি বড় কারণ হলো, মলত্যাগের চাপ পেলেও তা আটকে রাখা। এতে অন্ত্রে মল জমতে থাকে, যা পরে কঠিন হয়ে যায়। প্রতিদিন একই সময়ে টয়লেটে বসার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
সকালে উঠে খালি পেটে গরম পানি খেয়ে টয়লেটে বসলে অনেকেই আরাম পান। যদিও প্রথম দিকে কিছু ফল না মিললেও ধৈর্য ধরলে শরীর নিজেই সময় বুঝে নেওয়া শুরু করে।
প্রোবায়োটিক খাবার
দই, ঘোল, কেফির বা ফারমেন্টেড খাবারে থাকা প্রোবায়োটিক ভালো ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে। ফলে হজম প্রক্রিয়া ভালো হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূরে থাকে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক গবেষণাপত্রে ড. জনাথন রকস বলেন—
“প্রোবায়োটিক গ্রহণে অন্ত্রে মলচলাচলের গতি বাড়ে। নিয়মিত দই খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য ৩০%-এর বেশি হ্রাস পেতে পারে।”
মানসিক চাপ কমানো
চাপ, দুশ্চিন্তা বা মানসিক অস্থিরতা হজমের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ব্রেন এবং অন্ত্রের মধ্যে একটি স্নায়বিক সংযোগ আছে, যাকে বলে “গাট-ব্রেইন অ্যাক্সিস”। মানসিক চাপ থাকলে অন্ত্রের চলাচল কমে যায়।
মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, গভীর নিঃশ্বাস নেওয়ার অনুশীলন এসব মানসিক প্রশান্তি আনে। ফলে অন্ত্রও স্বাভাবিকভাবে কাজ করে।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার নিউরোসায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. এলেন ওয়াকার বলেন—
“চাপ এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সম্পর্ক গভীর। মানসিক প্রশান্তি আনা গেলে হজমশক্তিও ফিরে আসে।”
ঘরোয়া কিছু প্রতিকার
কিছু সহজ ঘরোয়া প্রতিকারও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। যেমন—
সকালে খালি পেটে এক গ্লাস গরম পানিতে লেবু ও মধু মিশিয়ে খাওয়াভেজানো মেথি বা ইসুবগুল খাওয়াশুকনো কিশমিশ বা চিয়া সিডস রাতে ভিজিয়ে সকালে খাওয়া
এসব প্রাকৃতিক উপায় অন্ত্রকে পরিষ্কার রাখে।
ওষুধের আগে ধৈর্য ও নিয়ম
অনেকেই ধৈর্য হারিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ল্যাক্সেটিভ বা মল নরমকারী ওষুধ খেয়ে ফেলেন। যদিও সেগুলি সাময়িক উপশম দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই অভ্যাস অন্ত্রকে আরও দুর্বল করে দেয়।
ড. টেরেন্স ল্যাং, অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট, বলেন—
“প্রাকৃতিক উপায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ন্ত্রণ করাই শ্রেয়। নিয়মিত ল্যাক্সেটিভ ব্যবহার অন্ত্রের স্বাভাবিক ছন্দকে নষ্ট করে দিতে পারে।”
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
যদি নিয়ম মানার পরও—
টানা তিন সপ্তাহের বেশি সময় কোষ্ঠকাঠিন্য থাকেমলে রক্ত আসেওজন কমে যায়পেট ব্যথা বা ফাঁপা থাকে
তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, কোষ্ঠকাঠিন্য অনেক সময় কোলন ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণও হতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য কোনো লজ্জার বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের শরীরের একটি সতর্কবার্তা। তাই এটিকে উপেক্ষা না করে সময়মতো সচেতন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সহজ কিছু নিয়ম মানলেই আমরা এই সমস্যার সমাধান পেতে পারি—ওষুধ ছাড়াই। শুধু দরকার ধৈর্য, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত পানি ও শারীরিক সচেতনতা। আর কখনো কখনো দরকার হয় একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ।
সূত্র: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডায়াবেটিস অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ অ্যান্ড কিডনি ডিজিজেস, যুক্তরাষ্ট্র