বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ০৮:৩২ পূর্বাহ্ন

এমপিওভুক্তির জন্য টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয়: সংসদে জাপা সদস্য

ভয়েস বাংলা প্রতিবেদক / ২ বার
আপডেট : রবিবার, ৩০ জুন, ২০২৪

শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। তারা বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও বৈষম্য লেগেই আছে। শিক্ষার দুর্নীতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। এমপিওভুক্তির জন্য টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয়। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সংসদ সদস্যদের অন্যান্য অভিযোগের জবাব দিলেও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কিছু বলেননি।
রবিবার (৩০ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মঞ্জুরি দাবির বিরুদ্ধে ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় এ দাবি করেন তারা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছয়জন সংসদ সদস্য ছাঁটাই প্রস্তাব দেন। তাদের মধ্যে পাঁচ জন বক্তব্য রাখেন। জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক আজ (রবিবার) সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন।

ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসনের হামিদুল হক খন্দকার বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ সব সময় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে থাকে। শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও বৈষম্য লেগেই আছে। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষাক্রম ও আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে। মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে পাঁচ-সাত বছর ধরে থেকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে। নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে।

বরিশাল-৪ আসনের পংকজ নাথ বলেন, এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রশংসনীয়। তবে কুড়িগ্রামের চিলমারীর কেউ যদি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে নিয়োগ পায়, তাহলে সে যোগদান করে না। পার্বত্য এলাকায় তো আরও সমস্যা। এ কারণে শিক্ষক নিয়োগের পরেও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই নিয়োগটি অঞ্চলভিত্তিক করার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষা অফিসারদের শূন্য পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, হাইকোর্ট এমপিদের সভাপতি হতে বারণ করলেন। বারবার এমপিরা এটা নিয়ে কথা বলেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন আপিল করবেন। আসলে এমপিদের সবাই অপমান করে। সবাই এমপিদের অসম্মান করতে খুব উৎসাহবোধ করেন। জানি না হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আদৌ আপিল করেছেন কি না? আজ তিনি মন্ত্রী, কাল কোন কারণে মন্ত্রী না হন, তাহলে তার অবস্থাও আমার মতো হবে।’

জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ভবন হয়েছে কিন্তু শিক্ষার মানের পরিবর্তন হয়নি। আমার নির্বাচনি এলাকায় একটি সরকারি বিদ্যালয়ে ৪৩টি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে। পাঠদান হয়নি পাঁচটিতে। পাঁচটি রুম ব্যবহার হয়। না হয় আরও পাঁচটিসহ ১০টি হল বা ২০টি হলো। কিন্তু রুম ৪৩টি। এই যে অপব্যয়। আমার পাকা বাড়ি, পাকা পায়খানা কিন্তু খাবার নেই। এটা হচ্ছে আজকের শিক্ষার অবস্থা।

তিনি বলেন, এমপিওভুক্ত হয় না। আবেদন গ্রহণও বন্ধ। এক বছর আগে যাদের এমপিওভুক্তির চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের পিয়ন চাপরাশির দু-একজনের বেতন হয়েছে, অন্যদের বেতন হয় না। হয়তো টাকা নেই। এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন টেবিলে যেতে হয়। ধাপে ধাপে টেবিল মানে ধাপে ধাপে দুর্নীতি। একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার ২০ থেকে ২৫ বছর পরে বেতন হচ্ছে। গ্রামের স্কুল মাদ্রাসায় চার তলা ভবন করা হয়েছে। যারা এই পরিকল্পনা করেছে, তারা বাংলাদেশে করেন না। তারা গ্রাম দেখেননি।

নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম বলেন, রেলের খালাসি পদে ২ হাজার ১০০ জন ছেলে-মেয়ের চাকরি হয়েছে, যাদের সবাই মাস্টার্স পাস। এটা খুবই কষ্টের বিষয়। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে। কিন্তু আগামী অর্থবছরে কমপক্ষে পাঁচ লাখ অনার্স-মাস্টার্স পাস ছেলে-মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কোনও শিক্ষিত বেকার না থাকে। তিনি বলেন, সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতি। শিক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতি। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। টাকা ছাড়া কোনও শিক্ষক অবসর ভাতা পাচ্ছেন না। আমার শ্যালক শিক্ষক ছিলেন, মারা গেছেন। আমি নিজে তিন বছর তদবির করলেও অবসর ভাতা পাননি। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। এটা সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। এই দুর্নীতির কারণে গোটা জাতি গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত বেকার যুবকরা আত্মহত্যা করছে।
ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য নাসের শাহরিয়ার জাহেদী প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা গবেষণায় ব্যয় বাড়ানোর জন্য প্রস্তাব করেন। জবাবে মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, দূরবর্তী জায়গায় অনেকে যোগদান করে না, এটা ঠিক। তারপরও বিগত ছয় মাসে ৯৯ হাজার শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এটি একটি সমস্যা, আমরা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছি। এই যে একটা বাধা আছে, আমরা আইন সংশোধনের মাধ্যমে তা নিরসনের চেষ্টা করছি।

