আসন্ন ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন

আগামী সম্মেলনে বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্য পদ পেয়ে যাওয়ার একটি সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। এমনকি সদস্য হতে না পারলেও অন্য কোনো মাধ্যমে ব্রিকসের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সদস্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর কারণ, বাংলাদেশের ব্যাপারে রাশিয়া কিংবা ভারত কেউই কোনো ধরনের বিরোধিতাপূর্ণ বক্তব্য রাখেনি। ফলে ব্রিকসের যে নীতিমালা বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া রয়েছে, সেখানে যদি কোনো নতুন সমস্যা তৈরি না হয়, তাহলে এই সামিটে ব্রিকসের একটা এক্সপানশন বা সম্প্রসারণ ঘটতে পারে এবং সেই সম্প্রসারণে বাংলাদেশ যুক্ত হবে।
সম্পূর্ণ পরিবর্তিত এক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসের ১৫তম শীর্ষ সম্মেলন। অনুষ্ঠিতব্য শীর্ষ সম্মেলনটি ব্রিকসের জন্য ‘ক্রান্তিকালীন এক শীর্ষ বৈঠক’, যেখানে বিশ্বরাজনীতি, বিশ্বনিরাপত্তা ও বিশ্ব অর্থনীতি নতুন বাঁকে ধাবিত হচ্ছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন এই চারটি দেশকে নিয়ে ‘ব্রিক’ নামে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্ত হলে জোটটির নামকরণ করা হয় ‘ব্রিকস’। মূলত, ব্রিকের আমল থেকেই গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল বিশ্বের ও তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে পরিচিত অঞ্চলসমূহের মধ্যে একটা বড় ধরনের প্রভাব এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিবর্তন নিয়ে আসার লক্ষ্যে উদ্ভব ঘটে ব্রিকসের।
ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো তথা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীন—এই পাঁচটি রাষ্ট্রের ২০২৩ সালে সম্মিলিত বৈশ্বিক জিডিপি ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে জি-৭-এর জিডিপির পরিমাণ ৩০ দশমিক ৭। অর্থাত্, বিশ্বের সব থেকে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য সংগঠন জি-৭-এর টোটাল জিডিপি ব্রিকসের জিডিপির চাইতে কম। এটি একটি বড় ধরনের গুরুত্ব বহন করে। কারণ, আজ থেকে ২০ বছর আগে ব্রিকসের জিডিপি ৫ শতাংশেরও কম ছিল। সেই জিডিপি এখন ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ হয়ে জি-৭কে ছাড়িয়ে গেছে। এর মাধ্যমে ব্রিকসের অর্থনৈতিক উত্থান এবং অর্থনৈতিকভাবে ব্রিকস দেশগুলোর যে শক্তিমাত্রা, তা আমরা বুঝতে পারছি। এছাড়া ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ।
চলতি বছরের জুন মাসে ব্রিকস রাষ্ট্রসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে বাংলাদেশসহ ব্রিকসের বাইরের আরো ১০টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অংশগ্রহণ করেন। ফলে ব্রিকসের এবারের সম্মেলনের গুরুত্ব অনেক বেশি এবং এর প্রভাব নিঃসন্দেহে বিশ্বের জন্য একটি নতুন বাস্তবতার ইঙ্গিত। রাশিয়ার এই যুদ্ধের সময়ে ব্রিকসের গুরুত্ব আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো ব্রিকসকে একটি ‘বড় শক্তি’ হিসাবে মেনে নিয়েছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিকসের দিকে তাকিয়ে আছে। এই প্রেক্ষাপটে এবারের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এই সম্মেলনে সরাসরি যোগ দিতে চেয়েছিলেন বটে কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করেছেন। পুতিনের পরিবর্তে তার অত্যন্ত অভিজ্ঞ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ অংশ নেবেন। পুতিনের অংশগ্রহণ না করা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, আইসিসি পুতিনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি রায় দিয়েছে এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। যদিও রাশিয়া আইসিসির সদস্য নয় এবং রাশিয়ান সরকার জানিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের কোনো দায় নেই। কিন্তু তার পরও অনেকে ধারণা করছেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় পুতিন উপস্থিত থাকলে তাকে গ্রেফতার করার একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে। যদিও এ নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।
ইতিমধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ৫০০ দিন অতিক্রম করেছে। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা প্রথম থেকেই দেখতে পাচ্ছি। এখানে ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ানরা নতুন নতুন অভিযান পরিচালনা করছে। ন্যাটোর যে সম্মেলনটি কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হলো, সেখানে ইউক্রেনের পক্ষে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো শক্তিমত্তা নিয়ে আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। ফলে যুদ্ধ আরো নাজুক অবস্থায় চলে গেছে। এ কারণেও পুতিনের জন্য এই সম্মেলনে অংশ নেওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিছুদিন আগে পুতিন তথা মস্কোর বিরুদ্ধে ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহ ঘটে গেল, যদিও তা ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। এই বিদ্রোহের ফলে রাশিয়ার জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়েছে। কিছু দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে রাশিয়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে। এই বাস্তবতায় পুতিনের পক্ষে এই সম্মেলনে যোগ দেওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ বটেই। যুদ্ধে রাশিয়া যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি রাশিয়ার জন্য অবশ্যই বড় মাথাব্যথার কারণ।
এদিকে ব্রিকসের একটি এক্সপানশন বা সম্প্রসারণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ব্রিকসের সদস্য হতে আগ্রহী, এমন কয়েকটি দেশের নাম এখন সামনে চলে এসেছে। এই বিষয়ে ব্রিকসের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। যারা সদস্য হতে চায়, তাদের আগ্রহও বেশ লক্ষণীয়। যেমন—মেক্সিকো, সৌদি আরব, আরব আমিরাত এমনকি বাংলাদেশের নামও আমরা শুনতে পাচ্ছি। আগামী সম্মেলনে বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্যপদ পেয়ে যাওয়ার একটি সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। এমনকি সদস্য হতে না পারলেও অন্য কোনো মাধ্যমে ব্রিকসের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সদস্য হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, বাংলাদেশের ব্যাপারে রাশিয়া কিংবা ভারত কেউই কোনো ধরনের বিরোধিতাপূর্ণ বক্তব্য রাখেনি। ফলে ব্রিকসের যে নীতিমালা বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া রয়েছে, সেখানে যদি কোনো নতুন সমস্যা তৈরি না হয়, তবে এই সামিটে ব্রিকসের একটা এক্সপানশন বা সম্প্রসারণ ঘটতে পারে এবং সেই সম্প্রসারণে বাংলাদেশ যুক্ত হবে।
দীর্ঘদিন ধরেই ব্রিকস একটি মুদ্রা প্রচলনের কথা বলে আসছে। যাকে ‘ব্রিকস কারেন্সি’ বলা হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে মার্কিন ডলার থেকে বেরিয়ে একটি বিকল্প পন্থা তৈরির একধরনের প্রক্রিয়া চলমান। একটা সময়ে ডলারকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল ইউরো। যদিও সে চ্যালেঞ্জ পশ্চিমা বিশ্বের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। তবে ডি-ডলারাইজেশনের বড় প্রক্রিয়াটাই শুরু হয় এই ইউরোর মাধ্যমে। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমা বিশ্ব অনেক শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ। তাই ইউরোর বিষয়টা সামনে আসছে না। উপরন্তু এখন ব্রিকস কারেন্সি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কেননা বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তাদের দ্বিপাক্ষিক মুদ্রা ব্যবহারের একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকাসহ অনেক দেশই ডলার-ব্যবস্থা থেকে পুরো বেরিয়ে না এলেও ক্ষেত্রবিশেষে ডলার-বিমুখ হওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর একটা বড় কারণ, যুদ্ধের ফলে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দেখা দিয়েছে সংকট। বাংলাদেশসহ অনেক দেশই এখন অন্য মুদ্রায় বাণিজ্য করার আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং সেটি সম্ভবও হচ্ছে বটে। এ কথা আমরা ভারত, চীন ও রাশিয়ার ক্ষেত্রে বলতে পারি, আরো অনেক দেশের উদাহরণ দিতে পারি। ব্রিকসের এই মুদ্রানীতির ব্যাপারে অনেকেই আশাবাদী। কিন্তু এই শীর্ষ বৈঠকে সেটি চালু হবে কি না, নিশ্চিত নয়। এ নিয়ে সরাসরি আলোচনা না হলেও ব্রিকস প্রধানদের ভেতরে অভ্যন্তরীণ আলোচনা নিশ্চয়ই হবে। যেখানে দ্বিপাক্ষিকভাবে ডলার-বিমুখ হওয়ার চেষ্টা চলছে, সেখানে বিশ্বের একটি শক্তিশালী অঞ্চলের ভেতরে যদি একটি নতুন মুদ্রা চালু হয়, তা অবশ্যই বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন দিক উন্মোচন করবে।
আমরা জানি, কয়েক বছর আগে ব্রিকস একটি ব্যাংক চালু করেছে, যেটি নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে পরিচিত। সেই ব্যাংক থেকে বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি দেশ ঋণ সহায়তা পেয়েছে। শুরুতে এই ব্যাংক ৫৭টি ফাউন্ডিং সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা এক শতাধিক। ব্রিকস ভূরাজনৈতিক গ্রুপ নয়, কিংবা কোনো সামরিক জোটও নয়; ব্রিকস মূলত একটি কূটনৈতিক প্ল্যাটফরম। এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্বের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে তারা কথা বলেন এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহে নজর দেন। ফলে ব্রিকসের সদস্যপদ প্রাপ্তি নিয়ে অতীতে অনেক ধরনের আলোচনা হয়। বিশেষ করে, বাংলাদেশ সদস্যপদ লাভ করলে কী ধরনের সুবিধা বা অসুবিধা সৃষ্টি হবে, সে বিষয়গুলো সামনে উঠে এসেছে। ব্রিকসের সদস্য পদ বাংলাদেশ যদি অর্জন করতে পারে, তাহলে এটি অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের ইতিবাচক দিক বয়ে আনবে। ব্রিকসের একটি বিশাল বাণিজ্য-বাজার রয়েছে। ফলে ব্রিকস থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সুবিধা পাবে। কূটনৈতিক দিক থেকেও বড় ধরনের সাপোর্ট পাবে।
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে উন্নয়নশীল বিশ্বে নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। একদিকে মুদ্রাস্ফীতি ও অন্যদিকে বাণিজ্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি। ক্ষতিগ্রস্ত সাপ্লাইচেইন। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশে অবকাঠামগত উন্নয়নের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, অধিকাংশই মুখ থুবড়ে পড়েছে এবং সেটি অনেক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যেও ধাবিত হচ্ছে। এমন অবস্থায় ব্রিকস দেশগুলো একটি বড় ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।
সবশেষে বলা যেতে পারে, বর্তমান বিশ্বব্যাবস্থায় আমরা যে ধরনের ক্রান্তিকাল দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে নতুনভাবে স্নায়যুদ্ধের কথা শোনা যাচ্ছে, এমন প্রেক্ষাপটে আসন্ন ব্রিকস সম্মেলন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করবে।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)