সংসদ সদস্যদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত যেসব কলেজ হয়েছে, সেখানে এমপিদের গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে একটি রায় এসেছিল। যার কারণে সংসদ সদস্যদের সভাপতি করা হচ্ছে না। আমরা ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা এটর্নিং জেনারেলের সঙ্গে কথা বলেছি। আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এটা আদালত থেকে নিষ্পত্তি করা হবে। আমরা এ বিষয়ে লিভ আবেদন করেছি।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এবারের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষার তিনটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও আরও ১৯টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। সেগুলোর অর্থ এই হিসাবে আসেনি। আমরা মনে করি শিক্ষার জন্য যে বরাদ্দ, সেটা যথাযথ।

আইন মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ পংকজ নাথ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান অধিকার রক্ষায় কমিশন গঠনের দাবি জানান। বিরোধী দলের সংসদ সসদ্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আইন বড়লোকের জন্য। বিচারকের অভাব রয়েছে। বিচারের জন্য এই দরজা, ওই দরজায় ঘুরতে ঘুরতে মানুষের জীবন শেষ।’ তিনি প্রতিটি বিভাগে হাইকোর্টের বেঞ্চ করার দাবি জানান।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, সুন্দর সুন্দর ভবন হয়েছে। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ আদালতে ঘুরছেন। মামলাজট বাড়ছে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে বরিশাল-৪ আসনের স্বতন্ত্র এমপি পংকজ নাথ বলেন, জোবরা গ্রাম কি আগের মতো আছে? সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়ে যেখান থেকে শুরু হয়েছিল ড. ইউনূস সাহেবের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প বা গ্রামীণ ব্যাংক। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র ঋণের নামে গরিব মানুষের…কাগজে-কলমে বলছেন সাড়ে ১২ শতাংশ। ১০ হাজার টাকায় প্রতি সপ্তাহে ২৫০ টাকা। প্রথম কিস্তিও ২৫০ টাকা, শেষ কিস্তিও ২৫০ টাকা। চারবার মাল্টিফ্লাই করেন, তাহলে দেখবেন কত শতাংশ সুদ আসে? প্যাকেজেজ লিমিটেডে ঋণ নিলেন ৫ শতাংশ সুদে। ইউনূস সাহেবের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিলো ৩৫ শতাংশ, যেটা ৫ শতাংশের কম সুদে। আমাদের কথা হচ্ছে, জোবরা গ্রাম কি আগের মতো আছে নাকি বদলে গেছে? মাইক্রো ক্রেডিট যদি সফল হতো, তাহলে গরিবের রক্তচোষা গ্রামীণ টেলিকম, প্যাকেজেজ লিমিটেডের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা, বিদেশিদের লবিংয়ে টাকা দেওয়া। পংকজ বলেন, বিএনপি-জামায়াত-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ব্যাঙের ছাতার মতো যে এনজিওগুলো আছে, সেগুলো তদন্ত করে বন্ধ করা হোক। মুজাহিদ (যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা) যখন মন্ত্রী ছিল, তখন তাদের ব্যাঙের ছাতার মতো এনজিও লাইসেন্স দিয়েছিল। দয়া করে সেগুলো খুঁজে বন্ধ করুন।

এনজিওগুলো গরিব মানুষের সন্তানদের জন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয় করেছে কি না, জানতে চান পংকজ নাথ বলেন, ‘গরিব মানুষের রক্তচোষা পয়সা যেন কারও কারও ব্যক্তিগত কোষাগারে জমা না হয়। মানুষ যাতে লভ্যাংশের সুবিধা পায়। প্রধানমন্ত্রী সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশকে পাল্টে দিয়েছেন। মাইক্রো ক্রেডিটের নামে গরিবের রক্তচোষা বন্ধ করুন।

জবাবে সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান নয়। এটি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। যেভাবে বিশ্বে পরিচয় দেওয়া হয়, তা সঠিক নয়। এটি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। এটি শুধু ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত। যদিও এরপর নানা রকম ব্যবসায় প্রসারিত করেছে তার চার্টারের বাইরে গিয়ে। সমাজকল্যাণে নিবন্ধিত কোনও এনজিও বেআইনি কাজ করলে তার বিরুদ্ধে তথ্য দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান মন্ত্রী।
পাবলিক মানি যেটা এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের জন্য এই অর্থের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি করার যখনই সরকার কোনও উদ্যোগ নিয়েছে, তখনই ‍বিদেশিদের নিয়ে সরকারের ঘাড়ের ওপর চড়াও হয়েছে। বলা হয়েছে পাবলিক স্পেস সোশ্যাল সেক্টরের জন্য কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর